Thursday, 18 July 2019

অনির ডাইরি ১৮ই জুলাই,২০১৯



কি সব দিন ছিল, সোনায় মোড়া। স্বয়ং মা লক্ষ্মী বাস করতেন এই গাঁয়, তাই বোধহয় গাঁয়ের নাম শ্রীপুর। শ্রীপুর হল নৌশিল্পীদের গ্রাম। প্রায় ঘরে ঘরে তৈরি   হত নৌকা,দেড় হাজার শ্রমিকের পেটে ভাত যোগাত এই নৌকা। পাতি বাবলা কাঠও এখানকার শ্রমিকদের হাতের ছোঁয়ায় পরিণত হত লজ্জাবতী অনাঘ্রাত পৃথুলা সুন্দরী নৌকায়। তারপর ভাসত তরী গাঙের জলে। ভরা শ্রাবণে উছলে উঠত নদী, ছাপিয়ে দুকূল, লেলিহান জিহ্বা বিস্তার করে গ্রাস করতে চাইত চরাচর, তখন সেই রাক্ষুসী নদীর হাত থেকে আবালবৃদ্ধবনিতাকে উদ্ধার করতে নামত শ্রীপুরের নৌকা। দূরদূরান্তে ছড়িয়ে পড়ত শ্রীপুরের নাম। আসেপাশের গাঁ ছাড়ুন সেই সুদূর পুরুলিয়া থেকেও আসত বায়না। তারপর কি যে হল, কার যে নজর লাগল। ক্রমশঃ কমতে লাগল বিক্রি। ইতিউতি গড়ে উঠতে লাগল সেতু।  একটা কৃশকায় সেতু গড়ে ওঠার অর্থ  হল, এপাড়-ওপাড় মিলিয়ে অন্তত সাতটা ঘাট বন্ধ হয়ে যাওয়া। আর বাস বা গাড়ি চললে তো কথাই নেই, ভাবতেও শিউরে ওঠে শ্রীপুরবাসী। তারওপর আছে ডিজেল চালিত স্টিমারের আক্রমণ। গড়ে ঘন্টায় চল্লিশ থেকে আটচল্লিশ কিলোমিটার বেগে দৌড়ানো পক্ষীরাজে সাথে পাল্লা দেবে গদাইলস্করি চালে দুলতে থাকা নৌকো? দুয়ো! দুয়ো!
সোনার দিনগুলো  কবে যে হারিয়ে গেল। নুন আনতে পান্তা ফুরানো শিল্পর সাধ্য কি এত লোকের পেটে ভাত জোগায়? শ্রীপুরবাসীর দ্বিতীয় উপার্জন বলতে ছিল টালিখোলায় কাজ। কিন্তু সেখানেও যেন শনি লেগেছে, টালি আজকাল কেনে কয় জনা? দুবার হনুমান লাফালেই তো টালির দফা গয়া। বন্ধ না হলেও খুউব কমে গেল টালি উৎপাদনের হার। বন্ধই পড়ে আছে বেশীর ভাগ চুল্লি। কোথাও আবার শুধুই ইঁট তৈরি হয় আজকাল। এই শ্রীপুরেই গিয়েছিলাম কাজের স্বার্থে। কাজ বলতে সামাজিক সুরক্ষা যোজনায় নাম নথিভুক্তকরণ।  শ্রীপুর গ্রামটা চুঁচুড়া থেকে বেশ অনেকটাই দূর, প্রায় কালনার সীমানা ঘেঁষে।হাওড়া থেকে কাটোয়া লাইন যদি ধরেন, চুঁচুড়া-ব্যাণ্ডেলের পর অনেকগুলো ছোট ছোট স্টেশন পড়বে, স্টেশনের নামগুলো বেশ মিষ্টি- মগরা, বাঁশবেড়িয়া, ত্রিবেণী, কুন্তিঘাট,জিরাট, বলাগড়। এই বলাগড় স্টেশন থেকে ফাঁকা পাটক্ষেত আর টলটলে পুকুরের বুক চিরে বেশ কিছুটা গেলে শ্রীপুর বলাগড় কল্যাণসমিতি প্রাথমিক লাইব্রেরি। এই লাইব্রেরিতেই জমায়েত হবার কথা এই নৌশিল্পীদের,অর্থাৎ যাঁরা এখনও এই পেশায় পড়ে আছেন।প্রায় শ খানেক লোক ধরে এই লাইব্রেরিতে, গিয়ে দেখা গেল মেরে কেটে জনা কুড়ি। তাও অধিকাংশই মহিলা, যাঁরা কেউ বাড়িতে বসে লেলাইফোঁড়াইয়ের কাজ করেন, কেউ বা আয়ার কাজ করেন। জনা কয়েক মাটির ঠাকুর গড়েন,স্যাকরার দোকানে কাজ করেন।  কিন্তু নৌশিল্পীরা কই? যাদের জন্য এভাবে দৌড়ে আসা? এত অনীহা কিসের ভাই?
স্যার বললেন, “চল কয়েকটা কারখানা থেকে ঘুরে আসি। এণারা বসুন।” এমন নয়,যে এণাদের আমরা চাই না, কিন্তু যাদের এত করে ডাকাডাকি, তারা কেন আসে না।
কারখানা বলতে বাঁশঝাড়, বা বটতলা। বা কোন খোলা মাঠ। বেলা দুটো বাজছে, জনা কয়েক খেতে গেছে, বাকিরা রীতিমত নিরাসক্ত। কি হবে, বাবু/দিবিমণি এসব করে? গরীব মানুষের কে আছে? এই যে কুতুবের বাপ, বয়স হয়েছে, ভালো খাটতে পারে না, ওর তোমরা কি উপকারে আসবে? সরকার তো আমাদের দেখে না। আমরাই বা কেন শুনব?
অনেক বোঝালেন স্যার। মোটরগাড়ি আর গরুরগাড়ির গল্প শোনালেন।  শুনলেনও ওঁদের কথা। ছবিটবিও তোলা হল কিছু। আমাদের সুশান্ত দিব্যি একটা নৌকার ওপর উঠে সেল্ফি তুলে নিল এন্তার। এবার ক্যাম্পে ফেরার পালা। স্যারের সনির্বন্ধ অনুরোধ ফেলতে না পেরে, ওণারা গুটি গুটি এসে জড় হলেন ক্যাম্পে। ঘর ভর্তি হয়ে উপচে যায় আর কি। এলেন ওণাদের বউ/বাড়ির অন্যান্য সদস্যরাও। কারণ,“তুমি আর কি বুঝবা? আমায় শুনতে দাও দিকি”। 
স্যার আর আমাদের বর্মণ সাহেব গুছিয়ে বোঝালেন সবকিছু। রমেশ প্রজেক্টর দিয়ে অনলাইন রেজিস্ট্রেশন কি করে করে দেখালো। অনেকেই এসে এসে ফর্ম নিয়ে গেলেন। আমরা যে ভাঁওতা দিয়ে টাকা তুলতে আসিনি, তা বোঝাবার জন্যই,আসেপাশের গাঁ থেকে কয়েকজন নথিভুক্ত শ্রমিককে ডাকা হয়েছিল। তাঁরাও শোনালেন তাদের কথা। বিলি করা হল সামাজিক মুক্তি কার্ড। এবার ফেরার পালা, ফেরার সময় ভাবলাম, শুকনো ডাঙায় একবার নৌকা চড়েই দেখি না-

No comments:

Post a Comment