Tuesday, 26 October 2021

অনির ডাইরি ২৬শে অক্টোবর, ২০২১

 অনির ডাইরি ২৬শে অক্টোবর, ২০২১


‘নমস্কার, আমি প্রদীপ ব্যানার্জী বলছি, INTTUC থেকে-’ জনৈক বৃদ্ধের গমগমে কণ্ঠস্বর ভেসে এল মুঠো ফোনের ওপার হতে। ‘শুনলাম আপনার ট্রেন অবরোধে আটকে আছে, আমরা অপেক্ষা করছি, আপনার জন্য-’।  


সেই সকাল সাড়ে নটা থেকে আটকে আছে আমার ট্রেন, এখন পাক্কা সাড়ে এগারো। সহযাত্রী শিক্ষিকাদের মুঠোফোনে ভেসে আসা ছুটকোছাটকা খবর জানিয়ে যাচ্ছে পরিস্থিতি বেশ জটিল। জব্বর হাঙ্গামা বেঁধেছে সোদপুর স্টেশনে। হাতাহাতি-লাথালাথি-পেটাপিটি সবই চলছে, চলছে না শুধু হতভাগা ট্রেনটা। সাড়ে এগারোটা থেকেই ডেকেছিলাম মিটিংটা। কখন পৌঁছাব কে জানে?


সাল ২০১৭। মাসটা বোধহয় জুলাই বা আগস্ট।কামরার বাইরে চোখ ঝলসানো রোদ। আর ভিতরে বইছে ঘামের বন্যা। তেমনি দমচাপা ভিড়। আপদের দল, অবরোধকারীগুলোর জন্য মানসম্মান আর রইল না। এমনিতেই আমার কাছে মিটিং করায় আপত্তি ছিল ওদের, বরাবরই এই মিটিং নাকি চন্দননগর আপিসে হয়। আমার স্তরে নয়, বড় সাহেবের টেবিলে হয় ওদের যাবতীয় বিবাদের মিমাংসা। এটাই নাকি এখানকার দস্তুর, আমার আপিসের কাজ শুধু ফাইলটা তোলা। আর এখানেই ঘোর আপত্তি আমার। আমার এলাকার সামান্যতম সমস্যা নিয়ে কেন সবকথায় ওপরওয়ালাকে বিব্রত করব? চেষ্টা তো করে দেখি, নাহলে তো বড় সাহেব আছেনই। মিটিং ডাকার দিনই শুনেছিলাম,জনৈক প্রদীপ বাবু আসবেন নাকি মিটিং করতে, সেই ভদ্রলোকই ফোন করেছিলেন একটু আগে। 


আপিস ঢুকতে সাড়ে বারোটা পার, ঢুকে দেখি চেম্বারের বাইরে বা বলা যেতে পারে, বুড়ো কালেক্টরেটের বারন্দায় পেতে রাখা চেয়ারে শ্রমিক পরিবৃত হয়ে বসে আছেন জনৈক কৃশকায় বৃদ্ধ। টকটকে ফর্সা রঙ, রোদে পুড়ে তামাটে, প্রশস্ত কপাল, খড়্গনাসা। পরনে খদ্দরের পাঞ্জাবি-পায়জামা, কাঁধে শান্তিনিকেতনী ঝোলা ব্যাগ। একেবারে যেন নমকহালাল সিনেমার ডাকসাইটে ট্রেড ইউনিয়ন নেতা। 


মিটিং শুরু হতেই বুঝলাম, চেহারা যতই সিড়িঙ্গে হোক, বৃদ্ধের দাপট প্রবল। হাতে অদৃশ্য ছড়ি নিয়ে ঘোরেন বৃদ্ধ, যা সমানতালে বর্ষিত হয় কখনও মালিকপক্ষ, কখনও বা শ্রমিকপক্ষের মাথায়। উনিই বিচারক, উনিই জুরি এবং উনিই ফাঁসুড়ে। আর একটা জিনিস প্রত্যক্ষ করলাম, আমার মাথার ওপর ছড়ি মারার বা ছড়ি ঘোরানোর কোন চেষ্টা করলেন না। বরং আমার মতামত যথোচিত গুরুত্ব সহকারে শুনলেন এবং ক্ষেত্র বিশেষে মেনেও নিলেন। 


