Thursday, 25 July 2019

অনির ডাইরি ২৪/০৭/১৮


দৃশ্য-১
"ম্যাডাম!" "বলুন?"
“ট্রেড ইউনিয়নের কি জেনারেল ম্যানেজার হয় ম্যাডাম?”
“কেন বলুন তো?কি হল আবার?এটা জানতে ফোন করেছেন সক্কাল সক্কাল?”
“আপনার পাঠানো চিঠির খামে ঠিকানা লেখা, প্রতি, জেনারেল ম্যানেজার, অমুক ট্রেড ইউনিয়ন-”
সর্বনাশ। কে লিখেছে? সোমনাথ? প্রীতি? রণিত? মান সম্মান আর রাখলে না দেখছি, জুট মিলেরটা জেনারেল ম্যানেজার আর ট্রেড ইউনিয়নেরটা জেনারেল সেক্রেটারি, তেলে আর জলে মিশিয়ে দিয়ে বসে আছো? আমার চিঠি দেখে টুকতে গিয়েও ভুল? কাজের সময় মন কোথায় থাকে?
দৃশ্য-২
“ম্যাডাম, আমি এত কম টাকা কেন পেলাম?”
“উ?”
“আমি জানতে চাই, আমায় এত কম টাকার অর্ডার করলেন কেন?”
“আরে বাবা, আপনি যা কাগজপত্র দিয়েছেন, তার ওপরেই তো ক্যালকুলেট করব? ফাইন্ডিংস্ টা পড়ে দেখুন, তাতে সিঁড়ি ভাঙা অঙ্কের মত সব বলে দেওয়া আছে, কিভাবে আমি নির্ধারণ করলাম, আপনি কত টাকা পেতে পারেন।“
“আপনি তো শুধু ম্যানেজমেন্টের আর্গুমেন্ট শুনলেন, গরিবকে তো সুযোগই দিলেন না। উনি আমাকে জেরা করলেন, অথচ আমি ওনাকে করতে পারলাম না।“
“আপনার উকিল করল তো? আপনার সামনে প্রশ্নোত্তর চলল, আপনি সই করলেন?”
“সে তো আমার উকিল করল। উনি তো আর আমার কথা জানেন না?” 
“উফ ভগবান!”
দৃশ্য-৩
“ম্যাডাম আসব?”
“বলুন এবার আপনার কি চাই?”
“ম্যাডাম আপনার লোক তো কই জানালো না? কটা মাল চাই। কিনে ছাপাতে হবে তো, আমার লোক মাল আনতে কলকাতায় গিয়ে বসে আছে।“
“কি যন্ত্রণা। রমেশ? শ্যামা বাবুকে জানাও নি? একটা কাজ কি কেউ সম্পূর্ণ কর না? সব আমার মাথায় চাপাতে হবে?”
“আচ্ছা। ম্যাডাম। সরি ম্যাডাম। আপনি রেগে যাবেন না ম্যাডাম এখুনি জানাচ্ছি।”
“সেটা ছাড়ো। এখনও জানানো হয়নি কেন? জবাব দাও?”
“কি করব ম্যাডাম, প্রমিত বাবু বললেন, ‘মেলে আছে দেখে নে।‘”
“বাঃ। কি আনন্দ। আমিই দেখি তাহলে? যত সব-”
দৃশ্য-৪
“ম্যাডাম, আপনার চা নিয়ে আসি?”
“হু।“
“সাদা না কালো?”
“যা খুশি। প্রচন্ড মাথা ধরেছে, একটু কড়া হয় যেন। আর পুঁচকে কাপে নয়।”
“বুঝতে পেরেছি। আমার খাবার গ্লাসটা মেজে আপনাকে দিচ্ছি দাঁড়ান।“
“আরে ধুর বাবা। অতো চা কি করব? স্নান?”
দৃশ্য-৫
“আসছি?ম্যাডাম।”
“বলুন?এই আপনারা এই সেদিনই ডেপুটেশন দিয়ে গেলেন না?”
“ হ্যাঁ। সেগুলো সব পেয়ে গেছি ম্যাডাম। আজ আরো কয়েকটা কেস দিলাম, একটু বলে দেবেন যেন ছেড়ে দেয়।“
“সে তো এমনি দেবে। সব কাগজ পত্র ঠিক থাকলে আর কি চাপ?”
“তবু ম্যাডাম, আপনি জানেন না কি করুণ অবস্থা ওদের, রাস্তা তৈরি করতে গিয়ে গরম পিচের ড্রাম উল্টে পড়েছিল, ছেলেটি গায়ে।বেঘোরে মারা গেছে। “
“ইশ।”
“আরো শুনবেন ম্যাডাম? ছয় বছরের বাচ্ছা মেয়ের মাথায় টিউমার, বাবা-মায়ের কি মানসিক অবস্থা ভাবুন। সর্বস্বান্ত  হতে বসেছে ম্যাডাম।লোকটি রিক্সা চালায়। বউটি সেলাই দিদিমণি। কোথায় পাবে? সাড়ে চার লাখ টাকা খরচা হয়ে গেছে, আবার ভেলোর যাবে-”।
দৃশ্য-৬
