এমন রৌদ্রকরোজ্জ্বল ঝলমলে দিন, প্রভাতী বাতাসে বাসন্তী ফুলেল সুবাসের সাথে মিঠে হিমেল শিরশিরানি, তবু মন ঘিরেছে প্রগাঢ় বিষাদ। আর পাঁচজন শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষের মতই, রাজধানীর জন্য ভারাক্রান্ত এ হৃদয়। গোদের ওপর বিষফোঁড়া, তারওপর দিন কতক আগে, শখ করে সদস্য হয়েছিলাম এক গাছপালার গ্রুপের। বারন্দায় বাগিচা আমার নতুন প্রেম- বাড়িওয়ালার ক্ষুদ্র ফ্ল্যাটের পুঁচকে বারন্দায় ঠাসাঠাসি করে আসর জমিয়েছে গোলাপ-গাঁদা-পিটুনিয়া-বেলি-গন্ধরাজ। ফাঁকে ফোকরে ক্যাকটাস-ঘৃতকুমারী আর পয়সাপাতা। সাধের পাতাবাহার দুটি আপাততঃ নির্বাসিত কমন প্যাসেজে। দিন রাত প্রাণ চায়, আরো-আরো- আরো সবুজ হোক এ ধরা। এদিকে বাড়িওয়ালা ভয় দেখিয়ে রেখেছে আর একটিও যদি গাছ কিনি, উনি সটান কিনে আনবেন একটি ছাগল। সেদিন বললাম, ঘৃতকুমারী গাছটাকে একটু রোদে দিতে, জবাব পেলাম, “বারন্দা গলিয়ে নীচে ফেলে দিলে আরও ভালো রোদ পেতে পারে। দেবো কি?”
অগত্যা, দেখি, পরের সাজানো বাগানই দেখি, আর ভাবি-“তুমি অন্য কারো সঙ্গে বাঁধো ঘর। ”তো এহেন ভার্চুয়াল সবুজ স্বর্গে, দেখি কে যেন পোস্টিয়েছেন, এক খ্যাতনামা রাজনৈতিক ব্যক্তির ছবি। সাথে জ্বালাময়ী আবেগময় বক্তব্য, “হে হিন্দুদের ত্রাতা,মহাহিন্দু, আপামর বিশ্ব, বাঁশঝাড় আর জলবিছুটি নিয়ে তোমার পিছনে পড়েছে বটে, তবে নো চিন্তা। আমরা, তোমার ভক্তবৃন্দ আছি তো। থাকব তব” ইয়ে মানে, পিছনে আর কি। প্রথম চোটে বেশ বিরক্ত লেগেছিল মাইরি, রাজনৈতিক স্তাবকতার জন্য তো গুচ্ছ গুচ্ছ গ্রুপ- পেজ আছে। আছে নিজের দেওয়ালও। তাহলে এই গ্রুপে কেন বাপু?দিনান্তে বা দিনপ্রভাতে এইটুকুই তো অম্লজান পাই, এই ভার্চুয়াল জগৎ থেকে। লিখতে গিয়ে দেখি, ইতিমধ্যেই বেশ কয়েকজন লিখে ফেলেছেন, একই কথা। হয়তো আরো অনেক সুচারু ভাষায়- অনেকে ঘোষণা করেছেন গ্রুপ ছাড়ারও কথা। হয়েছে হাল্কা বাদানুবাদ- পরিণামে যে কদর্য ভাষায় আক্রান্ত হয়েছেন তাঁরা, তার কিছুটা প্রত্যক্ষ ভাবে গায়ে লাগে বৈকি। এত রোষ,দ্বেষ, অবিশ্বাস, ঘৃণা, প্রতিহিংসা এসব কি গৃহযুদ্ধের অশনিসঙ্কেত?
