Sunday, 22 March 2020

বেণী ও সখা



-নমস্কার  স্যার।
-আবার তুমি?
-আজ্ঞে।
- দেখ বাপু, তুমি যা চাও তা অসম্ভব। দিব্য তো আছো, খাচ্ছো,দাচ্ছো, ঘুরে বেড়াচ্ছ-- তোমার মনের মত মরসুম এখানে। আজ তো দেখছি সকাল থেকে ঘুড়ি ওড়াচ্ছিলে, বেশ তো আছো, তা এই বদ খেয়ালটা কি মাথায় না এলেই নয়????
-ভাল আছি স্যার। এটা হক কথা। যেদিন যা খেতে চাই খেতে পাই। যা পড়তে ইচ্ছে হয় পড়তে পারি। যেমন আজ এই রেড ইন্ডিয়ান ওয়ার বনেটটা পড়েছি---
-ঐ ভয়ানক দর্শন জিনিসটার নাম ওয়ার বনেট নাকি?
-হ্যাঁ স্যার।  রঙ বেরঙের পাখির পালক দিয়ে--
-তা এ তোমার কি সাজ বাপু? খালি গায়ে ধুতিটাকে লুঙ্গির মত পড়ে মাথায় ঐ কিম্ভুতকিমাকার টুপি পরে ঘুড়ি ওড়াচ্ছ?
- ভালো লাগে না স্যার।  কিছু ভালো লাগে না।
- একা লাগে বুঝি? তা আসে পাশের লোকজনের ওখান থেকে তো একটু আধটু ঘুরে আসতে পারো।
-  কি হবে স্যার? সেদিন গিয়েছিলাম প্রমথেশ বড়ুয়া  সাহেবের ওখানে। গোটাটাই সেট। উনি একাই অভিনয় করে যাচ্ছেন।  মাঝে মাঝে নিজে নিজেই ডাইরেক্টর হয়ে যাচ্ছেন। ক্যামেরার পিছনরথেকে প্রচণ্ড ধমক দিচ্ছেন নিজেকে---আবার কখনও গান গাইছেন-কাল্পনিক নায়িকার হাত ধরে। ওনার গলায় খেলা ভাঙার খেলা গানটা আমার খুউউউব পছন্দের--- কত অনুরোধ করলাম দেখলেনই না।
-হুঁ। প্রমথেশের স্বর্গ ঐ রকমই। সিনেমা আর গানই তো ছিল ওর জীবন। আর একটা জিনিসও ছিল অবশ্য। তবে এখানে ওসব খেলে কিছু হয় না, যতক্ষণ  না তুমি নিজে মদমত্ত হতে চাইছ।
-স্যার আমার অনুরোধটা একবার বিবেচনা করে দেখুন স্যার-প্লিইইইইজজজ।
-আরে ধুৎ। মানুষ নীচে থেকে ওপরে আসে--, যে যা করেছে সেই হিসেবে।  কিন্তু ওপর থেকে কেউ নীচে যায়? কেউ গেছে কোনদিনও?
-স্যার। প্লিজ। আপনি চাইলেই পারেন---
-পারি না রে বাবা। এখানে সব নিয়মে চলে। আমিও। ব্যতিক্রম মানেই প্রলয়-- ওটা শিউজীর জুরিসডিক্সন। আমার নয়।
-স্যার, আমি জানি, মা বলত- কলি যুগের শেষে আপনি পৃথিবীতে যাবেন, কালো ঘোড়ায় চেপে হাতে তরবারি নিয়ে---
-কালো ঘোড়া? তাই কি? সাদা শুনেছিলাম যেন? নাকি বাদামি?যাই হোক,কলি তো এখনও শেষ হয়নি বাবা।  সব পারমানবিক বোমা গুলো আগে তোমরা দমাদ্দম ফাটাও, আর আমাকেও মানুষ হয়ে জন্মাতে হবে। আমার মায়ের নাম হবে সুমতি--হেঃ হেঃ দেখছ বাপু সব মনে আছে। তুমি আবার জন্ম নিতেও তো চাও না?
