মুখ লাল করে ঢুকেছিল নির্মল। সঙ্গী জনৈক প্রৌঢ় আর একটি চ্যাংড়া। প্রৌঢ়র বয়স বছর পঞ্চাশ, দোহারা খেটে খাওয়া চেহারা, হাতে একটি বাজার ব্যাগ, পরম সঙ্কোচে পিছনে লুকানো। চ্যাংড়ার গায়ে বর্ণময় পাঞ্জাবি। ভাবহাব পুরো উঠতি নেতা মাফিক। ছোকরা মুখ খোলার আগেই, নির্মল পরিচয় করিয়ে দিল, “ইনি ইমদাদ হোসেন (সব নাম বদলে দিলাম)। সেই যে ইসমত বিবির কেসটা-”।
কেস। মানে বেনিফিট। পেলে কারো পদধূলি ছাড়ুন, ছায়াও পরে না, এই তুচ্ছ শ্রম দপ্তরে। না পেলেই বাড়ে গোল। ইসমত বিবির কি কেস, প্রশ্ন করতে গিয়েও করলাম না। মনে পড়ে গেল ঝপ করে। আরে ইনি তো আগেও এসেছিলেন। ওণার বিবিজানের অকাল প্রয়াণের পর, প্রাপ্য অনুদানের তদ্বির করতে। নামের গড়বড়ের জন্য, আমাদের পূর্ণ সদিচ্ছা থাকা সত্ত্বেও পোর্টাল কিছুতেই অনুমোদন দেবার অনুমতি দিচ্ছে না। নির্মলই নিয়ে এসেছিল আগেরবার। ইমদাদ বাবু করজোড়ে অনুরোধ করেছিলেন, “টাকাটা পেলে বড় উবগার হয় দিদি। মেয়ের বিয়ে দিতাম-”। সেদিন কত্ত কথা হয়েছিল, “কেন বিয়ে দেবেন? পড়ান।” উনি কপাল চাপড়ে বারবার বলছিলেন, “কাকে পড়াব দিদি? সে তো কলেজে ভর্তি হয়েও গেল না। মাটাও মরে গেল-। বাড়িতে দেখাশোনার কেউ নেই। কেউ নেই দিদি আমার। বড়ছেলেটার চোখে যে কি হয়েছে, ভালো দেখতে পায় না। কত ডাগতার দেখালাম। কলকাতাও নিয়ে গেলাম। কিচ্ছু হল না। মেয়েটারও দেখছি, চোখটা কেমন যেন করছে-। ভয় লাগে দিদি। ” খুব বকেছিলাম সেদিন। মেয়েটার চোখ খারাপ হবার আগেই পরের ঘরে পাঠাতে চাও? যাক শত্রু পরের ঘরে? তারপর? তাদের যদি না পসন্দ হয়? মন উঠে যায়? তখন ও কি করবে সারা জীবন। তারথেকে, নিজের পায়ে দাঁড়াক। নিজের শর্তে বাঁচুক। যাই বলি,একটি কথাই বারবার ঘুরে ফিরে বলছিলেন উনি, “আমার কেউ নেই দিদি। কেউ নেই। বিবিজান নেই, আমার ঘর ফাঁকা-। ”
তারপর অবশ্য কেটে গেছে বেশ কয়েকটা দিন। গতকালও অনুমোদন দেবার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছি। তাই কি নেতা ধরে এনেছেন? কে যে কাকে ধরেছে জানি না। ছোকরার বক্তব্য খুব পরিষ্কার, বিশেষ সম্প্রদায়ভুক্ত বেনিফিশিয়ারি বলেই গা নেই সরকারী দপ্তরের। অমুক কমিশনের গুঁতো না খেলে, হবেও না চাচার কাজটা-।
