Monday 24 February 2020

অনির ডাইরি, ২৪শে ফেব্রুয়ারি, ২০২০

“মেঘ পিওনের ব্যাগের ভিতর মন খারাপের বস্তা”- সকালটাই কেমন যেন ভিজে ভিজে। টলটলিয়ে উঠছে আকাশের আঁখি, বড় অগছাল ঘরদুয়ার,থরে থরে পাট করে রাখা, সদ্য কাচা পশমী বস্ত্র, আলমারি খুললেই ওডোনীল আর ন্যাপথলিনের চেনা চেনা গন্ধে উঁকি মারে শৈশব, আলমারির লুকানো কোণা থেকে উঁকি মারা, লালচে জাব্দা পিচবোর্ডের বাক্স থেকে ভেসে আসে মনকেমনিয়া জুঁই ফুলের সুবাস। লাল ভেলভেটের অ্যালবামের পাতার পর পাতা জুড়ে, শুধুই সুখস্মৃতি। নতুন শাড়িতে আড়ষ্ঠ সদ্য শাঁখাপলা পরা নতুন বউ, টোপর পরা ছোকরা বরের কান এঁটো করা একগাল হাসি, কপাট বক্ষে লেপটে থাকা গায়ে হলুদের রঙ- তত্ত্বের ট্রেতে শোওয়ানো ঘোমটা দেওয়া এত্ত বড় কাতলার নাকে নথ- আঙুলের ফাঁক গলে ঝরে পড়া জলের মতই হারিয়ে যাচ্ছে সময়- রেখে যাচ্ছে শুধু একরাশ মনখারাপ।
“হেলো, আপনি সিএমও তে ফোন করেছিলেন-?” “কি? ছিএমো? কোথা থেকে বলছেন?” জিভ কেটে আবার বলি, “দিদিকে বলো’তে ফোন করেছিলেন?” ইতি তৃতীয় ব্যক্তি, বড় সাহেব লিস্ট পাঠিয়েছেন নব্বই জনের, ভাগ করে ফোন করছি আমরা, জানতে চাইছি কি সমস্যা, শ্রমদপ্তরের বিরুদ্ধে কি অভিযোগ। এর আগের দুই জন মোটেই খুশি হননি, আমাকে পেয়ে। ওনারা “দিদি”কে চান, কোন দিদি বলে দিতে হবে না আশা করি, সমস্যা অবশ্য তেমন গুরুতর ছিল না, একটি ছিল নিছক মা-মেয়ের চুলোচুলি, তাতে শ্রম দপ্তর কি করবে বুঝতে পারলাম না যদিও। দ্বিতীয় ব্যক্তি জানেনই না, কে নালিশ করেছে দিদির কাছে। ওনার কোন অভিযোগ নেই। তিন নম্বরকে ধরতে যাবার আগেই বাইরে থেকে আমাদের সঞ্চিতার প্রবল চিৎকার। জানতাম এটাই হবে।আমি নিজেও যথেষ্ট ভয়ে ভয়ে ফোন করছি,  মোবাইলে অচেনা মহিলার গলা পেলেই বাঙালী (অবাঙালী ও) পুরুষের হৃদয়ে প্রেমের সুড়সুড়ি লাগে। দৌড়ে এসে ফোনটা কেড়ে নিয়ে পিতৃসুল্ভ স্নেহে বোঝাতে লাগলেন আমাদের বর্মণ সাহেব। “এমন কি করতে আছে বাবা?” ডান হাতে- বাঁ হাতে ব্যাট করে চলেছেন ভদ্রলোক, একাই ৫৭ জনকে ফোন করে ফেলেছেন দিনের শেষে, তবে সে তো অনেক পরের কথা।
বেড়ে যায় বেলা, কাজের ফাঁকে ফোকরে আমি যাদের ফোন করি, হয় ফোন বন্ধ। নয় ধরে না। দম নিতে বারন্দায় যাই, ওল্ড কালেক্টরেটের সুবিশাল ঝুল বারন্দা, হাজি মহম্মদ মহসিন সাহেবের আস্তাবল ছিল নাকি, কেউ বা বলে গোরাদের সৈন্য ব্যারাক। আপিসের সামনের চেয়ার দখল করেছে যেন কারা, এক কোঁচর মুড়ি কোলে এক বয়স্ক মানুষ, সামনে দাঁড়িয়ে দুটো ছোট ছোট বাচ্ছা, সামান্য আবডালের প্রচেষ্টা মাত্র, খোসা সমেত শসা আর মুড়ি চিবোচ্ছে তিনজনায়। অপরিসীম সারল্য মাখামাখি বাচ্ছা দুটোর মুখ। ছোটটা হঠাৎ বাড়িয়ে দেয়, আধ খাওয়া কচি শসাটা। “এই” বলে ধমকে ওঠে, দেবু, পিছনের বার কামরায় বসেন বার জন অফিসার, দেবু তাদের সবেধন নীলমণি একটিই মাত্র পিওন। সসম্ভ্রমে উঠে দাঁড়িয়ে বলে, “এরা কোর্টে এসেছে ম্যাডাম। কতক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকবে, বাচ্ছা দুটোকে নিয়ে, তাই আপনাদের চেয়ারে বসতে বলেছি।“