-না স্যার।  না । আমাকে এই অবস্থায় পাঠান স্যার। কিছু কাজ বাকি রয়ে গেছে--_কিছু হিসাব চোকাতে হবে।
-জানো দেবদূতেরা তোমাদের কি বলে? রোমহীন বাঁদরের দল। মরা লোকের আবার হিসেব নিকেশ। ও সব চিত্রর হাতে ছেড়ে দাও। ও সবার সব হিসাব রাখে। সেই মোতাবেক নোটশীট দেয়, ফাইল তোলে। যেমন তুমি--তোমার ফাইল আমায় দিল। কিন্তু তোমায় তো কিছুতেই খুশি করা যায় না বাপু। সুচরিতার মত সুন্দরী অপ্সরাকেও তুমি দিদি বলে ভয় দেখিয়েছো।
-স্যার। প্লিজ। একবার যেতে দিন। একটিবার স্যার। আপনিও তো কাউকে ভালবেসেছিলেন---
-কাউকে কি হে?বল কাকে নয়? দেবী,দেবদূতী,অপ্সরা-- কে নেই। আমি হলাম দ্বাপরের কেষ্ট। কলির নয়।
-আর শ্রীরাধিকা?কি হল স্যার?গম্ভীর হয়ে গেলেন যে? মনে পড়ে তার কথা? যদি তাকে আপনার কাছে থেকে বলপূর্বক  সরিয়ে নেয় কেউ? তার সামনে আপনাকে পিটিয়ে থেঁতলে খুন করে? আর মরার আগে দেখেন যে কেউ তাকে জবরদস্তি ----তিষ্ট প্রভু তিষ্ট। যা শুনেই আপনার এই অবস্থা, আমি তা সয়েই এখানে এসেছি। আমায় যেতে দিন প্রভু। যেতে দিন।
-বেশ। দিলাম। কিন্তু এখানকার নিয়ম বড় কড়া। তোমাকে আমার মধ্যে বিলীন হতে হবে। আমি মর্তে পৌছলে তবে তুমি মুক্ত হতে পারবে। শুধু মনে রেখ মর্তে আমি তোমার কোন কাজে আসব না। কারণ আমার দৈব শক্তি ত্যাগ করে তবেই যেতে পারব। যা করবে, তোমাকে নিজের জোরেই করতে হবে। রাজি?
-রাজি প্রভু। রাজি।
-দয়া করে আবার মরো না। মরলেই লাইনে দাঁড়াতে হবে, চিত্রগুপ্তর সামনে আসতে হবে। আর চিত্রটা মহা হারামজাদা।
বেণী ও সখা- (part 2)
বিশাল শুষ্ক উপকূল।   রূপালী বালি মোড়া। সময়টা সন্ধ্যার কিছু আগে, সূর্য সদ্য অস্ত গেছে আবার সন্ধ্যার অন্ধকার ও নামেনি। জনা চার পাঁচ জেলে তাদের জেলে ডিঙি গুলিকে নিরাপদ স্থানে রেখে পাশে বসে বিড়ির ধোঁয়া সহ দুদণ্ড জিরিয়ে নিচ্ছে। হঠাৎ একজন চিৎকার করে উঠল, সমুদ্রের বুক থেকে উঠে আসছে এক ছায়া মূর্তি। আবছায়া তেও স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে সে দীর্ঘ দেহী। ঋজু টানটান চেহারা। মাথায় বেশ লম্বা, ভেজা চুল, কাঁধের ওপর লেপ্টে আছে। ওরা দৌড়ে গেল। আগন্তক বেশ কালো। শ্যাম বর্ণ যাকে বলে। পাথরে কোঁদা চোখ, নাক, চেহারা। পরনে মালকোঁচা মেরে পড়া ধুতি। কানে সোনার মাকড়ি। কোমরে একটা বাঁশি। ডান বাহুতে একটি বিশাল ময়ূরের পালকের উল্কি। যা ঐ প্রায়ান্ধকারেও জ্বলমান । আগন্তুক হাসল। দুই গালে গভীর টোল পড়ল। পুরুষ মানুষ এত সুদর্শন  এত মোহময় হতে পারে? বাকরুদ্ধ হয়ে দাঁড়িয়েছিল ওরা। হঠাৎ  আগন্তক এক জনের দিকে ভিজে আঙুল তুলে বলল,“তুমি। দূরে থাক। স্বাদবদলের কোন শখ নেই বৎস ইয়ে মানে বাছাধন। ”লোকটি ভূত দেখার মত চমকে গেল, তারপর ছুটে পালিয়ে গেল। বাকিরা তখনও মন্ত্রমুগ্ধ । আগন্তুক একটি ধারালো ছুরি চাইল আর জানতে চাইল, “ রণছোড়দাসের বড় মন্দিরটা কতদূর?”

