Sunday 7 July 2019

অনির ডাইরি ৬ই জুলাই, ২০১৯







রথের মেলা তো বসতো, আমাদের হাওড়া ময়দানে, সে না জানি কবেকার কথা। তখনও শরৎসদন তৈরি হয়নি। মোটামুটি পঞ্চাননতলা থেকেই বসে যেত কাঠের হাতে ঘোরানো চৌকো বাক্সের মত নাগর দোলা, তারপাশে লাল ঝালর দেওয়া চাঁদোয়ার নীচে গোল করে  ঘুরত, ঝুলন্ত হাতি- ঘোড়া-কুমীরের দল।পুঁইইইই করে বাজত তালপাতার বাঁশি।করররকটকট করে চিৎকার করে উঠত ব্যাংবাজি। ঘোলাটে মেঘলা আকাশে ওড়ার তাল কষত রঙ বেরঙের গ্যাস বেলুন, ফুঁ দিলেই বনবন করে ঘুরত নীলগোলাপি কাগজের পাখা। ত্রিপল টাঙিয়ে বসত, মাটির পুতুলের পসরা। তাদের মধ্যেই যে গুলো কৃষ্ণনগরের, তাদের দেমাক ছিল খুব, হাত দিলেই ছাঁকা লাগত, কি দাম বাপস। সারি সারি বসত গরম জিলিপির দোকান, বিক্রি হত, সর্ষের তেলে ভাজা ইয়া বড় বড় পাঁপড়, চুড়া করে বিক্রি হত, গুড়/চিনি কটকটি, খোলা শুদ্ধ বাদাম ভাজা, বিক্রি হত বটি, কাটারি, কাঞ্চননগরের ছুরি, কাঁচি, কাঠের চিরুনি,খাঁচায় ভরে বিক্রি হত,ঝিমনো টিয়া পাখির দল। গলার কণ্ঠীর ওপর কারো মাথাটা লাল, কারো নীল, কারো বা হলদে-সবুজ। বাবার হাতেপায়ে ধরে, একবার আদায় করেছিলাম একটা টিয়া। ২০টাকা দিয়ে কেনা পাখি, ঐ টাকায় তখন এক ব্যাগ বাজার হত, মেয়ের জেদের কাছে পরাভূত বাবার অবিমৃষ্যকারিতার জন্য কত কথাই যে শুনতে হয়েছিল বাবাকে। পাখি নয়তো, প্রাণপাখি, শখ করে নাম রেখেছিলাম, মদনমোহন। সপ্তাহখানেকের বেশী বাঁচেনি মদনমোহন। মনকে আজও প্রবোধ দি, হয়েই তো এল, শীঘ্রই আবার দেখা হবে, ভবসিন্ধুর ঐ পাড়ে-
রথ নিয়ে কত যে স্মৃতি, সেই যে সেবার এক তুতো মাসির শাশুড়ি কাউকে কিছু না জানিয়ে ঠিক করে বসলেন, জগন্নাথ দেবের রথের রশির খণ্ডিতাংশ ওনার চাইই চাই। ঐটি যদি জোটাতে পারেন, তো ব্যাস, স্বয়ং সৌভাগ্যলক্ষ্মী স্বযাচিত হয়ে আপনার করতলগত হবেন। কিন্তু, জগন্নাথে ভেজাল থাকলে চলবে না, রশি হতে হবে, নির্ভেজাল  অকৃত্রিম “জগন্নাথ দেব অব শ্রীক্ষেত্রের” রথের। শ্রীক্ষেত্রে পদার্পণ করে, যখন উনি নিজের অভীপ্সা ব্যক্ত করলেন, বাকিদের অবস্থা কি হল, বুঝতেই পারছেন। ছোট মাসি আর মেসোমশাই, রীতিমত সারাদিন ধরে কাউন্সেলিং করলেন, বিদেশ বিভূঁই বলে কথা, একটা মারও