সত্তরের দশকের অন্তিম পর্ব। ভিয়েতনামের যুদ্ধ সদ্য শেষ হয়েছে, কোন মতে মুখ বাঁচিয়ে (নাকি লুকিয়ে) পালিয় আসতে বাধ্য হয়েছে সুপার পাওয়ার আমেরিকা। এক দাড়িগোঁফ না গজানো পিছিয়ে পড়া দেশের হাতে নাস্তানাবুদ হবার মাসুল গুণছে আঙ্কেল স্যাম, টালমাটাল অবস্থা দেশ জুড়ে, প্রথাসিদ্ধ রাজনীতিতে নেমেছে ধ্বস। নেতৃবর্গ দিশাহারা। দেশের হয়ে লড়াই করতে যাওয়া বীর সেনানীদের দেশে ফেরা মাত্রই সসম্মানে বিতাড়ন করা হচ্ছে, ভবিষ্যতের কোন রকম আর্থিক সুবন্দোবস্ত ছাড়াই।
২৬বছরের ট্রেভিস বিকল এমনি একজন প্রাক্তন নৌসেনা। আপাততঃ কাঠ বেকার। শুধু যে বেকার তাই না, ভয়ানক রকমের মানসিক অবসাদগ্রস্ত ও বটে। নিদ্রাহীন অবস্থায় কেটে যায় রাতের পর রাত। ক্রনিক ইনসমনিয়ার হাত থেকে বাঁচতে এবং জীবিকার তাগিদে ট্রেভিস ট্যাক্সি চালাতে শুরু করে। রাতের পর রাত জেগে শহরের বিভিন্ন প্রান্তে প্যাসেঞ্জার নিয়ে যায় ট্রেভিস। রোজগারপাতি মন্দ হয় না, সাথে উপরি পাওনা বিচিত্র মানুষজন এবং নানা চিত্তাকর্ষক অভিজ্ঞতা।
সন্ধ্যা ছটা থেকে ভোর ছটা, এমনকি আটটা অবধি ট্যাক্সি চালিয়েও ক্লান্ত হয় না ট্রেভিস। ঘুম কিছুতেই আসে না। নিজের দৈনন্দিন অভিজ্ঞতা তথা দুঃসহ একাতীত্বকে কাগজে কলমে লিপিবদ্ধ করতে থাকে ট্রেভিস। রাতের নিউইয়র্ক তাকে আরো হতাশ করে তুলতে থাকে প্রত্যহ। জঘন্য নোংরা পথঘাট, উপচে পড়া নর্দমা, প্রকাশ্যে নারীদেহের বিকিকিনি হতাশ থেকে হতাশতর করে তুলতে থাকে ট্রেভিসকে। নিজের ভিতর এক লাভা উদ্গিরণকারী আগ্নেয়গিরির অস্তিত্ব টের পেতে থাকে ট্রেভিস। শুধু বেরিয়ে আসার উৎসমুখ খুঁজে পায় না সেই লাভা।
এমন সময় ট্রেভিসের সাথে আলাপ হয় জনৈক বেটসীর। বেটসী চোখ ধাঁধানো রূপসী।রাষ্ট্রপতি পদাভিলাষী সেনেটর চার্লস প্যালানটাইনের প্রচারক টিমের গুরুত্বপূর্ণ সদস্য লাস্যময়ী বেটসী।সামাজিক ভাবে দুজনের অবস্থানগত পার্থক্য দুই মেরুসম হলেও প্রাথমিক ভাবে একে অপরের প্রতি রীতিমত আকৃষ্ট বোধ করে দুজনে। কিন্তু গোল বাঁধায় অনভিজ্ঞ ট্রেভিস। প্রথম ডেটেই সিনেমা দেখানোর জন্য বেটসীকে নিয়ে যায় এক পর্ণো থিয়েটারে। ফলশ্রুতি সর্বোত ভাবে ট্রেভিসের সংস্রব বর্জন করে বেটসী।
ট্রেভিসের শত ক্ষমাপ্রার্থনাও বেটসীর হৃদয় গলাতে ব্যর্থ হয়। নিঃসঙ্গ ট্রেভিস আরো একা হয়ে পড়ে। সাময়িক ভাবে ট্রেভিসের সব ক্রোধ সব ক্ষোভ পুঞ্জীভূত হয় সেনেটর চার্লস প্যালানটাইনের ওপর,যার রাষ্ট্রপতি পদের দাবী প্রচারে মূখ্য ভূমিকা নিয়েছে লাস্যময়ী বেটসি। ট্যাক্সি চালিয়ে জমানো অর্থে একাধিক বন্দুক কেনে ট্রেভিস, নিয়মিত শরীরচর্চার মাধ্যমে প্রতিনিয়ত নিজেকে প্রস্তুত করতে থাকে জীবনে চরম পরিণতির জন্য। সেনেটর প্যালানটাইন হত্যাই আপাততঃ মূখ্য এবং একমাত্র লক্ষ্য ট্রেভিসের। এমন সময় একটি ঘটনা ঘটে, একরাতে এক কিশোরী বারাঙ্গনা জবরদস্তি উঠে আসে ট্রেভিসের ট্যাক্সিতে এবং করজোড়ে অনুরোধ করে তাকে এই নরক থেকে উদ্ধার করার জন্য, থতমত খেয়ে যায় ট্রেভিস, ট্যাক্সি চালু করার আগেই একজন দালাল এসে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে যায় মেয়েটিকে, বদলে রেখে যায় এক দলামোচড়া কুড়ি ডলারের নোট।
সেই নোটটা খরচ করে না ট্রেভিস, রেখে দেয় যত্ন করে, একদিন সে ঐ অসহায় মেয়েটিকে উদ্ধার করবে এবং নোটটি ছুঁড়ে মারবে ঐ দালালের মুখে এই আশায়। অতঃপর কি হয়? সত্যিই কি সেনেটরকে মারতে সক্ষম হয় ট্রেভিস? সাড়ে বারো বছরের বাচ্ছা দেহপসারিনীকে কি উদ্ধার করতে সমর্থ হয়? বেটসীর কি হয়? জানতে হলে অনুগ্রহ করে দেখুন ট্যাক্সি ড্রাইভার। যেখানে ট্যাক্সি ড্রাইভার ট্রেভিস রবার্ট ডি নিরো স্বয়ং। আর বছর বারোর দেহ পসারিনীর চরিত্রে জোডি ফস্টার। পরিচালক মার্টিন স্করসিজের অন্যতম বিখ্যাত সিনেমা ট্যাক্সি ড্রাইভার (১৯৭৬)। অসংখ্য পুরষ্কারপ্রাপ্ত, চার চারখানা অস্কার নমিনেশন পায়,যদিও শেষপর্যন্ত একটাও জেতেনি।কিন্তু তাতে কি?পৃথিবীর সর্বকালের ১০০টা সেরা সিনেমার মধ্যে এই স্থান ৩১। ঐ যে ইংরাজিতে বলে না মাস্ট ওয়াচ মুভি।
No comments:
Post a Comment