কি কালান্তক গরম মাইরি। বিদিকিচ্ছিরি তাল পাকানো ভাদ্দুরে গরম। উত্তরবঙ্গে উপুড়হস্ত, উদার প্রকৃতির, কেন যে দক্ষিণবঙ্গের প্রতি এমন বিমাতৃসুলভ আচরণ, কে জানে? সেই কথাই শোনাচ্ছিলাম বাবাকে, রোজই ট্রেনে উঠে ফোন করি কি না। নাঃ এবারে বুঝি, বর্ষা আর হল না। আর কবেই বা হবে? বাবার যদিও উৎসাহে বিন্দুমাত্র ঘাটতি চোখে ইয়ে মানে কানে ধরা পড়ল না। বৃদ্ধ বরাবরই ভয়ানক আশাবাদী।
আজও যথারীতি, “আরেঃ দাঁড়া। কে বলেছে বর্ষা হবে না? সুদ সমেত সব ফেরত পাবি। পুজোটা আসতে দে।“ কি আজগুবি কথা মাইরি, বছরের সবথেকে আনন্দের দিনগুলোতে কে চায় বর্ষার পানি? বলতে গিয়ে দেখি, বৃদ্ধ ততোক্ষণে বহুদূর পাড়ি দিয়েছে, “ সে বছর মহালয়া পড়েছিল, ১৯শে সেপ্টেম্বর। তার ঠিক আগের দিন আমাদের বাড়িতে হামলা হয়েছিল। হামলা যে হবে, খবর ছিল। স্থানীয় এমপি, যুগল মণ্ডল, স্বয়ং বাবাকে খবরটা দিয়েছিল। সন্ধে সন্ধে অসিত (স্বর্গীয় ছোটকাকু) আর আমি খেতে বসেছি। ব্যাগ গোছানো। খেয়ে উঠেই বেরিয়ে পড়ব। রাত ৯টার ট্রেন। খুব সম্ভবত দুন এক্সপ্রেস। গভীর রাতে গিয়ে নামব কোডার্মা।“
ব্যারাকপুরের আগে, অকারণে দাঁড় করিয়ে দিল ট্রেনটাকে, বাবাও চুপ। বাড়িতে হামলার গল্পটা আমি জানি। রাত দশটা থেকে প্রায় দুটো আড়াইটে অবধি অবাধে ভাঙচুর হয়েছিল, মহল্লার মুষ্টিমেয় প্র-নকশাল বাড়ি। গলা ঝেড়ে আবার শুরু করল বাবা, “প্রচণ্ড মারে, সংজ্ঞা হারিয়েছিলাম। ব্যাটরা থানার মেঝেতে যখন জ্ঞান এল, তখন সবে শুরু হচ্ছে মহালয়া। পুজোর মরশুম। আদালত বন্ধ। আমাদের চালান করে দিল, মল্লিকফটকের জেলে।“
খানিকটা কেশে নিয়ে, “ সেবারেও এমন দম চাপা গরম। পঞ্চমী, ষষ্টী কেটে সপ্তমী পড়ল। আমার আর ছোট কাকুর পুজো বলতে, জেলের তিনতলার জানলা দিয়ে উঁকি মেরে দেখা, বাইরে পুলিশ লাইনের পুজো।“ থাকতে না পেরে জানতে চাইলাম, “আর মা? মা কি করছিল?মা তোমার সাথে দেখা করতে যেত?জেলে?”প্রসঙ্গত আমার বাবা এবং মায়ের শুভদৃষ্টি জেলে আর আদালত চত্বরেই সম্পন্ন হয়েছিল।সুদূর মুর্শিদাবাদের অজ গাঁ রামনগরের ঘোষ বাড়ির মেয়েরা বরাবরই ভয়ানক রকমের আবেগপ্রবণ এবং বাস্তবজ্ঞানহীন (মা,মুষ্টু এবং ছোটো কেলিও না প্লিজ)। বৃদ্ধ বলল, “তা তো মনে নেই, হ্যাঁ গো, তুমি আসতে আমার সাথে দেখা করতে?” মায়ের বলে রক্তে সোডিয়াম নিম্নগামী,মুহূর্তে মুহূর্তে সব ভুলে যায়, তার কাছে জানতে চাইছে, না জানে কোন মান্ধাতার যুগের কথা। সর্বোপরি মা