কোন কোন দিন আমায় রান্নায় পায়। মেয়ের গোল্লায় যেতে বসা পড়াশোনা (সৌজন্য শৌভিকের বদলী, পর্যায়ক্রমে বাবা এবং মায়ের অসুস্থতা তথা হাসপাতালবাস এবং পরিশেষে আমার বদলী), পাট করে না তোলা কাচা জামাকাপড়ের পাহাড়, ঘরের কোণে জমে ওঠা ঝুল আর তাতে দোল খাওয়া শ্যামা পোকার দঙ্গল (কি পোকা এখানে বাপ রে বাপ। গরমে এই মোটকা লাল পিঁপড়ের গুষ্টি জ্বালিয়ে মেরেছিল আর এখন পঙ্গপালের ঝাঁকের মত গোছা গোছা পোকার দল), লুকিয়ে চুরিয়ে পাওয়া নিভৃত দাম্পত্য সব ছেড়ে সেদিন আমি শুধু রান্নাই করে যাই। যেমন ধরুন আজ, দিনটা শুরুই করেছিলাম ক্যারামেল পুডিং দিয়ে।
বীরসা মুণ্ডার জন্মদিন উপলক্ষে পাওয়া আলগা ছুটির সকাল, মাখন পাঁউরুটি( আমার ভাগে শুধু সেঁকা পাউরুটি আর আলু পটলের তরকারী, ইয়ে করছি কি না), ডিমের পোচ( আমার ভাগে শুধু সাদা, বললাম না ইয়ে করছি, আমার ভাগের কুসুমখানা তাই শ্রীমতী তুত্তুরীই উদরস্থ করলেন, তাও আমায় দেখিয়ে দেখিয়ে) আর কেলে কফি(আমার জন্য মিষ্টি ছাড়া, আঃ বললাম না আমি ইয়ে করছি) দিয়ে সারা সাহেবী প্রাতরাশ অন্তে ঠিক করলাম পুডিংটা বানিয়েই ফেলি। কি যে লোভ দেখিয়ে রেখেছে আমার তুতো ভাই অয়ন, তুত্তুরী থেকে থেকেই আব্দার করছে,‘ বড়মামার মত পুডিং বানাও না মা, প্লিজ। ’
বেলা দশটা থেকে তুত্তুরীর পরীক্ষা। তাঁকে নাকি বেস্ট অব লাক জানাতেই হবে, নিদেন পক্ষে ট্যাঁশ মার্কা ইংরেজিতে গুড লাক। নাহলে পরীক্ষা খারাপ হবেই এবং খারাপ পরীক্ষার জন্য দায়ী থাকব আমি। ঐসব আদিখ্যেতা মিটিয়ে মন দিলাম ক্যারামেল বানানোতে, তিনচামচ চিনিতে দুচামচ জল মিশিয়ে আগুনে বসিয়ে নেড়েই চলতে হয়। না হলেই চিনি পুড়ে কাঠ কয়লা হয়ে যাবে, আর তার গন্ধে বাড়ির মানুষ তো বটেই ভূতও পালাবে। সাদা চিনি গলে চিনির রস হল, চিনির রস পুড়ে লাল হয়ে তরল সোনা থুড়ি ক্যারামেল। অল্প মাখন মাখিয়ে রাখা স্টীলের বাটিতে টপটপ করে ঝরে পড়ল আগুন গরম ক্যারামেল। তার সঙ্গে যোগ হল আগে থেকে ফেটিয়ে রাখা ডিম আর দুধ-চিনির মিশ্রন।
পুডিং খেতে সবথেকে বেশি ভালোবাসে আমার বাবা। তবে ওসব সাহেবী ক্যারামেল-ট্যারামেল নয়,ঘন করে গোলা আমূল গুঁড়ো দুধে পরিমাণ মত(পড়ুন বেশ অনেকটা) চিনি, আর ডিমের মিশ্রণ। সাথে উপরি হিসেবে দুফোঁটা ভ্যানিলার তড়কা। এখানে ভ্যানিলা এসেন্স কোথায় পাই, তিনি তো দিব্য নাক ডাকিয়ে ঘুমোচ্ছেন আমাদের মহানগরের আবাসনে। তাঁকে ছাড়াই পুডিং চড়ল চুলোয়। নির্দিষ্ট সময়ে নামাতে যাব, ঠিক তার আগের মুহূর্তে কন্যার ফরমায়েশ, তাঁর পরীক্ষার খাতা খানা স্ক্যান করে দিতে হবে মাকে। ইচ্ছে হল বলি, অন্য দিন কি করিস? গিলে নিলুম। মায়েদের এসব প্রশ্ন করতে নেই।