বেশ কয়েকঘন্টা পর, রাত গাঢ় হয়ে এসেছে, হু হু হাওয়া দিচ্ছে, লোকগুলি চলে গেছে, আগন্তুক ধারালো ছুরি দিয়ে নিজের বাঁ হাতের ওপর এক গভীর দাগ কাটল। জ্বলন্ত লাভার মত উজ্জ্বল লালচে সোনালী রক্ত ফিনকি দিয়ে বেরিয়ে নীচে বালিতে পড়তে লাগল। মুহূর্তমধ্যে  দেখা গেল এক মাঝারি উচ্চতার সাদামাটা দেখতে বছর তিরিশের ছেলে আগন্তুকের পায়ের কাছে হাত জোড় করে বসে আছে। “প্রভু। ”
“বেণী”।
“ধন্যবাদ স্যার। ”
“কিসের ধন্যবাদ হে? তোমার বাড়ি তো সেই সুদূর বাংলা। এটা যে গুজরাত সে খেয়াল আছে? ”
“গুজরাত?কেন প্রভু?”
“এটা, বন্ধ কর। হয় প্রভু বল। নয় স্যার। নয় তো আমার এত নাম, তার একটা ধরে ডাকো।”
“গুজরাত কেন দীনু?”
“দীনু? দীনবন্ধু?ওটা তো তেত্রিশ কোটির যে কোন কাউকেই বলা যায় রে ভাই? আর গুজরাত হবে নাতো কোথায় হবে? আমার বাড়িই তো ছিল এখানে। দ্বারকা?সমুদ্র বেটা হিংসুটে । কতবার যে গিলে নিয়েছে আমার শহর, কিন্তু আবার গজিয়ে উঠেছে--- আমার দ্বারকা। তাই আর কি--”
“সেন্টু দিও না সখা। এবার আমি বাংলায় ফিরব কি করে শুনি? কপর্দকশূন্য অবস্থায়?

“উড়োজাহাজে করে। আর সখা বলেই ডাক। দীনু কেমন যেন বুড়োটে নাম। ”
“হাওয়াই জাহাজের পয়সা কি আমার বাপ দেবে? তোমায় তো উল্টো করে ঝাড়লেও কিছু বেরোবে না। ”
“তোমার বাপ একটা ছিঁচকে কালোবাজারী চোর ছিল। এখন নরকে পচছে। তার ভরসা করে লাভ নেই। কে বলল আমার টাকা নেই? এত যে মন্দির আমার জন্য, এতটাকা ভেট পরে সেসব কার?”
“সেগুলো তোমার জন্য ওরা সাজিয়ে রেখেছে-চল নি। ”
“ব্যঙ্গ করছ? চল। কোথায় কোন মন্দিরের কোন গর্ভগৃহে কি লুকোন আছে তুমি জানো না বেণী। আমি জানি। কোন মহন্তের কোন বাড়ির কোন সিন্দুকে আমাকে দেওয়া কোন জিনিস লুকোন আছে তুমি জানো না---। কি যেন বলে আগে আগে দেখো কি খেলা দেখাই---কোন খেলা যে খেলব কখন-- ”

বেণী ও সখা (পর্ব ৩) -
রাডিশন ব্লু হোটেল, দ্বারকা। দরজায় খটখট করল বেণী। তারপর ইতস্ততঃ করে নব ঘুরিয়ে প্রবেশ করল,“সখা?”