চাচার কাজ এমনিও হচ্ছে না। হবে কি করে? হোসেন বানান তিন জায়গায় লেখা তিন রকম। পর্যায়ক্রমে Hossain, Hussain এবং Hosen। এই জট কাটাতে হিমশিম খেয়ে যাচ্ছি কদিন ধরে। পর্যায়ক্রমে হেড অফিস- সফ্টওয়ার ডেভেলাপার আর আমাদের অফিস। দিন দুয়েক আগেও ডেভেলাপার টিম বলেছে, আপনি দায়িত্ব নিয়ে লিখে দিন, হোসেন এবং হুসেন একই ব্যক্তি। ইনিই মরহুম বিবিজানের খসম। লিখে দিতে সর্বদা প্রস্তুত। লিখব কিসের উপর ভিত্তি করে? অগত্যা প্রৌঢ়ের কি কি কাগজ আছে, সব দেখতে চেয়েছিলাম আমরা। ক্যাক্যা ছিছি মার্কা কাগজ নয়। মামুলী ভোটার-আধার-ব্যাঙ্কের কাগজ। কাগজ চাওয়ার পরিণামেই এই চাপানউতোর।
এসব ক্ষেত্রে যা করি, যার জন্য আমি রীতিমত সুপ্রসিদ্ধ। নেতামশাইকে সেই অভ্যর্থনাই দিলাম। আমার অফিসে এসে হিঁদু-মোছলমান করা? আজ সকালেই এই কারণে এক সবজান্তা জ্ঞানবৃদ্ধকে দূর দূর করে তাড়িয়েছি। অনবধানতা বশতঃ টাকা সমেত একটি পুরোনো ব্যাগ সেলাই করতে পাঠিয়েছিলাম, অফিস পাড়ার বুড়ো চর্মকারের কাছে। দিন তিনেক ব্যাগটা পড়েছিল সেকশনে। তারপর ধীমান তাকে বগলদাবা করে নিয়ে গিয়ে দিয়ে এসেছে চাচার কাছে। পরের দিন আনতে গিয়ে, চাচার ধমক খেয়েছে। “ক্যা রে? তোদের ম্যাডাম কুছু দেখে না? আপিস চালায় কেমন করে? অ্যাঁ?” ব্যাগের মধ্যে ছেঁড়া খামে মোড়া এক তাড়া একশ টাকার নোট। আর দুটি সাবেকী পাঁচশ আর হাজার টাকার বাতিল নোট। প্রথম মুখদর্শনের পর পেয়েছিল তুত্তুরী। যাঁরা দিয়েছিলেন অনেকেই আজ নেই এই পৃথিবীতে। নোট বন্দীর সময় বুড়ো দাদু আর মামমাম ছোটাছুটি করে জমা করেছিল সব বাতিল নোট। পরম যত্নে তুলে রাখা, তুত্তুরীর পাওয়া টাকার মধ্যেও যে লুকিয়ে ছিল দুইটি নোট, খেয়াল করেনি কেউ। যেদিন জানা গেল, প্রবল দাম্পত্য অশান্তি হল দাদু আর মামমামের। অতঃপর টাকার প্যাকেটটা গছানো হল মামমামের মেয়েকে। তুই যত্ন করে রাখিস।
রেখেছিল তুত্তুরীর মা। ছেঁড়া ব্যাগে। রেখে বেমালুম ভুলে গিয়েছিল। ফেলে যে দেয়নি ব্যাগটাকে, এই তুত্তুরীর সৌভাগ্য। দরজার পিছনে অ-ন-এ-এ-ক দিন কালি ঝুলি মেখে ঝুলত ব্যাগটা। বাড়ির সামনেই বসে চর্মকার, তবুও সারিয়ে উঠতে পারেনি মা। শেষ পর্যন্ত ধীমান মামার ঘাড়ে চেপে চাচার কাছে যাওয়া এবং নোটগুলির পুনরাবিষ্কার। ধীমান যখন শোনাচ্ছিল চাচার গল্প, ঘরে উপস্থিত ছিলেন লোকটি। এসেছিলেন শ্রম আইন সম্পর্কে কয়েকটি প্রশ্ন করতে, টাকা পাবার উত্তেজনায় নাকি চাচার ধমকের উত্তাপে, মিটিংএর মাঝেই হুড়মুড়িয়ে ঢুকে এসেছিল ধীমান। বিনা আমন্ত্রণে নাক গলিয়ে বলে উঠেছিলেন, “লোকটা মুসলমান তো। কিন্তু কি ভালো।” সকাল থেকেই গরম ছিল তুত্তুরীর মায়ের মটকা। টুইটার জুড়ে “দেশ কে গদ্দারো কো-” দেখতে দেখতে জন্মেছিল ধিৎকার- তাহলে কি এমন কেউ নেই, যারা আমাদের মতে বিশ্বাসী? নাকি তারা টুইটারে নেই। পলকে ফেটে পড়েছিলাম লোকটার ওপর। আমার আপিসে হিঁদু মোছলমান করতে এলে কপালে দুঃখ আছে। একই কথা বললাম উঠতি ছাগল দাড়িকে। নেতাগিরি নিজের মহল্লায় দেখাবে। এখানে মস্তানি করতে এসো না বাছাধন।পরের মস্তানি বরদাস্ত হয় না তেমন। ফোটো।