অশক্ত অসুস্থ মন চায় বসে থাকি ঘরের কোণায়, আঁকড়ে থাকি আপনজনদের। বন্ধ রাখি, জানলা-দরজা, চোখ আর কান। বন্ধ রাখি বেতার-দূরদর্শন আর মুঠো ফোন। কিন্তু পেট শুনলে তো? তার যে বড় ক্ষুধা। পেটের ধান্ধায় বেরোতেই হয় রাস্তায়। পথে ঠকঠক করে ঢোকে সুকন্যার মেসেজ- সপুত্র ফিরে যাচ্ছে কর্মস্থলে। হাওড়া স্টেশনে হচ্ছে ঘোষণা, “কিপ আ ওয়াচ অন ইয়োর লাগেজ-”। শোনা মাত্রই উটো বাবু, যাঁর ভালো নাম অর্ক, বলছে, “মা, মা,শিগ্গির। তোমার ঘড়িটা খুলে ব্যাগের ওপর রাখো। ” দিনের প্রথম হাসিতে, হাল্কা করে, হাল্কা হয় মনখারাপের বাদল।
জুতো পরছি, ছুট্টে এসে জড়িয়ে ধরল তুত্তুরী। আসন্ন বার্ষিক পরীক্ষার প্রস্তুতি নিয়ে গতরাত থেকে প্রবল নিম্নচাপের আবহ বাড়িতে। একজন পরীক্ষায় রসগোল্লা-পান্তুয়া পাবেই, আরেকজন পেতে দেবে না। এই নিয়েই কলহ অশান্তি আর কি। সকাল থেকেও স্বল্পই ছিল মা-মেয়ের বার্তালাপ। মা বেরিয়ে যাওয়ার আনন্দ, তাই বোধহয় আজ তুরীয়। হাসি হাসি মুখে গল্প শুরু, “জানো মা, কাল একটা কাণ্ড ঘটেছে। আমাদের যে রুমে ক্লাশ হয়, সকালে ঐ ঘরে নার্সারি বসে। ওদের একটা বিচ্ছু ছেলেকে কাল ওদের মিস বাড়ি যেতে দেয়নি। আমরা ক্লাশে গিয়ে দেখি,একটা কুতুপুতু বাচ্ছা ছেলে রঙীন জামা পরে বসে বসে ঢুলছে। ওর কাল জন্মদিনও ছিল কি না। মৌমিতা ম্যাম যেই ঢুকেছেন, কি ভয় যে পেল ছেলেটা। মনে হল মাটিতে মিশে যাবে। ম্যাম বললেন, ‘একটা ইকোয়শন যদি করতে পার, আই’ল লেট উ লিভ। ’ ঋতমের ওপর ভার পড়ল ইকোয়শন দেবার। ঋতম লিখল ৭০†৪০=? ম্যাম বললেন, ‘লুক এট হিম। হি ইজ আ বেইবি। গিভ হিম সামথিং সিম্পল।’ আমায় ডাকলেন, মানে আমি হাত তুলেছিলাম তাই-। আমি দিলাম, ৭†৭=? ও তো তাও পারছিল না। বোর্ডের সামনে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই ঢুলছিল। তারপর গেল চকটা খেতে। আমি তড়িঘড়ি আঙুল নেড়ে দেখালাম ১০ আর ৪। ও কি করল জানো? ও খানিক মাথা চুলকে, বোর্ডে কয়েকটা আঙুলের ছবি এঁকে দিল-”। আর ম্যাম কি করল জানো? ম্যাম বলল, “ইয়েস। ইয়েস। রাইট। রাইট। গো হোম চাইল্ড-”। প্রবল হাসছিল তুত্তুরী। গতরাতের বিরক্তি আর আজ সকালের বিষাদ ভুলে হাসছিলাম আমিও। নাঃ রক্তবীজের উত্তরপুরুষরা যেমন আছে, তেমনি উটো আর তুত্তুরীও তো আছে। আছে তাদের সাঙ্গোপাঙ্গোরা। এরাই তো আমার সবুজ। এত সোজা বোধহয় হবে না খেলা এবং জেতা। চলো দেখাই যাক না-
পুনশ্চঃ ভেবেছিলাম একটা স্ক্রিনশট দেবো। বেলা গড়ানোর সাথে সাথে মনে হল, একজন অবয়বহীন ফেক অ্যাকাউন্টওয়ালীর কলুষিত কথাবার্তা, অনির দেওয়ালে থাকার যোগ্যতা নেই। কাজেই থাক।
What ever I like...what ever I feel.... form movies to books... to music... to food...everything from my point of view.
Wednesday, 4 March 2020
অনির ডাইরি, ২৭শে ফেব্রুয়ারি, ২০২০
Subscribe to:
Post Comments (Atom)
No comments:
Post a Comment