 “হুঁ?” অন্যমনস্ক ভাবে জবাব দিল সখা। হাতে একটা ঝাঁ চকচকে আই প্যাড।পাশে খুলে রাখা ল্যাপটপ, তার পাশে মূল্যবান মোবাইল ফোন। সখার  পরনে ব্রান্ডেড্ ঢোলা পাজামা আর গোল গলা টি শার্ট। খাটের সামনে দুটো তুলতুলে নরম জুতো খোলা আছে। ঢলঢলে পোশাক ভেদ করে ভিতরের পেশীবহুল সুগঠিত শরীরের প্রতিটি বিভঙ্গ বেশ সুস্পষ্ট । এক মাথা ঝাঁকড়া অবাধ্য চুল, মুখে চোখে ঝাঁপিয়ে পড়ছে, ঋজু চৌকো  চোয়াল, হাসলে গালে টোল পড়ে, সখা যে এত রূপবান তা আজ বেণী প্রথম খেয়াল করল। সাধে শ্রীচৈতন্যদেব সখার প্রেমে উন্মাদী হয়েছিলেন? বেণীর মনে হল, সে ও সখার প্রেমে পড়েছে। এ অন্য প্রেম, কাম বিবর্জিত। এ প্রেমে মানুষ হারিয়ে যেতে চায়, মিশে যেতে চায় দয়িতের সঙ্গে। বেণীর ইচ্ছে করছে সখার পদতলে গিয়ে বসে, আলতো করে মাথাটা নামিয়ে আনে সখার শ্রীচরণে। বেণী শুধু বলল,“আই লাভ ইউ । ”
সখা করুণ হেসে বলল,“বেসো না। আমি বড় অপয়া সখা। যে যখন আমায় ভালবেসেছে শুধু কষ্টই পেয়েছে। রাধা-রুক্ষ্মিণী-অর্জুন-অভিমন্যু-মীরা এমন কি হালের শ্রীচৈতন্য অবধি। আমাকে ভালবেসে নিজেদের বিকিয়ে দিয়েছে এরা,অথচ আমি এদের জন্য কিছুই করতে পারিনি। আমি বড় সাধারণ দেবতা হে। ভালবাসা ছাড়া আর কিছুই পারি না। যুদ্ধ, কলহ-দ্বেষ, অশান্তি আমি নিতে পারি না। যদি পারতাম, আমার একমাত্র ভাগ্নেকে ওরা ঐ ভাবে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে মারতে পারত না। ”

অখণ্ড নীরবতা গ্রাস করল ঘরটাকে। দুজনেই চুপ, তারপর সখা উৎফুল্ল হয়ে বলে উঠল “বুঝেছি। এমন কিছু শক্ত নয় হে-। এটা উয়িন্ডোজ, এটা অ্যান্ড্রয়েড আর এটা হল আইওএস। ” মৃদু মোহক হেসে বলল সখা। “ নির্লোম বাঁদরের দল কিন্তু বেশ বুদ্ধিমান। একথা মানতেই হয়। ”
নরম সোফায় পশ্চাদ্দেশ ঠেকাতেই অর্ধেক ডুবে গেল বেণী। হ্যাঁচোরপ্যাঁচোর করে উঠে বসল একটি অপেক্ষাকৃত শক্ত চেয়ারে। “সখা এবার আমায় বিদায় দাও--”।
ভ্রু কুঞ্চিত করে সখা বলল,“এখুনি?আচ্ছা বলে দেখছি কাল সকালের ফ্লাইট কিছু আছে কি না?”
“ফ্লাইট লাগবে না সখা। আহমেদাবাদ থেকে ট্রেন--। ” 
“না।  প্লেন। ”দৃঢ় ভাবে বলল সখা।
বেণীও ততোধিক ঋজু হয়ে বলল,“না প্রভু। এটাকা আপনার। লোকে আপনার উদ্দেশ্যে ভেট করেছে। এর ওপর অধমের কোন অধিকার নেই। আর তাছাড়া আপনি যে হারে খরচ করছেন---কুবেরের ঐশ্বর্য্যও জলদি ফুরিয়ে যাবে। ”
“ফুঃ।” বলে একটুকরো পিৎজা মুখে দিল সখা। চোখ বুজে এল আবেশে। “চিজ্। আঃ কি জিনিস বানিয়েছো গুরু।  চিজ্, আইসক্রীম, চকলেট। নাহে পৃথিবী বেশ মজার জায়গা। আর কি বলছিলে, ঐশ্বর্য্য ফুরিয়ে যাবে? আরেঃ লোকে আজ পর্যন্ত যত  আমায়  হাতি দান করেছে, তাদের দাঁত বেচেই-”