বৃদ্ধকে বসিয়ে জানতে চাইলাম, “হ্যাঁ গো, আপনি একেক জায়গায় একেক নামের বানান লিখেছেন কেন? মুসলিম বেনিফিশিয়ারি হলে, এই সমস্যাটা কিছুটা হয়, কিন্তু আপনার ক্ষেত্রে তো মাত্রাছাড়া। সবাইকে ঘোল খাইয়ে আবার ছাগল দাড়ি ধরে আনা। সসঙ্কোচে জানালেন, “আমি তো ইংরেজি জানি না দিদি। যা নামের বানান, তাই বলি, ওণারা ইংরেজিতে কি লিখে দেয়-”। হোসেন-হুসেনের জাল কাটিয়ে বাড়ি ফিরলাম সেদিন। বারবার অনুরোধ করলাম সফ্টওয়ার টিমকে, প্লিজ করে দিন। নেতামশাই নেতা হয়ত চান- উত্তপ্ত পরিস্থিতির ফায়দা তুলতে। তবে বৃদ্ধের প্রয়োজনটা নিখাদ সত্য। এদিনও চোখ মুছতে মুছতে বললেন, “মেয়েটা কেমনি হয়ে যাচ্ছে দিদি। বিয়ে পাগল এক্কেবারে। ওর খালুর পরিচিত একটি ছেলে, সুরাতে থাকে, পাথর বসানোর কাজ শিখছে, তার সাথে বিয়ের সম্বন্ধ এসেছে। তাকে বিয়ে করার জন্য পাগল পুরো। আমি বড় একা দিদি। সারাদিন মাঠেঘাটে কাজ করি। বাড়িতে আমার কেউ নেই। ছেলেটা চোখে দেখে না ভালো। তাও কলকাতায় একটা কাজ পেয়েছে। মেয়েটাকে দুটো রান্না করে দিতে বলি- তাও করে না। বলে আপনার সংসার আপনি বোঝেন। আমি পারব না। ” বিয়েটাই যেন জীবনের মোক্ষ। ”
গতকাল আবার এসেছিলেন ইমদাদ চাচা। টাকা ঢুকে গেছে। সামনেই মেয়ের বিয়ের দাওয়াত। বিয়ে নাকি এর মধ্যে হয়ে গেছে। মেয়েটা ব্যাণ্ডেলে চাকরিও পেয়েছে একটা ছোটখাট। হাজার দশ মাহিনা দেবে বলছে। বর সুরাত নিয়ে যেতে চায়। পাগলি মেয়ে এখন আর যেতে রাজি নয়। জানতে চাইলাম দেনমোহর কত? জবাব পেলাম ৪০০০/-। মাত্র চার হাজার? উনি অমায়িক হেসে বললেন, “চার হাজার টাকা, আমাদের ধর্মে অনেক দিদি। ” ধর্ম নিয়ে জ্ঞান সীমিত বটে, তবে বাজারদর নিয়ে তো নয়। চার হাজার আবার অনেক টাকা কেমনে হয় অ্যাঁ? আপনার দেনমোহর কত ছিল চাচা? চাচার দুই গালে লাগল আলতার ছোপ, “আজ থেকে সাতাশ বছর আগের কথা দিদি। হাজার টাকা দেনমোহর ছিল-”। বলতে গেলাম তবে? বলতে গেলাম অনেক কিছুই, পারলাম কই?ছলছলিয়ে উঠল প্রৌঢ়ের দুই আঁখি। ধরা গলায় প্রৌঢ় আবার বলে উঠল,“ আমার বাড়ি ফাঁকা করে চলে গেছে দিদি। বিবিজান নেই, আমারও আর কেউ নেই-”।
No comments:
Post a Comment