মিটিং চলাকালীনই বুঝতে বাকি রইল না যে, এই বিবাদ মিটলে আমার ঘরেই মিটবে। সময় হয়তো লাগবে, তবে মিটে যাবে। সে তো সব শ্রমিক বিক্ষোভ মিটতেই সময় লাগে। মিটিং শেষের চায়ের সাথে টুকটাক খেজুরে গল্প হল, দেখলাম উনি আমাদের দপ্তর সম্পর্কে সম্পূর্ণ ওয়াকিবহাল। দপ্তর মানে আমার ক্ষুদ্র চুঁচুড়া নয়, সমগ্র শ্রম কমিশনারেট সম্পর্কেই উনি সচেতন। অনেক সিনিয়র স্যার/ম্যাডামদের উনি নামে চেনেন এবং নাম ধরে ডাকেন। নাঃ নেতাসুলভ তাচ্ছিল্য নয়, বরং সহকর্মী সুলভ অধিকারবোধ থেকে নাম করছেন উনি, শুনতে শুনতে ভির্মি খেলাম,সর্বনাশ ইনি কি আমাদের অসংগঠিত শ্রমিক কল্যাণ পর্ষদের চেয়ারম্যান প্রদীপ ব্যানার্জী নাকি? যাঁর বোর্ডের টাকায় আমাদের এত রমরমা? প্রতিবছর মেলার কার্ডে ছাপা হয় যাঁর নাম। তাহলে তো তাঁর মর্যাদা যে কোন রাষ্ট্র মন্ত্রীর সমতুল। অন্য এক বোর্ডের চেয়ারম্যান বিগত মেলায় খুব ক্ষুণ্ণ হয়েছিলেন, কার্ডে ওণার নাম স্থানীয় বিধায়কের নামে নীচে লেখাতে।


 ইনি যদি সত্যিই সেই প্রদীপ ব্যানার্জী হন, তাহলে তো এণার যথোপযুক্ত  খাতির করিনি আমি। কথাটা বলাতে দেখলাম প্রভূত আমোদিত হলেন বৃদ্ধ। সেই শুরু, এরপরও বিগত বছর পাঁচেকে অগণিত বার এসেছেন বৃদ্ধ, মিটিং শেষে বসেছে জমাটি আড্ডা। শুনিয়েছেন নকশাল জীবনের কথা, যথার্থই তৃণমূল স্তর থেকে শ্রমিক রাজনীতি করে আসছেন ভদ্রলোক। প্রথম জীবনে এয়ারফোর্সে পাইলটের চাকরী পেয়েও ছেড়ে দেন। জানিয়েছেন আগুনে সত্তরের অত্যাচার কি ভাবে ভেঙেছে ওণার স্বাস্থ্য। কিছুদিন আগেও নাকমুখ দিয়ে রক্ত বেরিয়েছে, ডাক্তার বলেছেন বিশ্রাম নিতে, নেননি উনি। শোনেননি কারো কথা। শুধু নিজ স্ত্রীকে সামান্য ভয় পান বৃদ্ধ। সে আর কে না পায়?


 ২০২০র  লকডাউন সবে আংশিক উঠেছে, দীর্ঘদিন বন্ধ থাকা বয়লার পরিষ্কার করতে গিয়ে মারা গেল এক শ্রমিক, আহত জনা চার।কারখানার গেটে ঝুলল বিশাল তালা। প্রদীপ বাবুর উপস্থিতিতে আমার চেম্বারে ঘন্টার পর ঘন্টা চলল মিটিং, বয়লার আধিকারিককে দিয়ে চেক করিয়ে, বয়লার সারিয়ে, পুলিশ তথা জেলা প্রশাসনের অনুমতি নিয়ে, ভীত ক্ষুব্ধ শ্রমিকদের বুঝিয়ে, মালিককে চমকে, মৃতের পরিবারকে মোটা অঙ্কের ক্ষতিপূরণ, আহতদের চিকিৎসার যাবতীয় ব্যয়ভার এবং ক্ষতিপূরণ, পদোন্নতির ব্যবস্থা করিয়ে খোলা হল সেই কোম্পানি। একাই বল-ব্যাট-ফিল্ডিং করে গেলেন প্রদীপ বাবু। মাঝে মাঝে মুখখোলা ছাড়া কিছু করতেই হল না আমায়- 