-ম্যাডাম, লাইফ সার্টিফিকেট সই করাব, এখন আসব? না কি টিফিন হয়ে গেলে?
-টিফিন তো আসেই নি। আপনিই আসুন। কি করতেন?
- বাস চালাতাম।
-এখন চালান না?
-উ হু।
-কেন? চোখ?
- চোখ নয় ম্যাডাম, আমি ৩৫ বছর অমুক রুটে বাস চালিয়েছি, কিন্তু তখন এতো ছোট গাড়ি ছিল না ম্যাডাম, আর ছেলেপুলেও এতো বিপজ্জনক ভাবে বাইক চালাতনি।
-হু। তা আপনি ৩৫ বছর বাস চালিয়েছেন, কটা লোককে টপকেছেন?
- হেঁহেঁ, না ম্যাডাম, মানুষ না, তবে বার কয়েক গরু-
দৃশ্য-৭
-“ম্যাডাম, টাকা ঢুকে গেছে, অসংখ্য ধন্যবাদ।“
“অ্যাঁ? টাকা? কিসের টাকা?”
“দুলাখ টাকা? অ্যাক্সিডেন্টাল ডেথ।“
- “আরেঃ বাঃ। খুব ভালো? তা বেনিফিশিয়ারি কোথায়? তার তো একটা ছবি তুলে রাখতে হবে, নোটিশ বোর্ডে।“
- “সে তো স্বর্গে চলে গেছে ম্যাডাম। তার বউ চলবে?
দৃশ্য-৮
- ম্যাডাম আসছি?
- কি চাই?
- ম্যাডাম চিনতে পারছেন? সেই যে দেখা হয়েছিল? অমুক দপ্তর-
- অ। বলুন কি চাই?
- ম্যাডাম, শুনুন না, আগের বার আপনি অনেক হেল্প করেছিলেন, এবারো একটু করে দিন না। বেচারা বুড়ো মানুষ, কটা টাকার জন্য দরজায় দরজায় ঘুরছেন।
- কিসের টাকা?
- পি এফ।
- এই ভাগো। পি এফ আমার অফিসের দায়িত্ব নয়।
- জানি ম্যাডাম। আপনি তো আগের বার বলে দিলেন পিএফ কমিশনারের অফিসে যেতে। আমরা গিয়েছিলাম, ওনারা একটা ফর্ম দিয়েছেন, ইনি বুঝতে পারছেন না, কি করে ফিল আপ করে। একটু বলে দিন না-।”
দৃশ্য-৯
- আবার আপনারা? না। না। আমি আর কোন মানুষের দুঃখ দুর্দশার গপ্প শুনব না। প্রচুর কাজ।
- শোনেন না ম্যাডাম, একটা প্রতিকার তো চাই, একজনের বই হারিয়ে গেছে।
- ইন্সপেক্টরকে বলুন ও ডুপ্লিকেট বার করে দেবে। এই জন্য আমায় জ্বালানোর কি কোন দরকার আছে?
- জানি ম্যাডাম। আমি কি আর আজ থেকে ট্রেড ইউনিয়ন করছি? আপনি হয়তো তখনও জন্মাননি, তখন থেকে এই গরীব মানুষ গুলোর জন্য খাটছি। ডুপ্লিকেট বার করতে হলে তো বইটার নম্বর চাই।
- -ও। তাও নেই? ভালো। টাকা দেবার রসিদ? তাও নেই? অসাধারণ।যে বলবে কাক এ কান নিয়ে গেছে, অমনি আপনি এসে আমায় জ্বালাবেন?
- কি করব ম্যাডাম, এসব নিয়েই আছি। জানেন তো আদিতে আমরা পূর্ববঙ্গের অধিবাসী, বাবা সম্পত্তির মায়া ত্যাগ করে ১৯৪২এ এদেশে চলে এসে ডানলপে চাকরী নেন, তাই আমাদের ভাইবোনেরা আজ সবাই মাথা তুলে দাঁড়াতে পেরেছি, মাঝে মাঝে ভাবি, জানেন, যদি বাবা, বাড়ি জমি আঁকড়ে পড়ে থাকত, কি হত? ৭২এ পালিয়ে আসতে হত এক কাপড়ে। তখন আমার মা হয়তো লোকের বাড়ি বাসন মাজত আর বাবাকে ভ্যান রিক্সা চালাতে হত-
এতরকম মানুষ আর এত ধরণের আবেগ অনুভূতিস্নাত হয়ে বাড়ি ফেরার পথে ভুলেই যাই, আজ ভোরে অ্যালার্মের কর্কশ শব্দে কাঁচা ঘুম চটকে যাবার হতাশায় মনে হয়েছিল কি সাংঘাতিক বর্ণহীন আমার।কাজের সাথে ভালোলাগা আর ভালোবাসার নিবিড় সম্পর্কের ফলে আপাতত পূর্ণ এ ঝুলি।  আপাততঃ বড় বেশী রঙীন এ জীবন।  কাল সকাল অবশ্য আবার অন্য বার্তা বহন করে আনবে- এই তো জীবন কালি দা।

No comments:

Post a Comment