Monday 11 October 2021

অনির পুজোর ডাইরি ৮ই অক্টোবর, ২০২১

 

(পর্ব-৩) 

শুভ প্রতিপদ


কাকডাকা ভোরে ঘুম ভাঙালো মা,‘দরজাটা একটু খুলে দিবি? তোর বাবা'ই তো দিত-’। সেন্টু দিতে কিছু জানে বটে আমার গর্ভধারিণী। দরজা,অর্থাৎ চাটুজ্জে বাড়ির সিংহ দরজা। যাকে আমরা তিন প্রজন্ম সোহাগ করে ডাকি, সদর দরজা বলে। কাক ডাকা ভোরে, ঘুম ভেঙে উঠেই বাবা ছুটত সদর দরজা খুলতে।  বাবা খুলত বলেই, আর কেউ অতটা গা করত না। বাবা হাসপাতালে ভর্তি হবার সাথে সাথেই, মায়ের প্রধান মাথা ব্যথা হয়ে দাঁড়িয়েছে এই সদর দরজা খোলা। কাল রাত সাড়ে এগারোটায়, জবরদস্ত পারিবারিক আড্ডার মাঝেও মনে করিয়ে দিয়েছে আমার খুড়তুতো ভাই অয়নকে। ‘দরজাটা একটু মনে করে খুলে দিস বাবা। দুধ- কাগজ সব ফিরে যাবে নইলে। ’ 


 জমাটি আড্ডার ফাঁকে, অয়ন আশ্বস্তও করেছিল, ‘তুমি চিন্তা করছ কেন? ও চৈতি ঠিক খুলে দেবে। ’ চৈতি অর্থাৎ চাটুজ্জে বাড়ির বর্তমান প্রজন্মের জ্যেষ্ঠ কুলবধূ। এবাড়িতে সব সমস্যার একজনই মুস্কিল আসান, শ্রীমতী চৈতি। প্রত্যহ প্রাতে বাবার পরই যদি এবাড়িতে কেউ শয্যা ত্যাগ করে তবে তিনি চৈতি। এহেন চৈতি দায়িত্ব নেওয়া মানে, সে কাজ হবেই।  


তবুও ঘুম চোখে, বাসি মুখে অন্ধকার দালান টপকে,  দরজার খিল খুলে, লাল রোয়াক পেরিয়ে, তিন ধাপ সিঁড়ি নেমে, সাবেকী উঠোনের পড়ে থাকা ভগ্নাংশকে আড়াআড়ি পেরিয়ে দিলাম দরজা খুলে। পূব আকাশে তখন এক মুঠো আবির ছড়িয়েছে কে যেন।বইছে মৃদু ঠান্ডা হাওয়া। মনে পড়ে গেল বৃদ্ধ এরপর-পরই পাম্প চালাতে যেত। দিলাম পাম্পটা চালিয়ে-। নিঝুম বাড়িতে গুনগুন করে চলা জলের পাম্পের আওয়াজ বড় ঘুম পাড়ানিয়া, হাই তুলে চালিয়ে দিলাম রেডিও- রফি সাহাবের মধু ঢালা কণ্ঠ পলকে গুঞ্জরিত হল সমগ্র বৈঠক খানা জুড়ে, "ওয়াক্ত ইন্সান পে এয়সা ভি কভি আতা হ্যায়- রাহ মে ছোড়কে সায়া ভি চলা যাতা হ্যায়। দিন ভি নিকলে গা কভি, রাত কে আনে পে না যা, মেরি নজরো কে তরফ দেখ, জমানে ফে না যা।" আমরা বাপ-মেয়ে দোঁহে রফি সাহেবের বড় অনুরাগী। শৌভিক আবার টিম কিশোর কুমার। মা মুকেশ আর শ্রীমতী তুত্তুরী অরিজিৎ সিং।  


জল উঠতে, উঠতে নেলপালিশ লাগিয়ে নিলাম হাতে-পায়ে। সময় বড়ই মূল্যবান আমার জীবনে, নিছক অবকাশ পেলেই টুকটাক কাজ সেরে নি আমি। 


আপিস ঢুকতে সামান্য বেলা হল, একদল লোক অপেক্ষা করে বসেছিল শুধু আমারই তরে। সকাল বেলাই ফোন করেছিল পালের গোদা থুড়ি নেতা, ‘ম্যাডাম আপনার বাবা কেমন আছেন? সেরকম হলে দুদিন না হয় পিছিয়ে দিন মিটিংটা-। পুজোর আগেই মিটে গেলে ভালো হয়,তবে আপনার অসুবিধা থাকলে পুজোর পরই বসব আমরা।' আশ্বস্ত করে জানিয়েছিলাম, আজ আসব তো বটেই, তবে হয়তো বড়জোর আর এক বা দুদিনই যাব চুঁচুড়া, বদলী হয়ে গেছি আমি। এবার সিদ্ধান্ত আপনাদের, যদি আসতে চান, আমার সাথেই বসে মিটিয়ে নিতে চান আপনাদের দাবীসনদ, তো সুস্বাগতম, না হলে আমার  সুযোগ্য উত্তরাধিকারী তো রইলেনই। তা সত্ত্বেও এসেছে ব্যাটারা। মালিক এবং শ্রমিক উভয়পক্ষই। 