কারখানা খোলার মিষ্টি দিতে আসার সাথে সাথে নতুন দাবী সনদ দিয়ে গেল শ্রমিকপক্ষ। আমার ঘরে স্বাক্ষর হওয়া সেই দাবীপত্রের পূর্ণ হয়েছে তিনটি বৎসর। এবার নতুন চার্টার অব ডিমান্ডের পালা। ভাবলাম এ আর এমন কি কথা, প্রদীপ বাবু আছেন তো। বললামও সে কথা। উনি জানালেন, ‘দাঁড়ান আগে নির্বাচনটা মিটতে দিন।’ শুনলাম বেশ কয়েকটা গুরুত্বপূর্ণ জেলায় প্রচারের দায়িত্ব পড়েছে ওণার। বেশ তাই হোক। 


নির্বাচন মিটল,ক্ষমতায় ফিরল ওণার দল। শুধু ফিরলেন না প্রদীপ বাবু। রাতারাতি শেষ হয়ে গেল সব। হাহাকার ভরা সুরে ফোন করে শ্রমিক থেকে মালিকপক্ষ, ‘শুনেছেন ম্যাডাম। আমাদের প্রদীপ বাবু চলে গেলেন’। 


দিন যায়, সপ্তাহ গড়ায়। শৌভিকের বদলীর খবর আসে, আমাদের পুরাতন বদলীর নির্দেশনামা বাতিল হয়ে নতুন অর্ডার মক্সো হয়। বন্দরের কাল হয়ে আসে শেষ। এমন সময় এসে হাজির হয় গুটি কয়েক শ্রমিক, ‘যাবার আগে আমাদের কেসটা মিটিয়ে দিয়ে যান ম্যাডাম।’ ফোন করেন মালিকও,‘শুনলাম আপনিও চলে যাবেন। প্রদীপবাবুও নেই। একটু ঝামেলাটা মিটিয়ে দিয়ে যান ম্যাডাম-’। 


বেশ বসলাম ঝামেলা মেটাতে। গড়ালো আলোচনা,হল তর্কবিবাদ। শুনতে শুনতে, বকতে-বকতে বারবার চোখ চলে যাচ্ছিল আমার পাশে রাখা তোয়ালে ঢাকা ফাঁকা চেয়ারটায়। প্রদীপ বাবুর ঢঙে ছড়ি ঘোরানো, ছড়ি পেটানোর চেষ্টা করলাম, বার তিনেক হুমকিও দিলাম, ‘সবকটাকে দূর করে দেব আমার চেম্বার থেকে। ’ একটা কথাও শুনল না কেউ।  উল্টে জনৈক রগচটা শ্রমিক, ৩২পাটি দেখিয়ে বলল, ‘বের করে দিলেও যাব নাকো। এই আপনার ঘরের বাইরেই বসে থাকব। ’ 


যাই হোক, শেষ পর্যন্ত প্রদীপ বাবুর স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধাবনত হয়ে, এবারেও মীমাংসা হল আমার টেবিলেই। সাক্ষরিত হল ত্রিপাক্ষিক চুক্তিপত্র। যা বলবৎ থাকবে আগামী তিনটি বছর।  শতকরা ১১শতাংশ হারে মাইনে বাড়ল সবার, এরওপর আরও ৮৫০টাকা করে মাইনে বাড়বে প্রতিবছর, পরবর্তী দাবীসনদ না পেশ করা পর্যন্ত। বাড়িভাড়া ভাতা বাড়ল শতকরা ২ শতাংশ হারে।  ক্যাজুয়াল কর্মীদের একাংশকে পার্মানেন্ট করার লিখিত প্রতিশ্রুতিও দিল মালিকপক্ষ। আজ চুঁচুড়া ছেড়ে যাবার আগের দিন, প্রদীপবাবুর নিজের হাতে বানানো, দাবীসনদ, কার্যকর করার মাধ্যমেই আমরা শ্রদ্ধা জানালাম ওণার স্মৃতির প্রতি। যেখানেই থাকুন, ভালো থাকুন প্রদীপবাবু। শ্রম দপ্তরের দীর্ঘ পনেরো বছরের চাকরী জীবনে আপনার মত নেতা আমি দ্বিতীয় কাউকে পাইনি।

No comments:

Post a Comment