এক,একটা দিন অমন হয়। ঘুমটা ভাঙলেই মুচড়ে ওঠে বুক। শতাব্দী প্রাচীন বাড়িটা যেন তার শত বৎসরের ওজন নিয়ে চেপে বসে বুকের ওপর। কুহকিনীর মত ডাকে পাঁচশ বছরের বুড়ি শহর। ঘুম চোখে কোনমতে জিভ পোড়ানো চাটা ঢকঢক করে গলায় ঢেলেই বেরিয়ে পড়লাম।
সবে সোয়া সাতটা, এরই মধ্যে আকাশে দেদীপ্যমান সূর্যদেব। ঐ যাঃ সানস্ক্রীনটাও লাগাতে ভুলে গেছি। চানটাও করে বেরোলেই বোধহয় ভালো হত। কি চিড়বিড়ে গরম বাপস্। কানে উপলের মধুঢালা কণ্ঠ,“তুমি জ্বরের শেষে সূর্য ধোয়া ঘর-”
খলবল করে একছুটে রাস্তা টপকে যখন গলিতে ঢুকলাম, তখনও সুবেশ অফিস বাবুদের দর্শন নেই। কালি বাড়ির মা সিদ্ধেশ্বরীকে স্যালুট ঠুকে, বন্ধ রেশন দোকানের পাশ দিয়ে, মনসাতলা টপকে এগিয়ে গেলাম। কোন এককালে খুব জাগ্রত ছিল এই মনসাতলা। পুত্রার্থে মানুষ ক্ষীরের পুতুল মানত করত নাকি, কতদিনের শখ, এমনি একটি ক্ষীরের পুতুলের ঘাড় মটাকানোর।
নটা বাজল বুঝি, দ্বিতীয় দফার চা বানাচ্ছে মা। “মা। মা। ”করে প্রবল চিৎকার জুড়েছে টুঁইটুঁই। মাকে চোখে হারায়। বাবাকে অবশ্য তেমন পাত্তা দেয় না। দরজা খুলে দিলেই, গিয়ে বসবে মায়ের কাঁধে।সবকাজ ফেলে আদর করো মা। শীতে বুকে জড়িয়ে চাদর মুড়ি দিয়ে টিভি দেখে মা। চাদরের ফাঁক দিয়ে উঁকি মারে টুঁইটুঁই। একবার মায়ের হাত ফস্কে ধড়াম করে পড়ে গিয়েছিল খাঁচা সমেত। তুই আমায় ফেলে দিলি মা? অভিমানে উড়ে গিয়েছিল টুঁইটুঁই। দুই দিন তার টিকিও দেখা যায়নি। মা উদভ্রান্তের মত ঘুরেছে বাগানে,বারন্দায়, ছাতে। দূর থেকে সমানে ডেকেছে টুঁইটুঁই-মা। মা। মা। টুঁইটুঁই ফিরে তো এসেছে, কিন্তু মাকে আর ছাড়ে না এক দণ্ডও। ভীষণ ঈর্ষা করে টুঁইটুঁই আর তুত্তুরী একে অপরকে। তুত্তুরীর মামমামকে কেড়ে নেওয়া? টুঁইটুঁইএর ঝোল একদিন খাবেই তুত্তুরী।
বাসি কাপড় কেচে শুকোতে দিচ্ছে পিসি। রোয়াকের ঐ প্রান্তে দাঁড়িয়ে মায়ের দৃষ্টির অগোচরে দিনের তৃতীয় সিগারেটটা ধরিয়েছে বাবা, হাওয়ায় মাথা দোলাচ্ছে শখের কাঁঠাল গাছ। নীল অপরাজিতার ঝুমকো ফুল ফিসফিস করে কথা কইছে, কচি উচ্ছের কানে। বুড়ো সূর্যটা এক চিলতে রোদ পাঠালো বুঝি ওদের গপ্প শুনতে।
একা এলি? তুত্তুরী একদিন স্কুল না গেলে কি মহাভারত অশুদ্ধ হত বাপু? মায়ের অভিমানী কণ্ঠের আড়ালে, বাবার ফিসফিসানি,“মাকে বললেই রেগে যাবে, একটু চা বানা না?” ব্যাগের মধ্যে তুত্তুরীর জোড়া চিঠি। “মা রোজ রাতে আমার চাদর কেড়ে নেয় মামমাম। বকে দিও তো।” “আই লাভ ইউ দাদু”।