মাস তিনেক পরের কথা, হ্যাভেলকের ব্যয় বহুল হোটেলের নিজস্ব নির্জন বীচে বসে, ডুবন্ত সূর্যের কমলা আলোয়  বঙ্গোপসাগরের শোভা দেখতে দেখতে ডাবের জল খাচ্ছিল সখা। হঠাৎ ফোনটা জোরে জোরে কাঁপতে লাগল। প্রতিবার ফোন এলেই সখার মনে হয় বেণী। কিন্তু এই তিন মাসে বেণী একটিবার ও ফোন করেনি। আজো অচেনা নম্বর।
“হেলোঃ। ”
“সখা?” কাঁপা কাঁপা গলা ভেসে এল বহুদূর থেকে।
“বেণী?” করে উঠল সখা। ডুবন্ত সূর্য চমকে উঠল। মুহূর্তের জন্য স্তব্ধ হয়ে গেল সমুদ্র। “কি হয়েছে? তোমার ফোন কোথায়?এটা কার নম্বর? কোথায় তুমি?ঠিক আছো তো”
“তিষ্ট প্রভু। তিষ্ট। আমি কথা রাখতে পারিনি প্রভু।  আমি আহত। মরণাপন্ন। আমার মোবাইল  পুলিশের হেফাজতে। নার্স দিদির থেকে ফোন চেয়ে লুকিয়ে ফোন করছি। আমায় পারলে ক্ষমা কোর সখা---”
“মানে?মরণাপন্ন? পুলিশ?তুমি কোথায়? আমি আসছি। আর সিম গুলো পুলিশের হাতে গেল কি করে? ও গুলো তো পারভেজের আধার কার্ড দিয়ে কেনা। কি করেছ?  মোটা ভাল ছেলেটা ফেঁসে যাবে যে?”
“এত প্রশ্নের জবাব দেবার ক্ষমতা নেই সখা। আমি খুন করেছি। চারজনকে। একা চারজনের সাথে লড়ে গেছি, ফলে আমার অবস্থা বুঝতেই পারছ। দুটো আঙুল নেই। হাত পা পাঁজর ভাঙা। আর প্রচুর রক্তক্ষরণের ফলে রক্তাল্পতায় ভুগছি। বাইরে পুলিশ পাহারায় আছে। মরলে ভাল। নইলে ফাঁসি। ”
“কোথায় আছো তুমি?”চিৎকার  করে উঠল সখা। এতক্ষণ স্তব্ধ থাকার পর গর্জন  করে উঠল সমুদ্র। ভয়ে ঝুপ করে ডুবে গেল সূর্য ।

পরদিন রাত এগারোটা। আসানসোল জেলা হসপিটালের ঘুমন্ত করিডরে হেঁটে যাচ্ছে এক আগন্তুক। পরনে নীল জিন্স আর হাল্কা সবুজ টি শার্ট। একটা ঘরের বন্ধ দরজার বাইরে এক হাবিলদার বসে ঢুলছিল। আগন্তুক নিঃশব্দে দরজা খুলে ঢুকে গেল ঘরের মধ্যে। খাটে শুয়ে আছে বেণী। একি চেহারা বেণীর। এক মুখ দাড়ি। কোটরগত চোখ। আগন্তুুকের জন্যই যেন প্রতীক্ষা করছিল বেণী। অস্ফুটে বলল,“ সখা তুমি এলে। এবার আমি শান্তিতে-”।
শশশশশ্। আওয়াজ করল আগন্তুক। বেণীর কপালে দুটো আঙুল ঠেকালো সখা, মুহূর্তের মধ্যে সমস্ত কাটা দাগ, ক্ষত মিলিয়ে গেল। আগন্তুকের আঙুল স্পর্শ করল বেণীর হাত, কড়কড় করে ভেঙে গেল প্লাস্টার। অবাক বিস্ময়ে বেণী দেখল দুটো হারিয়ে যাওয়া আঙুল আবার গজিয়ে গেছে। সখার আঙুল স্পর্শ করল পাঁজর---
বেণী ও সখা (part 4)