সন্ত্রস্ত হয়ে ওঠে বৃদ্ধ, উঠে দাঁড়াবার চেষ্টা করেন, আশ্বস্ত করতে জানতে চাই, “কোর্টে কেন গো? আর এই বাচ্ছা দুটোকে এনেছেন কেন?” ছোটটা সামান্য প্রশ্রয় পেয়ে এগিয়ে আসে আধ খাওয়া শসা নিয়ে, মাথা নেড়ে জানাই খাব না বাবা, তুই খা। বৃদ্ধের চোখটা বোধহয় সামান্য চকচকিয়ে ওঠে, “এই টুকুন বাচ্ছা, কতদিন হয়ে গেল মাকে ছেড়ে আছে। আজ ওর মাকে কাঠগড়ায় তুলবে, তাই নিয়ে এয়েছি—“ দীর্ঘ অস্বস্তিকর নীরবতার পর, “বাড়িতে তো আর তেমন কেউ নেই--।“ বাচ্ছা দুটোর নিষ্পাপ চোখের দিকের তাকিয়ে প্রশ্ন করতে পারলাম না, কি এমন করেছে ওদের মা। শুনলাম, খুনের দায়ে জেল খাটছে মেয়েটি। মাছ কাটা বটি দিয়ে কুপিয়ে কুপিয়ে খুন করেছে সোয়ামীকে। “বাড়ির অমতে, পালিয়ে গিয়ে  ভাবের বিয়ে। বিয়ের পর জানতে পারে, আগের পক্ষের এক খানি জ্বলজ্যান্ত বউ আর চার-চারটে বাচ্ছা আছে লোকটার। ভাত দেবার ভাতার নয় কিল মারবার গোঁসাই ছিল গো বরটা, দুদুটো ছোট বাচ্ছার পেট ভরানোর জন্য বাজারে মাছ বিক্রি করত মেয়েটা, সেই পয়সার ভাগ নিয়ে মারধর খাওয়া ছিল নৈমিত্তিক ব্যাপার। বাচ্ছাদের মাছ-ভাতের পয়সায় দোজবরে বরের মদ গেলা যেদিন আর সয়নি, আঁশ বটির বাড়ি বসিয়ে দিয়েছে কয়েক ঘা। তারপর সটান রক্তাক্ত বটি নিয়ে হাজির হয়েছে থানায়।“ বৃদ্ধেরই মেয়ে। কোন উকিল বাবু নাকি আশ্বাস দিয়েছে, বেকসুর খালাস করিয়ে আনবে মেয়েটিকে। সেই অনাগত শুভদিনের তাকিয়েই দিন গুনছে বৃদ্ধ বাপ আর দুটি আপাতঃ অনাথ শিশু।
পরের মিটিং এর লোকজন এসে হাজির, ফাঁকা বয়লার সাফ করতে গিয়ে, বের হওয়া গ্যাসে মারা গেছে এক শ্রমিক, তিনজন ধুঁকছে হাসপাতালে। বাইপাসের ধারের অভিজাত হাসপাতাল, প্রতিদিন লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে বিল। ভয়ে কারখানা খুলতে পারছে না মালিক, গুদামে পচছে মাল, ঠিক সময়ে ডেলিভারি দিতে না পারলে, সমূহ লোকসান। মজুরী না পেয়ে ধুঁকছে শ্রমিকরাও—সবার আশা, যদি ত্রিপাক্ষিক বৈঠকে বের হয় কোন সমাধান সূত্র- তৃতীয় পক্ষ আমি। চেম্বারে ঢোকার আগে, বাচ্ছা দুটোকে একটু আদর করে যাই। মেয়েটা বড়, বলি, “মন দিয়ে পড়াশোনা কর।” ছোটটার অক্ষরজ্ঞান হয়নি বোধহয়, আবার বাড়িয়ে দেয় তখন থেকে কামড়ানো শশার টুকরোটা, মনে মনে বলি, “ভালো থাকিস বাবা। মায়ের বাছা, ফিরে পাক মায়ের কোল-“। জীবন বড়ই রুক্ষ। দুদণ্ডের দুঃখবিলাসটুকুই যা সম্বল- তারপর আবার শুরু ইঁদুরদৌড়- সূক্ষ্ম ভূলই যে কখন অজান্তে ছুঁড়ে ফেলে দেয় কয়েক আলোকবর্ষ পিছনে- ভাবতে বসলে অবাক লাগে বৈকি-

No comments:

Post a Comment