“সখী ভালোবাসা কারে কয়-”
কি যেন বলেছিলি চৈ, সবথেকে ফুটফেটে চাঁদ ওঠে দোল পূর্ণিমায়? রাত বেশ গভীর, শুনশান তোদের গলি, দিনভর রঙ খেলে ক্লান্ত শহরটা বুঝি ঝিমোচ্ছে। ভ্যানিশ রাস্তার সারমেয় কুলও। সিদ্ধি মেশানো ঠাণ্ডাইয়ের হিমেল পরশ মিহি জোছনার মত ছড়িয়ে পড়ছিল চিন্তা ও চেতনায়। তুই আর অন্তু এগিয়ে দিতে এলি বড় রাস্তা অবধি, পথে ঝপ্ করে নিভে গেল ইলেকট্রিক বাতি, চাঁদের সুষমায় পলকে রূপালী পাঁচশ বছর পার করা শহরটা।
“ চাঁদ উঠেছিল গগনে-”
দেড়শ বছরের বুড়ো বাড়িটা চাঁদের আলোয় যেন চুনকাম করা।গ্রীল, বন্ধ কাঁচপাল্লার ভিতর দিয়ে জবরদস্তি ঢুকে আসছে চাঁদনি। ঠাকুমার বিয়ের বার্মাটিকের নকশি পালঙ্কের ওপর খবরের কাগজ বিছিয়ে বসেছে আসর। অ্যালুমিনিয়ামের ডেকচি ভরা এলাচ গন্ধী ঘণ দুধ, ঠাণ্ডাই, কালাকাঁদ, সিদ্ধি, চিপস্, চানাচুর, ক্যাডবেরি, কোল্ড ড্রিঙ্কস্। একতলায় উদ্বিগ্ন মা, সিদ্ধি অবধি ঠিক ছিল-চিপস্-কোল্ড ড্রিঙ্কস্ আবার কেন? দুধ সয় না অন্তুর। সিদ্ধিও না। নেশা করার বিলাসিতা ওর পোষাবে না। বাড়ি গিয়ে রান্না বসাতে হবে। আজ কত মাস কেটে গেল, শয্যাশায়ী ওর মা। পিঠে গভীর শয্যা ক্ষত। সেরে গিয়েছিল। গজিয়েছিল নতুন চামড়া, আয়া দায়িত্বজ্ঞানহীনতায় ঘষে উঠে গেছে কচি চামড়া। কাকিমা চিৎকার করে ওঠেননি? চোখ দিয়ে জল বেরোয়নি? প্রশ্ন করলে, জলে ভরে ওঠে দুই চোখ, মাথা নাড়ে অন্তু। “না রে। মা কিছু বলে না-”।
কি সিদ্ধি আনলি চৈতালী? নেশাই তো ধরে না। মাথা চুলকেই যায় চৈতালী, “বললাম, শ্লা-। ভালো সিদ্ধি দেবেন-। চাটুতে বেশ করে নেড়ে আনলাম-”। উপুড় করা জোছনায়, গান ধরে সঞ্চিতা। “ এখন আমার বেলা নাহি আর, বহিব একাকী বিরহের ভার--. ”। কান খাড়া করে শুনি আমরা, এরপর কি? রবি না রোদ্দুর?অঙ্গে অঙ্গে হাল্কা ঝিমঝিমানি, হৃদয়ে মথিত প্রেম- নাকে ভেসে আসে ধুনোর মিষ্টি সুবাস। অস্মি আকাশের দিকে তাকিয়ে ব্যগ্র হয়ে খোঁজে, মাথার ফুটফুটে চাঁদ-
“যাও পাখি বলো তারে, সে যেন ভোলে না মোরে-”
দোলের সকাল, ধপধপে সাদা পাঞ্জাবি পরে প্রস্তুত বুল্লু। তুত্তুরীর লাল রঙ চটা গেঞ্জি আর নীল তারা ছাপ বিবর্ণ ফুল প্যান্ট না পসন্দ। পিতলের রেকাবিতে চুড়ো চুড়ো করে সাজানো ছয় সাত রঙের আবির। চাটুজ্জে বাড়ির দস্তুর, প্রথম আবির পড়বে কুলদেবীর পায়ে। তাঁকে তো সরস্বতী নদীতে বিসজর্ন দিয়ে এসেছিলেন প্রপিতামহের বিধবা জননী। মড়ক লেগেছিল দেবানন্দপুরে। বাড়ির সমর্থ পুরুষগুলো ঝরে গেল অকালে। বিধবা গোলাপসুন্দরী তীব্র অর্থাভাবে কয়েকমাস থোড় সিদ্ধ দিয়ে উপাসনা করেছিলেন অষ্টভূজা কুলদেবীর। তারপর-।