বেণী শুধু অস্ফুটে বলল,“কেন প্রভু? কেন এলে তুমি? এঘরে করিডরে সিসিটিভি ক্যামেরা লাগানো আছে। ওরা তোমায়ও অপরাধী ভাববে-”।  ফোৎ করে  তাচ্ছিল্যপূর্ণ ভাবে একটা নিশ্বাস ছেড়ে ব্যাগ থেকে এক সেট জামাকাপড় বার করে বেণীর হাতে দিল সখা। “ওহে নির্লোম বাঁদরের দল, ইএমএফ কি বোঝ? তোমাদের ঐ ক্যামেরার সাধ্য কি আমায় দেখে? আমার গা থেকে যে ই এমএফ বেরোয় তা ঐ ক্যামেরার কি যেন বলে ট্রান্সমিশন বোধহয়, ঐটাতে বাধা দেয়। যখনই আমায় দেখার চেষ্টা করবে শুধু অস্পষ্ট ঝিরিঝিরি একটা অবয়ব দেখতে পাবে। এমন কি আমার সংস্পর্শে  থাকলে তোমায় ও স্পষ্ট দেগতে পাবে না। ইএমএফ ডিস্টার্বেন্স এর জন্য। এবার চটপট চেন্জ করে নাও। ”
পোশাক পাল্টে বেণী আর সখা বেরোতে যাবে,  কর্তব্যরত নার্স ট্রে নিয়ে ঘরে ঢুকল। প্রথমেই বেণীকে থেকে ভ্রু কুঁচকে গেল,“ একি!একি! আপনি কোথায় যাচ্ছেন? প্লাস্টার কাটল কে?” পাশ থেকে সখা এগিয়ে এসে মৃদু হেসে নার্সের চোখে চোখ রেখে বলল,“আমি। ”
কুঞ্চিত ভ্রু মুহূর্তে সোজা হয়ে গেল। আবিষ্ট মোহক ঘণ দৃষ্টিতে সখার দিকে তাকিয়ে রইল নার্স কিছুক্ষণ । তারপর শুধু ঠোঁট দুটো নড়ল,“আই লাভ ইউ”।  সখাও হাসল। সম্মোহনকারী হাসি, তারপর বাঁশির মত সুরেলা সুরে বলল,“ আই নো। কিন্তু এখন যে বড় ব্যস্ত সখী। একটু পথ দেখিয়ে বার করে দাও আমাদের। ”
 নার্সের পিছন পিছন ঘর থেকে বেরোতেই, বাইরের ঢুলন্ত রক্ষী সটান উঠে দাঁড়ালো। “ইয়ে ক্যায়া চল রাহা হ্যায়? কোথায় নিয়ে যাচ্ছো আসামীকে?” বেণী এবং নার্সের মুখ এবং গলা শুকিয়ে গেল। সখা দুহাতে দুজনের কাঁধ স্পর্শ করে আশ্বস্ত করল। তারপর পিছন ফিরে রক্ষীর দিকে তাকাল সখা। সেই সম্মোহক হাসি। সেই একই প্রতিক্রিয়া , “ভালবাসি তোমায়। ”সত্যি সখাকে কি ভাল না বেসে থাকা যায়? গাড়িতে তুলে দিল ওরা। গাড়ি ছাড়ার আগে, সখা ডান হাতের তর্জনী আর মধ্যমা দুজনেরই কপালে ঠেকালো, মৃদু আচ্ছন্নতা গ্রাস করল দুজনকেই। আস্তে আস্তে মাটিতে শুয়ে পড়ল দুজনে, গভীর ঘুমে তলিয়ে গেল ক্ষণেকের মধ্যে। বেণী আতঙ্কিত হয়ে বলল, “সখা!!একি করলে?ওদের মেরে ফেললে নাকি?” সখা ঠোঁট উল্টে বলল,“আমি শুধু ভালবাসতে পারি বেণী। রক্তপাত আমার দপ্তর নয়। ওরা আমায় ভালবাসল, ওদের জন্য আমারও তো কিছু করার আছে। এই ভাবে চলে গেলে ওরা বিপদে পড়ত না? তাই ওদের স্মৃতিটা একটু পাল্টে দিলাম। আমার কথা ওদের আর মনে থাকবে না।  চেতনা এলে ওরা বলবে, ওদের পিঠে বন্দুক ঠেকিয়ে তোমায় ছাড়িয়ে নিয়ে গেছি আমি। যাবার সময়, কোন ওষুধ স্প্রে করাতে ওরা বেঁহুশ হয়ে গিয়েছিল। ”
বেণী শুধু আবেগ বিহ্বল কণ্ঠে বলল,“এত ভাবো সখা? এত ভাবো আমাদের জন্য?”
সখা জবাব না দিয়ে বলল,“পারভেজ গাড়ি চালাও। ”
“পারভেজ?পারভেজ আপনাকে নিয়ে এসেছে?”