আপাতত তার ছায়ার সাথে মধুর বাক্যালাপে নিমগ্ন। ট্রেনের ঝমঝম ছাপিয়ে, দুজনের গলা কানে সুড়সুড়ি দিচ্ছে। এই নিয়ে কতবার যে ছায়াকে বরখাস্ত করা হল, আর ডেকে আনা হল তা ঈশ্বরই জানেন। মা যে শোনা মাত্র মুখঝামটা দিল, বেশ বুঝতে পারলাম। বাবা দেখলাম তাও আশা ছাড়ল না,এবার আমায় পাকড়াও করল, “গুগল করে দেখ না, কোন সালে ১৯শে সেপ্টেম্বর মহালয়া পড়েছিল।“ ইল্লি আর কি? গুগুল যেন আমার আলাদিনের জিন।
বাবা দেখি, তখনও বিড়বিড় করে চলেছে, “৭৩ না ৭৪ রে বাবা? এ হে হে, দাদা থাকলে, এখুনি বলে দিত। বলো না গো, আমি দ্বিতীয়বার কবে জেলে গেলাম?” মা বোধহয় বলল, তখনও মা, বাবাকে চিনত না। বাবা সোল্লাসে শুরু করল, “তখনও বিয়ে হয়নি, বুঝলি। যা বলছিলাম, ষষ্টি অবধি, আকাশ ঝকঝকে, গরমে নাভিশ্বাস ওঠে, হঠাৎ সপ্তমীর দিন সন্ধে সাতটা থেকে শুরু হল বৃষ্টি। সে কি সাংঘাতিক বৃষ্টি রে, তিনদিন এক নাগাড়ে বৃষ্টি। নবমীর দিন দুপুর বেলা, হো- হো চিৎকার। আমরা জেলের তিনতলার জানলা থেকে দেখছি, হাফ প্যান্ট আর সাদা স্যান্ডো গেঞ্জি পরে, দৌড়চ্ছে পুলিশগুলো। পুলিশ লাইনের প্যান্ডেল, তুমুল বৃষ্টিতে ক্রমশ হেলে পড়ছে। দড়ি-দাড়া দিয়ে তাকে খাড়া করার যতই চেষ্টা করে, ততোই তিনি হেলে পড়েন। শেষে, হুড়মুড় করে ভেঙ্গে পড়ল, আমাদের চোখের সামনে। দশমীর দিন বিকালে, বৃষ্টি থামতে, দেখা গেল, প্রতিমা গলে মাটিতে মিশে গেছে। ঘটটা কি ভাগ্যি খাড়াই ছিল, সেটাতে নমঃ নমঃ করে পুজো করে, বেলচা করে ঠাকুরকে তুলে, ভাসান দেওয়া হল।“বাবার দেখি গল্প শেষ করার কোন ইচ্ছেই নেই, আমাকে বোধহয় তুত্তুরী ঠাউরেছে। শুনতে দারুন লাগলেও, ইতিমধ্যে ট্রেন অনেকটা এগিয়ে গেছে, পরের স্টেশনে নামতে হবে। কথা ঘোরাতে বললাম, “এবার রাখি? কাল এই এলাকায় ব্যাপক বোমাবাজি হয়েছে, জানতো।ক্ম্যুনাল টেনশন- “ বৃদ্ধ কথা শেষই করতে দিল না, “আরেঃ দূর দূর, সেসব কিছু নয়। খবর দেখিসনি,দু ব্যাগ পেটো পেয়েছে পুলিশ। এরকম প্রচুর পেটো জমানো আছে, মাঝে মাঝে দু একটা তো পেটো মারবেই। তোর কাছে থাকলে, তুইও-।“ কথা না বাড়িয়ে, ফোনটা রেখে দিলাম। বলেছিলাম না, বৃদ্ধ ভয়াবহ রকমের আশাবাদী।
What ever I like...what ever I feel.... form movies to books... to music... to food...everything from my point of view.
Thursday, 18 July 2019
অনির ডাইরি, ১৭ই জুলাই, ২০১৯
Subscribe to:
Post Comments (Atom)
No comments:
Post a Comment