বেলা তিনটে পর্যন্ত ধস্তাধস্তি করে,কখনও প্রবল হুমকি, কখনও সেন্টু, কখনও নিছক দর কষাকষি করে নোটশিটে নামল সেটেলমেন্ট। শেষ দিনে এসে সই করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে উভয়পক্ষকে বিদায় জানিয়ে, পড়ে থাকা ফাইলপত্রে সইসাবুদ করে, বেঁচে থাকা বিল ভাউচার ছেড়ে যখন গাড়িতে উঠলাম, ভিজিটিং আওয়ার শুরু হতে বাকি মাত্র সোয়া একটি ঘন্টা। একঘন্টায় কি পৌঁছাতে পারব চুঁচুড়া থেকে হাওড়া? আপদ নার্সিংহোম, ইনটেনসিভ কেয়ারের রুগীকে দেখার সময় নির্দিষ্ট করেছে মাত্রই আধটা ঘন্টা। কালও দেরী হয়েছে মিনিট সাতেক, আজ যে কি হবে- 


ও রঞ্জিৎ, একটু জোরে চালাও বাপু। কেন যে আজই এত জ্যাম, দিল্লী রোড জুড়ে। সোয়া পাঁচটা নাগাদ ঝড়ের মত ঢুকলাম ইন্টেনসিভ কেয়ারে। নিদ্রিত বাবার হাতটা ধরতে গিয়ে মনে পড়ল, স্যানিটাইজ করা হয়নি তো। ভিজে হাতে হাতটা ধরতেই চোখ খুলল বাবা, সুপ্তোত্থিত পিতার মুখমণ্ডলে কেন জানি না, নিজের শিশুকন্যার মুখাবয়ব প্রত্যক্ষ করলাম আমি। ঠিক এই ভাবেই ঘুম ভাঙলে আড়ামোড়া ভাঙে তুত্তুরী। মুখটা ঠিক এই রকমই রক্তিম বর্ণ ধারণ করে পলকের তরে। 


‘অফিস যাসনি?’  প্রশ্ন করে বৃদ্ধ। জবাবে জানাই, আপিস ফেরতাই তো এসেছি। তাই না পরণে শাড়ি, উন্মুক্ত কেশদাম। চোখের পাতায় কাজলের হাল্কা ছোঁয়া। লিপস্টিক অবশ্যি খেয়ে নিয়েছি অনেক আগেই, মিটিং এর ফাঁকেফোকরে। অপলক দৃষ্টিতে খানিক তাকিয়ে থাকে বৃদ্ধ, তারপর বলে, ‘বাইরে নিশ্চয়ই খুব ভিড়, নারে? আমার জন্যই তোদের পুজোটা ঘেঁটে গেল নারে?’ হাসি চেপে জবাব দিই, পাগল নাকি, বছর ঘুরে মা আসছে, আর বৃদ্ধের কন্যার মনে পুলক জাগবে না তা আবার হয় নাকি? যতই প্রতিকূল হোক পরিস্থিতি, ঠিক ফাঁকফোকর খুঁজে আনন্দ করে নেব আমি।  আর এসব কথা উঠছেই বা কেন, এটা যদি উল্টো হত, আমি শুয়ে থাকতাম ঐ দুধসাদা বিছানায়, আর এপারে দাঁড়িয়ে থাকত বৃদ্ধ, তাহলে সে কি একটি বারও ভাবত যে নষ্ট হয়ে গেল তার পুজো? আমি হয়তো অতটা মহান নই, প্রাথমিক ভাবে ভেঙে পড়েছিলাম খানিকটা, ঘেঁটে গিয়েছিলাম পুরোপুরি, তারপর তো দিব্যি সামলে নিয়েছি নিজেকে। সামলাতে তো হতোই। সবাই সামলে নেয়। বৃদ্ধের সাথে দেখা করে,রিশেপসনে গিয়ে বসে থাকব এবার, ডাক্তার আসতে আরো ঘন্টা দেড়েক। তাঁর সাথে কথা বলে, ‘ছেড়ে দিন না ডাক্তারবাবু’র বৃথা অনুরোধ করর রোজকার মত। অতঃপর ডাক্তারের অনুমতি সাপেক্ষে ভিডিও কলে সংযুক্ত করব বৃদ্ধ আর তাঁর পক্ককেশ প্রেয়সীকে। ফাঁক দিয়ে দু একটা কথা বলে নেবে পিসিও। কথা বলতে বিবর্ণ শাড়ির আঁচলে মুছবে ভিজে চোখ। পিছন থেকে নানা মুখ ভঙ্গী করবেন ছিমতী তুত্তুরী। 


তারপর যাব বাজার। আঁকাবাঁকা হস্তাক্ষরে লম্বা ফর্দ পাঠিয়েছেন শ্রীমতী তু্ত্তুরী। সারাদিন ধরে আমার মা যা যা বলেছে,আমার কন্যা তাই বাংলায় লিখে এবং স্ক্যান করে পাঠিয়েছে আমায়। ফেরার পথে ভাবছি একবার ঢুঁ মারব সুবল স্মৃতির মণ্ডপেও। তুলে  নিয়ে যাব আনন্দময়ীর ছবি, গৃহবন্দী জননী আর কন্যার জন্য। আমাদের যে ভালো থাকতেই হবে। আমরা ভালো না থাকলে বাবা ভালো থাকবে কি করে? আর ভালো হবেই বা কি করে?

No comments:

Post a Comment