“হুঁঁ। ” অবাক স্বরে বলল সখা। “ওর আধার দিয়ে পাওয়া সিম পুলিশের হাতে তুলে দিয়ে যে ঝামেলা তুমি পাকিয়েছ, তা সামলাবে কে? তাছাড়া পারভেজ আমার বয়স্য। যেমন রাম আর হনুমান। নির্লোম বাঁদরদের নিয়মকানুন তো পারভেজই আমায় শেখায় হে। ”
একমুখ পান চিবোতে চিবোতে হোৎকা ঘাড়ে গর্দানে পারভেজ একগাল হেসে বলল,“আই লাভ ইউ সার”। বেণী রাগে গরগর করতে করতে শুধু বলল,“শালা গুজ্জুর আবার ভালবাসা। তোমায় নয় তোমার টাকাকে ভালোবাসে ও। ” সখা জবাব দিল না। হুশ করে আসানসোল ছাড়িয়ে গাড়ি ছুটল ঝাড়খণ্ডের দিকে। মাঝপথে গাড়ি থামিয়ে একবার নম্বর প্লেট বদল করল পারভেজ।

শিমূলতলা। সময়টা এপ্রিলের শেষ, তাই পর্যটকদের ভিড় প্রায় নেই বললেই চলে।অবশ্য আজকাল এমনিতেই কম লোকজন আসে এদিকে।  শিমূলতলার সেই গৌরব আর নেই। আগে  যারা আসত তাদের গরিষ্ঠাংশই ছিল বাঙালি। বাঙালিদের প্রিয় স্বাস্থ্যোদ্ধারের জায়গা ছিল শিমূলতলা। কত নামি অনামি লোক যে এককালে এখানে এসেছে, তারপর শিমুলতলার মোহে আবদ্ধ হয়ে থেকে গেছে তার ইয়ত্তা নেই।  তারপর একদিন আচমকাই স্থানীয় অধিবাসীদের মনে হল,“ এরা কারা? হাভাতে বাঙালীগুলো এখানে কি করছে? ভাগাও এদের। ” শুরু হল বাঙালীদের এক্সোডাস। আজকাল শিমুলতলার বেহাল দশা। হৃত যৌবনা সুন্দরীর মত, আজোও রূপচর্চা করে বটে, কিন্তু আদতে ঔজ্জ্বল্যহীন।   শিমুলতলার জনবহূল এলাকার বাইরে একটা লাল সিমেন্টের  দোতলা বাড়িতে আপাততঃ আস্তানা বেণী ও সখার। কড়ি বরগাওলা সাবেকী বাঙালি বাড়ি। বড় বড় ঘর। ঘরে বিশাল বিশাল কালো সেগুন কাঠের খাট, দেরাজ, দেরাজের গায়ে বিবর্ণ হলেও হিরের মত দ্যুতিময় বেলজিয়াম গ্লাসের আয়না। পারভেজ গেছে গাড়িটা বদলে আনতে। সখার ইচ্ছা ওরা কলকাতা হয়ে আহমেদাবাদে ফিরে যায়। নাহলে অন্তত গোয়া। বেণীর জেদ ও যাবে না। “কেন?” হতাশ স্বরে বলল সখা। প্রতিশোধ তো নিয়ে নিয়েছ? চার চারটে লোককে খুন করেছ! আর কি?এবার গোয়ায় কটা  দিন কাটিয়ে ফিরে যাই চল। ”
“নাঃ”দৃঢ় স্বরে বলল বেণী। “ওরা ছিল নিছক পেয়াদা। আমার রাজাকে চাই। যাকে এককালে নিজের বড় দাদা, বাবা এমনকি ঈশ্বরের মত শ্রদ্ধা করতাম। নিজের হাতে সব শিখিয়েছিল-- কি ভাবে অপারেশন চালাতে হয়।”
“অপারেশন মানে কাটাকুটি ?”
“না সখা। তোলাবাজি, মস্তানি। প্রয়োজনে -”
“কি? খুন? এঃ। তুমি স্বর্গে ঢুকলে কি করে? আর আমি তোমার ফাইল না পড়েই তোমাকে আজাদী দিলাম। রাধার নাম করলে আর আমি ও গলে গেলাম। না হে। আর কোন মানুষ খুন করতে আমি দেব না। চল ফিরে চল। ”
(চলবে)

No comments:

Post a Comment