মায়ের কুলুঙ্গী, যাকে বাবা বলে, “ঠাকুরের কাছারি বাড়ি” তথা বাড়ি জোড়া ঝুলন্ত ক্যালেণ্ডারে আসীন গুচ্ছ গুচ্ছ ঈশ্বরের চরণযুগল আবিররঞ্জিত করার পর, আবির পড়ে বয়সানুপাতে গুরুজনদের পাদপদ্মে। “দিদি কই?” সম্পর্কে তো বাবার দিদি, তবে তিন প্রজন্ম ধরে সবাই ডাকি দিদি। তিন প্রজন্মের লালন-পালন যে তাঁরই হাতে।চাটুজ্জে বাড়ি যে অন্ধকার তাঁকে ছাড়া।
পূবের ঘরে বন্দী দিদি। জানুয়ারীর শুরু থেকে অসাড় শরীরের ডান দিকে সবে জাগছে সাড়া। নিজে নিজেই উঠে বসতে পারে আজকাল। খানিকটা হলেও বাড়িয়ে দিতে পারে ডান হাত। হাত ধরলে পায়ের পর পা ফেলে পারে হাঁটতেও, যদিও ভাইদের প্রবল ধমকানির পর। আজও যেমন বড় ভাই বলল, “দাঁড়া দিদি নামবে। আমরা উঠব না। ”
কই গো দিদি নামো। বেলা মধ্যাহ্ন গড়িয়ে যায় অপরাহ্নের পথে। তুত্তুরী আর বুল্লুর মাথায় মুখে খেলা করে রঙবেরঙের আবির। কোথা থেকে এক আবির পিচকারি জোগাড় করে ভসভস্ করে আবির ছিটোয় ডাম্পি। পলকে ময়দান সাফ। এক বালতি জলে ভেসে বেড়ায় শুকনো পলাশ। জলের রঙ গড়ায় হলুদ থেকে লালের দিকে। অন্য বালতিতে গোলা হয় সবুজ রঙ। “মাখাবি না। মাখাবি না” করে অনর্থক চিৎকার করে মা। লাল-নীল-কমলা-হলুদে ভরে ওঠে মায়ের মুখ। গোলাপী শাড়িতে ফোটে লাল সবুজের ফোঁটা। বিনা আপত্তিতে রঙ মাখে বাবা।
দূর ছাই বলে দৌড়ই পূব-দখিন মুখো ঘরের দিকে। বিছানায় পরিপাটি করে শাড়ি পরে বসে আছে দিদি। অনেকদিন বাদে পরল। সৌজন্য আয়া মাসি। বাড়িয়ে দেওয়া গাঢ় সবুজ হাত ধরে পা ফেলে দিদি। পিছনে চিৎকার করে ডাম্পি, “ছেড়ে দাও ঝুনুদি। দিদি একা নামো। ” ডাম্পির চোদ্দ পুরুষ উদ্ধার করতে করতে কখন যেন নেমে আসে দিদি। কুচো দুটো প্রস্তুত ছিল রঙের ডালি নিয়ে। পলকে খুনখারাবি। হাঁপাতে হাঁপাতে সোফায় বসে দিদি। বাবা শুরু করে, না জানি কোন মান্ধাতা আমলের বস্তাপচা গল্প। আপত্তি জানাতে যাওয়া মুখের ওপর হাত চাপা দেয় চৈতি, “ছেড়ে দাও দিভাই। দিদি এই গল্প গুলোকে খুব মিস করে। ” অতীত আঁকড়ে বেঁচে থাকা পঁচাশি বছরের পিসির সাথে পর্যায়ক্রমে ছবি তোলার হুজুক পড়ে যায়। এবার আমার পালা, মা বলে ওঠে, “যত বয়স বাড়ছে, ধিঙ্গিপনাও বাড়ছে মেয়েটার। ” কাঁপা কাঁপা হাতে সবুজ হাতটা চেপে ধরে পিসি, আদরের ছলে ফিসফিস করে বলে ওঠে “আমায় যেন ভুলিস না ঝুনু ”। আর ধিঙ্গি মেয়েটা? মনে মনে বলে, “কভি নেহি। কভি ভি নেহি। ” শুধু অসভ্য চোখটা কেন যে বারে বারে করকর করে ওঠে-
No comments:
Post a Comment