Sunday 14 November 2021

অনির ডাইরি, ১১ই সেপ্টেম্বর, ২০২১

 

শৌভিকের জন্মদিনের ডাইরিটা আর লেখা হয়ে ওঠেনি। কতকিছুই তো হয় না। জীবনের সবথেকে নরম মূহূর্তগুলো, সবথেকে তেঁতো- বিস্বাদ, সবথেকে সাদামাটা, সবথেকে রোমাঞ্চকর, সবথেকে পরিপূর্ণ, টলটলে, মনখারাপি কত মুহূর্তই যে থেকে যায় অধরা- 


অথচ কি প্রচণ্ড খেটেছিলাম দিনটার জন্য, প্রিয়জনেদের মাঝে সাজিয়েগুছিয়ে তার সামনে বেড়ে দেব কিছু সুখাদ্য, তারই জন্য পাগলের মত দৌড়েছিলাম উদয়াস্ত। কিছুই তো দাবী করে না লোকটা, বিগত একযুগে সামান্যতম যাতনাও দেয়নি, বরং যখনই রান্না করতে চেয়েছি থামিয়ে দিয়েছে টেনে। থাক না। সিদ্ধ ভাত, এমনকি বাসি রুটিও খেয়ে নিয়েছে মুখটি বুজে।  এবারেও হয়নি তার ব্যতিক্রম, ফাটা রেকর্ডের মত বাজিয়েই গেছে, কি দরকার এত কষ্ট করে, খাবার কিছু আনিয়ে নিলেই তো মিটে যায়।  


মিটে তো যায়,শুধু মন যদি মানত-। এবছর শৌভিকের জন্মদিনটা পড়েছিল শনিবার, অন্যদিনে পড়লে করা হত না কিছুই।  শনিবার বলেই আশায় বেঁধেছিলাম হৃদয়, মাসে তো একবার বাড়ি ফেরে আমার বর, মাননীয় জেলাশাসক নিশ্চয়ই এ হপ্তায় বাড়ি ফিরতে বাধা দেবেন না। 


সন্ধ্যা গড়িয়ে যখন বাড়ি ফিরল আমার বর, যোগাড় যন্ত্র প্রায় শেষ। গ্যাসের ঢিমে আঁচ ফুটছে লালচে হয়ে আসা পায়েস। চাপচাপ পায়েস বড় ভালোবাসে এরা বাপ আর মেয়ে। আসলে ভালোবাসে গোটা ভট্টাচার্য পরিবারই।  পায়েসে কাজু কিশমিস নিছক ঝঞ্জাল মনে করে এরা। তাই ঢিমে আঁচে ঘন হয়ে আসা দুধে একমুঠো ভিজে গোবিন্দভোগ চাল আর একচামচ ঘি দিয়ে রাঁধি পায়েস। চাল সিদ্ধ হয়ে এলে শুধু মেশে চিনি। অপর গ্যাসে ফুটছে টমেটো,আমসত্ত্ব আর খেজুরের চাটনি। ফ্রিজে ম্যারিনেট করা আছে রেজালার মুর্গি আর বিরিয়ানির খাসি। কাঁচের পাত্রে পেঁয়াজ- আদা-রসুন-কাঁচালঙ্কা-ধনেপাতা আর পুদিনাপাতার প্রলেপ মেখে ঘুমাচ্ছে ভেটকির ফিলে। 


রান্নার আলমারি ঠাসা বাসমতী চাল,মাখানার প্যাকেট, কাশ্মীরি লঙ্কা, চাটমশলা, সামরিচ গুড়ো, মিঠা আতর, কসুরি মেথি ইত্যাদি বিজাতীয় মশলায়। কাক ভোরে ঘুম থেকে উঠে অন্তত বার পাঁচেক বাজারে গেছি, বার দুয়েক টাকা তুলেছি। মিথ্যে নয় মশাই। আমি টাকা তোলার ব্যাপারে বেশ কিপটে আর ইয়ে বাজারদর সম্পর্কে একেবারে অগা। সব বাজারদোকান যে শৌভিক করত-।  


দোকানবাজার সেরে,স্নান সেরে দৌড়েছি মেয়ের স্কুলে রেজাল্ট আনতে। এক বস্তা নম্বর নিয়ে বাড়ি ফিরেই দৌড়েছি সিটি সেন্টার বরের জন্মদিনের উপহার কিনতে। সামনেই পুজো, পুজোর উপহার স্বরূপ কিছু নগদ পেয়েছি বাবার থেকে, কি আর বলব নিজের বাপের কথা, টাকাপয়সা দিয়ে আমায় একফোঁটা বিশ্বাস করে না গো। বৃদ্ধ-বৃদ্ধা পড়েই আছে আমার পিছনে, ‘তুত্তুরী আর শৌভিকেরটা কিনে আন, আমরা দেখে যাই। শেষে- ’। বাকিটা অনুক্ত থাকলেও বুঝতে বাকি থাকে না। শেষে যদি অন্য খাতে উড়িয়ে দিই আমি। 


