বাপরে কি ডানপিটে বুড়ো। গোটা দেশ ভয়ে জড়সড়, অাকাল লেগেছে বাজারে। জনতা কার্ফুর মধ্যেই বিশাল তালিকা নিয়ে প্রস্তুত ঝানু বাজারুরা, আর আমার বৃদ্ধ বলে কি না, “আমার কিসের অভাব?” লকডাউনকে থোড়াই ডরায় আমার বাবা। যৌবনে লড়াই করেছিল সম্পদের সমবন্টনের দাবীতে, অপ্রয়োজনে দ্রব্যসামগ্রী গুদামজাত করাকে ততোটাই ঘৃণা করে, যতটা কালোবাজারী। যে কোন সমস্যার সরল সমাধান মজুত আছে আমার বৃদ্ধের কাছে, “থাকলে ভাত খাব। না থাকলে ফ্যান খেয়ে থাকব-”।
ইশ এই উদ্দামতা বা দুঃসাহস যদি আমার থাকত-। নেই যখন, তখন বাধ্য হই আঙুল বেঁকাতে। কথায় কথায় জানতে পারি,ফুরিয়েছে চায়ের ব্যাগ, দুধওয়ালা বলেছে আগামী সাতদিনের জন্য গৃহবন্দী থাকবে সে ও। তুলনায় শ্বশুরমশাই বরাবরই স্পষ্টবক্তা এবং বাস্তববাদী। অনেক ভেবে চিন্তে তাঁর আব্দার একটাই, চিনি ছাড়া গুঁড়ো চিনি। “যদি পারিস। তোর মা দই দিয়ে মেখে খেতে বড় ভালোবাসে-”। অধৈর্য হয়ে ওঠে শৌভিক, আর কিছু না? চাল-ডাল- আনাজপাতি- তেল- সাবান? ফেলু মিত্তির-তপসে মিত্তির হয়ে কৌটো-চুপড়ি হাঁটকে দেখা যায়, মার্চ মাসের সাথে সাথেই ফুরিয়ে এসেছে অনেক খাদ্যসামগ্রীই। গুছিয়ে বলতে পারে না, শৌভিকের বৃদ্ধ-বৃদ্ধা। থতমত খায়। বয়স নুইয়ে দেয় ঋজুতম শিরদাঁড়াকেও।
জনতা কার্ফু কাটতেই, দুটো ছালা নিয়ে বাজারে যাই আমরা। ভালো করে তখনও ফোটে না আলো। বাজারে লেগেছে আকাল। গরুড়ের মত মাস্ক পরা নরনারীর দল, বিধিনিষেধ ভুলে ঝাঁপিয়ে পড়তে চায়-। আমাদের যে ফিরিস্তি অনেক লম্বা। তিন-তিনখানা পরিবারের প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি খুব কম কিছু তো নয়। বুড়ো অবাঙালী দোকানী ফুটিয়ে দেয় অনিয়মিত খরিদ্দারদের। শৌভিক তার নয়নমণি, রোজই অফিস ফেরৎ ঢুঁ মারে যে। আর আমি? নয়নকাঁটা বলতে পারেন। যেটাই আমি চাই, গম্ভীর মুখে শুনি, “নাই, নাই।” ওকে ছেড়ে বিগ বাস্কেট ধরেছিলাম যে। বেইমান অনলাইন শপিং সাইটের দল, অর্ডার তো নেবে। কবে দেবে প্রশ্ন করলেই জুটছে --।
এবার যাত্রা আপিস পথে- নইলে আক্ষরিক অর্থেই বেতন পাবে না কেউ। সই হয়নি যে বেতনের বিল। পথে আসে না না ফোন। “আমরা কেন বন্ধ করব এজ্ঞে? অমুক সাহেব আমার মামা হয়-”। অথবা, “ম্যাডাম, মালিক কারখানা বন্ধ করবে না বলছে। আমাদের কি করোণা হতে পারে না? বন্ধ করান আইজ্ঞা-”। কাউকে নরম ভাবে বোঝাতে হয়, “ আপনাদের কারখানার ছাড় আছে মশাই। আমি নিরুপায়।” কাউকে বা দেখাতে হয় ভয়। বন্ধ করবেন না বলব বড় সাহেবকে? পাঠাব নাকি ইন্সপেক্টর?
ফাঁকা পথ। রেললাইনের ওপর দাঁড়িয়ে থাকা মৃত ট্রেনের দেহাংশ। বন্ধ সারি সারি দোকানপাট। আগল খোলা দোকানে ভিড় জমানো মানুষ। ছোট্ট বাজার ব্যাগ হাতে নিঃসঙ্গ বৃদ্ধ বা বৃদ্ধা। কারো মুখ মাস্কে ঢাকা। কারো তাও নয়। সদ্য হাঁটতে শেখা বাচ্ছার মুখে মাস্ক লাগিয়ে, হাত ধরে বাজারে বেরিয়েছে মা। মাস্ক পরা চাওয়ালা। মাস্ক নামানো খরিদ্দার।
হাতে সাবান দিয়ে ঢুকতে হয় জেলাশাসকের করণে। ভেজা তোয়ালে এগিয়ে দেয় জনৈক অস্থায়ী কর্মী। পাগল নাকি? ঐতে হাত মুছি, আর ইয়ে হোক আমার। মন খারাপ হয়ে যায় অলিন্দে লাগানো সাধের গাছগুলোকে দেখে। লকডাউনে কে জল দেবে এদের?
অজিত দা নাকি আসবে। অাপিসই অজিত দার ঘরবাড়ি। গোটা চাকরী জীবনে চারদিন মাত্র ছুটি নিয়ে ছিলেন, দুদিন নিজের বিয়ের জন্য আর একটা করে দুই মেয়ের বিয়ের দিন। কালেক্টরেট অচল এই কর্মঠ বৃদ্ধকে ছাড়া। রীতিমত মাস্ক পরে, পকেটে স্যানিটাইজার নিয়ে টার্মিনেটর সেজে দৌড়ন অজিত দা। নজর রাখেন খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে। নজর রাখি আমরাও। কত হল? গতকাল রাতেও আক্রান্তের সংখ্যা ছিল ৩৬৫। এখন কত? ৪০০?৪৩৫? এই দোদুল্যমানতার মধ্যেই শেষ হয় দিনটা। ফোন করে তুত্তুরী, “বাড়ি এস মা।” আকাশ ভেঙে তখন শিলাবৃষ্টি।
No comments:
Post a Comment