সাদাকালো নয় রঙিন স্ক্যান ইত্যাদি হাজার খানেক ফরমায়েশ নিয়ে বেশ একচোট ঝাড়পিঠ হল আমাদের মা-মেয়ের মধ্যে। শৌভিক যথারীতি সমস্ত অশান্তি থেকে নিরাপদ দূরত্বে বসে বিদ্যাদেবীর আরাধনা রত। বিদ্যাসাগর হয়েই ছাড়বে। সিরিয়াসলি মাইরি পরের জন্মে আমি বাবা হতে চাই। এদিকে তুত্তরী পরীক্ষার খাতা দেখে বেশ ভড়কে যাওয়া আমি। বিশ্বাস করবেন কি না জানি না, সত্যি বলছি হাওড়া পুরসভার ভ্যাট ও এর থেকে পরিচ্ছন্ন হয়। নার্ভাস হয়ে গরম পুডিং এর বাটিটাই হাত ফস্কে সোজা পাপোষের ওপর।
মেয়ের মুখের খাবার নষ্ট করেছি বলে এমনিতেই মরমে মরে ছিলাম। তারওপর আবার পরীক্ষার খাতাকে পৌরসভার ভ্যাটের সাথে তুলনা করেছি,ফলত দ্বিপ্রাহরিক ভোজনটা মনে হচ্ছিল যেন এজলাসে সারছি। ঝুড়ি ঝুড়ি নালিশ জমা পড়ল আমার নামে। বাদী ছিমতী তুত্তুরী আর বিচারক তথা জুরি এবং ফাঁসুড়ে আমার বর। তিনি তো পারলে সব কথাতেই আমায় ‘তিন মাসের জেল আর সাত দিনের ফাঁসি’ দেন।
আমি নাকি ভয়ানক মারকুটে এবং দুর্মুখ জননী। ইয়ে দুর্মুখ তো অবশ্যই আর মারকুটেও যে আমি একটু আছি, তাতে কোন দ্বিমত নেই। ছোটবেলায় খোদ এত ধোলাই খেয়েছি, পৃথিবী ছাড়ার আগে, সেগুলো ফেরৎ দিতে হবে তো। কি দিয়ে না ঠেঙিয়েছে মা- ঠাকুরদাদার বিলিতি কাঠের রুলার, যাবতীয় স্কেল, খুন্তি-হাতা, হাতপাখার বাঁট, আরো কি কি যেন আজ আর মনে পড়ে না। যা হাতের কাছে পেত, তাই দিয়েই মা হাত খুলে ঠেঙিয়েছিল,তাই না এমন শক্তপোক্ত হয়েছি। নাহলে ছিমতী তুত্তুরীর মত লদন্দ(পড়ুন গোবর গণেশ) হতাম।
বলেই বুঝতে পারলাম, কেস জণ্ডিস করলাম। এ অপরাধ ক্ষমার অযোগ্য। বাপবেটিতে পত্রপাঠ বাক্যালাপ বন্ধ করল আমার সাথে। তাতে যে আমি খুব একটা মুষড়ে পড়লাম তা নয়, বরং রীতিমত শান্ত ছিল পরিবেশ। ওরা যখন আমার সঙ্গ বর্জনই করল, তখন ভাবলাম ভালোমন্দ কিছু রান্নাই করি বরং। সুগন্ধ ছাড়লে এরা বাপবেটি এমনিতেই আসবে হ্যাংলা বেড়ালের মত রান্নাঘরের চক্কর কাটতে। তখন বলব, ভাব করবি কি না বল? নাহলে খাদ্যকৃচ্ছতার গুষ্টির ষষ্ঠী পুজো করে সব আমি একাই খাব।
ছবিতে আমার বর এবং মেয়ের মনপসন্দ বাসন্তী পোলাও, চিকেন রেজালা আর ক্যারামেল পুডিং যা আবার নতুন করে বানিয়েছিলাম। পড়ে যাওয়া পুডিংএর অবশিষ্টাংশটুকুর কি হল, প্লিজ এই সব প্রশ্ন করে লজ্জা দেবেন না। আমি বলে ইয়ে করছি- আজ নিয়ে পাক্কা ছদিন। হ্যাঁ গো একটু রোগা কি হয়েছি, প্রশ্ন করলেই হাসতে হাসতে বিষম খায় এরা বাপ আর মেয়ে।
No comments:
Post a Comment