বাইরে পড়বে না। অতি কষ্টে তাঁকে নিরস্ত করে, সকলে বেরোলেন রথ দেখতে। রিস্ক না নিয়ে, খোদ ছোট মেসো আর বড় মাসি দুদিক থেকে ঘিরে রইলেন ভদ্রমহিলাকে,আশেপাশে চক্রব্যূহ বানিয়ে রইল বাকিরা। কোন বেচাল দেখলেই, সোজা গোল করে ঘিরে ফেলা হবে। রথ কাছাকাছি আসতেই, পড়ে গেল হুড়োহুড়ি। কে যেন, বড় মাসির সিটিগোল্ডের হারটা ধরে মারল এক হ্যাঁচকা টান, বড় মাসি, চিৎকার করে উঠল, “আমার হার, আমার হার”। ছোট মেসোমশাই ঘাবড়ে গিয়ে বললেন, “ কি হল?কি হল? কি গেল?কি গেল?” প্রাথমিক ঘেঁটে যাওয়া অবস্থা কাটিয়ে,  সবাই যখন সম্বিৎ ফিরে পেলেন, ভদ্রমহিলা ততোক্ষণে বেপাত্তা। খুঁজে খুঁজে হয়রান হয়ে, বাসায় ফিরে দেখা গেল, উনি প্রসন্নবদনে, আমাদেরই প্রতীক্ষারত। শুধু আশ মিটিয়ে রথই টানেননি, সকলের অগোচরে, শাড়ির ভাঁজ থেকে নতুন ব্লেড বার করে, কুচ করে কেটে নিয়েছেন, খানিকটা সুতো।
হুগলীতে এসে ইস্তক শুনছি, গুপ্তিপাড়ার রথের কথা। মাহেশের তুলনায় প্রচার অনেক কম, তবে ঐতিহ্য এতটুকুও কম না। দূরদূর থেকে মানুষ আসেন, গুপ্তিপাড়ার রথ দেখতে। জমিয়ে বসে রথের মেলা বসে। রথের দিন কয়েক কিলোমিটারের মধ্যে গাড়ি নিয়ে ঢোকা যায় না, অন্যদিন তুলনামূলক ভাবে ফাঁকা। শুক্রবার, যাচ্ছি যাব করে কাজ গুটিয়ে,অফিস থেকে বেরোতে বেরোতেই বেজে গেল সোয়া পাঁচটা। পথপ্রদর্শক আমাদের শ্যামল। পিপুলপাতির মোড় হয়ে, হুগলী ঘাটের তলা দিয়ে, গাড়ি গড়াল আসাম রোডের পথে। হাইরোডের সমান্তরালে দৌড়য় রেলপথ, কখনও দৃশ্যমান, কখনও অদৃশ্য। গুপ্তিপাড়া কাটোয়া লাইনে একটা ছোট্ট ষ্টেশন। এদিকের ষ্টেশনের নাম গুলো খুব মিষ্টি, মগরা, বাঁশবেড়িয়া, ত্রিবেণী, কুন্তিঘাট,জিরাট, বেহুলা, গুপ্তিপাড়া-। ঘিঞ্জি শহর ছাড়ালেই, খোলা সবুজ মাঠ। জানলা দিয়ে বিনা অনুমতিতে ঢুকে আসে, টাটকা জোলো হাওয়া। বলাগড় ব্লক শুরু হতে না হতেই, শ্যামল সাধতে শুরু করল, “ম্যাডাম, আমাদের গাঁয়ের মন্দিরটা একবার দেখতে চলুন। বেশীক্ষণ লাগবে না। মন্দিরের গায়েই গাড়ি দাঁড় করাব, পাক্কা দুমিনিটের বেশী নেব না। দেখবেন কত বড় মন্দির। সাড়ে তিনশ বছর আগের মন্দির ম্যাডাম। কত লোক ভোগ খায়, একটি বার চলুন-।“