আলমারির পাল্লা খুলতেই, থরে থরে সাজানো ফেলে আসা সময়। এই সবুজ জামাটা পরে পড়তে যেতাম। এই ফ্লুরোসেন্ট ইয়েলো সালওয়ারটা পরে কতবার ডেটে গেছি।ফ্রেঞ্চ ম্যানিকিওর করা নখগুলোকে শৌভিক ভাবত নকল বুঝি। আর এই গেরুয়া সবুজ জামাটা পরে প্রথম দেখা। সেই যে সেবার ইগারো খুলল হাওড়া ময়দানে, কত দাম দিয়ে কিনে দিয়েছিল বাবা গোলাপী সালোয়ারটা। পিঠে নীলচে এম্বর্য়ডারি ড্রাগনটা। আর এই ক্রীম কালারের টপ আর কালো রাপ আপ স্কার্টটা-
মগজ জুড়ে কুয়াশা। ক্রমেই প্রগাঢ় হচ্ছে নেশা। বহুদৃর থেকে মা বলল বুঝি,“অয় ঘুমিয়ে পড়ল বোধহয়। ” বাবা বা পিসি কে যেন বলে উঠল,“আহাঃ ঘুমোক। ঘুমোক।”
তারপর অভিমানী গলায় ক্লুনি সাহেব বললেন,“কি হবে, আর পুরোনো দিনের কথা আজ তুলে?”সেই যে উঠতি বয়সে মাথা চিবানো বুদ্ধদেব গুহ, “ভালোবাসার পুরুষকে কখনই বিয়ের বাঁধনে বেঁধো না।” সেই জন্যই তো ক্লুনি সাহেব-। তুমি বুঝি আজও আমায়-। তাই বলে পায়ের আঙুল মটকাচ্ছ কেন? আর এত ডাকাডাকিই বা কিসের।
বাতানুকূল যন্ত্রের মৃদু বুঁমরো বুঁমরোর তালে ফুরফুরিয়ে ঘুরছে পাখা। গায়ে কখন যেন চাদর চাপা দিয়েছে মা, নাকি বাবা। তাই বলে, এত মধুর স্বপ্ন কেউ ভাঙায়? জবাবটা শোনা হল না যে, পিসির হাতে গরম জিলিপি। “ওঠ রে। তোর জন্য এই রোদে আধঘন্টা লাইন দিয়ে নিয়ে এলাম। ” ঘড়িতে দেড়টা। মা হাঁ হাঁ করে উঠল,“ভাত খাবি তো। এখন নয়।” ততোক্ষণে খাঁটি বাঙালী টকটক বিউলির ডালের কিটকিটে মুখ পোড়ানো জিলিপি মন্থন করছে অমৃতসাগর।
প্রিয়তম ক্লুনি সাহেব, তুমি একটু জিরোও। পরে দেখা হবে। আপাততঃ অনেক কাজ বাকি। ভাত খেয়েই দৌড়তে হবে বাড়ির পথে, একজন বসে আছে যে, তিন তিনটে হাত পা কাটা পুতুল ছানা “জগু-বলু আর সুভু”কে নিয়ে। তারা রথে চাপতে চায়। রথ চেপেছে বাঙ্কের মাথায়। নামাতে হবে,সাজাতে হবে।তালপাতার সেপাই ঘোড়ার গলায় পরাতে হবে দড়ি, তারপর টানতে টানতে ঠাম্মার বাড়ি। পথে লুটিয়ে পড়বে ঘোড়া। চিৎপটাং হবে, জগু আর তার ভাইবোন।ধুৎ তেরি বলে রথের রশি ছেড়ে দেবেন সারথী। অতঃপর সদলবলে মায়ের ঘাড়ে চাপবেন, চালাও পানশি ঠাম্মা-দাদুর বাড়ি। ধেড়েটা বাদে আগামী সাতদিন, তেনারা সেখানেই থাকবেন কিনা। সেই আনন্দে জিলিপি খাওয়াবে দাদু। আপনারাও খান না, গরম গরম জিলিপি আর মুচমুচে পাঁপড় ভাজা।শুভ রথযাত্রা। ভালো থাকবেন সকলে।
No comments:
Post a Comment