 এক সপ্তাহের জন্য এসেছিল আমার বাড়ি। আসেনি, মোটামুটি আধহাত নাক খৎ দিয়ে নিয়ে এসেছিলাম কটাদিন হাওয়া বদলের জন্য। আজ জামাই আসার আগেই তেনারা ফিরে যাবেন, দ্বিপ্রাহরিক আহারের পর রেখে আসতে যাব সেই আমিই, তার আগেই কিনে আনতে হবে জামাতার জামা। বেলা একটা নাগাদ বরের জন্মদিন আর পূজার জামাকাপড় কিনে বাড়ি ফিরে, চাট্টি নাকেমুখে গুঁজে বৃদ্ধ-বৃদ্ধা আর লটবহর নিয়ে দৌড়েছি হাওড়া। তাঁদের চাটুজ্জে বাড়িতে নামিয়ে, প্রায় সন্ধ্যে নামার মুখে বাড়ি ঢুকে মুখ হাত পা ধুয়ে শুরু করেছি রান্না। 


ঘড়ি বলে রাত আটটা। টং করে বেজে ওঠা দরজা ঘন্টি। আমি খুলব বলে যুগলে দৌড়ে আসা মা মেয়ের প্রতিদ্বন্দ্বিতা, তুত্তুরীকে কোঁৎকা মেরে দরজা খোলা, চৌকাঠের ওপারে মুখ কালো করে দাঁড়িয়ে থাকা আমার বর। বাম হাতের ফোনটা বোঝাচ্ছে, সদ্য কেটেছে কলটা। দীর্ঘ অদর্শনের পর প্রিয় সম্ভাষণ ভেসে এল,ভীষণ চেনা, সহস্রবার চাখা ওষ্ঠাধর থেকে-‘ আমায় বোধহয় এখুনি ফিরে যেতে হবে-। ’ 


মুখ কালো করে কোথায় যেন সেঁদিয়ে গেল তুত্তুরী। উদ্গত কান্না চেপে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে চেয়ারে বসে আছি আমি। পোশাক না বদলে একের পর এক ফোন করে চলেছে শৌভিক। কোথায় যেন লেগেছে মস্ত গোলমাল। কাল জমায়েত হবে কয়েকহাজার লোক। বিঘ্ন ঘটবে আইন শৃঙ্খলায়। আমার অবস্থা দেখে, ভিজে পরাজিত সুরে কাকে যেন বলছে আমার বর, ‘আসলে একমাস পর বাড়ি ফিরলাম তো। কাল আবার আমার জন্মদিন। ’। জানি আমার বরের জন্মদিন নিয়ে মাথাব্যথা নেই বিন্দুবিসর্গও। যাবতীয় মাথাব্যথা শুধু আমার জন্য। আমার ঘেমো,হলুদের ছোপ লাগা, আঁশটে গন্ধওয়ালা হাতটা ধরা একহাতে, আর অপর হাতে ফোন। 


ঐ ভাবেই পাক্কা চল্লিশ পঁয়তাল্লিশ মিনিট সালিশি করা। কখনও কাউকে ধমকানো, তো কখনও কাউকে, বাহবা দেওয়া। সবার শেষে দুই অনুজপ্রতিম সহকর্মীর আশ্বাস বাণী,‘এত চিন্তা করছেন কেন স্যার।  আমি/ আমরা তো আছি।’ তবুও উৎকণ্ঠা চেপে কাটানো রাত। ঘুমের ঘোরেও উৎকর্ণ দুই জোড়া কান। এই বুঝি এল কোন অবাঞ্ছিত সংবাদ। ভোর হয়।  বেলা গড়ায়। শুভেচ্ছা বার্তা উপচে পড়ে শৌভিকের মোবাইল, ফেসবুক, হোয়াটস্অ্যাপে। কারা কারা যেন ফোনও করে বসে। আমাদের উমারাণী উঁকিঝুঁকি মারে, কি রাঁধছ দিদিভাই। বলোই না।  এসে যায় তাঁর মনের মত ক্রিম ছাড়া জন্মদিনের কেক। সদর থেকে ডেলিভারি আনতে আনতে আমার মুণ্ড চটকান তিনি, ‘আমার জন্মদিনের কেক আনতেও আমায় পাঠালি কেন?’ রান্নাঘর থেকে ভেসে আসে বিরিয়ানির সৌরভ। রেজালায় মেশে গোলাপ আর কেওড়াও জল। স্পেশাল ব্রেড ক্রাম্বের বিকিনি পরে উত্তপ্ত তেলে স্নান করতে নামেন ফিশফ্রাইয়ের দল। বেকিং পাউডার আর খাবার সোডার কল্যাণে দই দিয়ে মেখে রাখা সাদা ময়দার লেচি, গ্যাসের আগুনে ফুলে ফেঁপে তৈরি হয় নান।  আমার অন্নপ্রাশন উপলক্ষে আমার দিদিমার পাঠানো আশির্বাদী খাগড়ার কাঁসার থালা বাটি গ্লাসে একে একে বেড়েদি তাকে। জীবনের সব রঙ শুধুই যাকে ঘিরে।

No comments:

Post a Comment