গ্রামের নাম, ডুমুরদহ নিত্যানন্দপুর। মন্দিরটি আপাত বিশেষত্বহীন, তবে পরিবেশটি বড় মনোরম। কোন দেবতার মন্দির সেটি উল্লেখ করে, চাকরিটিকে আর বিপদগ্রস্ত করতে চাই না।
 মেলায় পৌঁছতে পৌঁছতে বাজল সাড়ে ছয়। মেলায় ঢুকেই প্রথম যে অনুভূতিটা হল, আরেঃ এতো আমার শৈশবের হারানো মেলা। সেই রেশমি চুড়ি, মাটির পুতুল, হাড় জ্বালানো ব্যাঙ বাজি, বাসনপত্র, সারিসারি জিলিপির দোকান থেকে ভেসে আসা মনমাতান সৌরভ। চুড়ো করে রাখা খোলা শুদ্ধ বাদাম আর গুড় কটকটি। পাঙ্খা বরফ, কাগজের ফুল, ঘর সাজানোর জিনিসপত্র। পুরো মেলা ঘুরে দেখার সময় ছিল না। তারই মধ্যে তুত্তুরীর জন্য কেনা হল কাঁচের চুড়ি।কেনা হল মাটির পুতুল, শ্যামল কিনল কাগজের ঘুরঘুরে নীল-গোলাপি পাখা, রমেশ বোধহয় যা পাওয়া যাচ্ছে সবই কিনে ফেলল, কেনা হল, গরম গরম মথুরা কেক। পাতি বিলিতি ডোনাট, শুধু বেকড নয়, খলখলে করে তেলে ভাজা। কাগজে মোড়ার আগে তার ওপর ছড়ানো হল আইসিং সুগার। কেনা হল লেবু লেবু গন্ধ আর নুন মাখানো পপকর্ণ। গুড় না চিনি তর্ক করতে করতে কেনা হল, গরম গরম জিলিপি। গুপ্তিপাড়া হল সন্দেশের জনক, এখানকার গুপো সন্দেশ অমৃতসমতুল। গুপ্তিপাড়ায় গিয়ে, গুপো সন্দেশ  না কেনা গর্হিত অপরাধ, কাজেই? 
কলাবেচা তো হল, এবার রথ দেখার পালা, ঘড়ি বলছে, সাড়ে সাত। এখান থেকে চুঁচুড়া যেতেই লাগবে আরও ঘণ্টা দেড়েক, সেখান থেকে বাড়ি বোধহয় মধ্যরাতে পৌঁছব। সে হোক। রথ দেখে জুড়িয়ে গেল প্রাণ। কি অপরূপ সুন্দর রথ, হ্যাংলার মত ছবি তুলছিলাম আমরা, বর্মণ সাহেব, প্রীতি আর আমি, শ্যামল, ছুটে এসে বলল, “করেন কি? এটা তো রথের পিছন দিক।“  ইয়ে যার পশ্চাৎদেশই এত মনোরম, না জানি, তার অগ্রভাগ কি হবে? আশা করি বলার অপেক্ষা রাখে না। স্বয়ং বিচার করুন। প্রায় মিট্মিটে আলোয়, ঘিঞ্জি দোকান বাঁচিয়ে মুঠোফোনে ভাগাভাগি করে তোলা। আটটা নাগাদ যখন তাড়িয়ে সকলকে নিয়ে ফিরছি, শ্যামল তখন জনে জনে জিজ্ঞেস করতে ব্যস্ত, “ কোনটা দিয়ে রথে চড়া যায় গো? ও ম্যাডাম, দাঁড়ান, যাবেন না। এতদূর থেকে এলেন, রথে একবার চাপবেন না?” গুটি কয়েক গুড়গুড়ে রথে চেপেছে বটে, তাই বলে, আমি?ছেলেটার জীবনে বুদ্ধি হবে না মাইরি, সাধে শ্যামলের ওপর চটে যাই?

No comments:

Post a Comment