#স্বপ্নের_মত_ইস্কুলবাড়ি
সে অনেককাল আগের কথা। আশির দশক। সকাল হত উনুনের ধোঁয়া আর বহুদূর থেকে ভেসে আসা আকাশবাণীর প্যাঁপো প্যাঁপো সুরে। অতঃপর যেন ইথারে ভেসে আসত, কার মধুঢালা কণ্ঠস্বর,“নমস্কার। ইয়ে আকাশবাণী হ্যয়”।
তখনও আমাদের হাওড়া শিল্পনগরী। বার্ন স্টান্ডার্ড, গেসকিন উইলিয়ামস্ রমরমিয়ে চলছে। আনন্দবাজার আর যুগান্তর হাতে, মেরি( এখনকার মারি) আর থিন অ্যারারুটের সাথে তুফান ওঠে চায়ের কাপে। পাড়ার চায়ের দোকান গুলোতে চলে কত যে দুনিয়া কাঁপানো, তাত্ত্বিক আলোচনা। তারই সাথে পাল্লা দিয়ে চলে পাড়ার পুজোর নাটকের প্রস্তুতি, নববিবাহিত দম্পতির বাড়ির দোরগোড়ায় কার্তিক ফেলে তাদের হাড় জ্বালাবার ষড়যন্ত্র। বাঙালী তখন গাঁতিয়ে বই পড়ে। গমগম করে পাড়ার লাইব্রেরি গুলো।
কদমতলা বাজারের একপাশে ছিল বিশাল ঐতিহ্যশালী ব্যাঁটরা পাবলিক লাইব্রেরী।বাজারু বাবুরা বাজারে ঢোকার আগে ঢুঁ মারতেন হেথায়। একতলার বিশাল হলঘরে মধ্যমণি পালিশচটা লম্বাটে কাঠের টেবিলের ওপর স্তুপিকৃত বিভিন্ন প্রকাশনীর খবরের কাগজ। দোতলা জুড়ে বইয়ের গোলকধাঁধা। এই লাইব্রেরির একপাশে ছোট্ট স্কুল, যার নামও ব্যাঁটরা পাবলিক লাইব্রেরি স্কুল। লাইব্রেরির দাক্ষিণ্যেই চলত বোধহয়। তবে চলত ভালোই। দুটি মাত্র ক্লাশ- নার্সারি আর প্রিপেরেটারি।
বাবামায়ের কোলে চেপে লাইব্রেরিতে প্রথম প্রবেশ। জনৈকা বয়স্কা মহিলা, পরণে সাদাসিধে করে পরা সাদা থান, কোল থেকে নামিয়ে হাত ধরে নিয়ে গেলেন একটা ছোট্ট ঘরে। অনেকটা দইলে ডাক্তারের(পেট টেপা, গলায় চামচে ঢোকানো আর তেঁতো ওষুধ খেতে দেওয়া পারিবারিক ডাঃ দলুই) চেম্বারের মত। শুধু ওষুধের কটু গন্ধ, আর “শুয়ে পড়” মার্কা খাটটাই যা মিসিং। বসে ছিলেন এক তুলনামূলক স্থূলাঙ্গী মহিলা। অনেকটা কালো ফ্রেমের, মোটা চশমা পড়া বয়স্কা সুমিতা স্যান্যালের মত দেখতে। তিনি কোলে তুলে নিলেন। পরে জেনেছিলাম ,উনি হেডমিস্ট্রেস। নাম শীলা দি। শীলাদির কোলে বসে,ছবির বই দেখে, কি যে পাকামি মারলাম। বাড়ি ফেরার পথে, ঐটুকু রাস্তাও বাবা রিক্সা করে নিয়ে এল।মা বোধহয় ৪০টা চুমুই খেয়ে ফেলল। এমন স্কুল যদি স্বপ্নের মত না হয়,কোনটা হবে হে টানটিন। হোক না বাজারের মধ্যে পুঁচকে স্কুল।
মেরুন রঙের টিউনিক, সাদা জামা। পিঠের জন্য হলদে চটের ব্যাগ। পিট্টু টাইপ। নতুন গোল স্টিলের টিফিনে বক্স। তাতে খোদাই করা আমার নাম। যাকে আমি কর্মজীবন পর্যন্ত ব্যাগে করে বহন করেছি। তিনি আজও বহাল তবিয়তে বিরাজমান, মায়ের রান্নার ক্যাবিনেটে। টিফিনে একচেটিয়া আব্দারি(মানে প্রায় জুলুম করে আদায় করা) মিল্ককেক। স্কুল চালু হতে না হতেই স্বপ্নভঙ্গ।অফিস ফেরতা মায়ের পায়ের ওপর দিয়ে চলে গেল সিমেন্টের বস্তা বোঝাই ঠেলা গাড়ি। স্কুলে যাওয়া ডকে উঠল।
তিন মাস পর, বাবা গিয়ে অনুরোধ করলেন শীলাদিকে। শীলা দি দোদুল্যমান চিত্ত, ‘ও কি পারবে?” অনুমতি পেয়ে শুরু হল স্কুল যাওয়া। বেশ মজার স্কুল।একতলায় অফিস আর শৌচালয়,বোধহয় কমনরুমও। দোতলায় নীলচে পর্দা দিয়ে ভাগ করা করা ক্লাশরুম। টিচার অন্যমনস্ক হলেই পর্দা সরিয়ে পাশের ক্লাশে মুণ্ডু গলানো। পর্দার ওপর নীচে দিয়ে এন্তার কেলাকেলি, চুলটানা, ভেঙচি কাটা আর গাঁট্টা। টিচার দেখতে পেয়ে হুঙ্কার ছাড়লেই,পেন্টুলের রঙ পরিবর্তন। এ হেঃ হেঃ।
পড়াশোনা কম, নাচগান বেশী। প্রতিবেশী ক্লাসে মুণ্ডু গলানোর জন্য কি না জানি না, রোজই কেউ না কেউ ক্লাশে ইয়ে করে ফেলত। আয়া মাসিরা এমনিতে বেশ ভালোই ছিলেন। ছোট কাজ করলে দিব্যি সাফসুতরো করে, পাউডার মাখিয়ে, স্পেয়ার জামা পরিয়ে আবার ফিটফাট করে দিতেন। শুধু পেন্টুলের রঙ পাল্টে ফেললেই হয়ে যেত মটকা গরম। বিশেষতঃ এক বুড়ি মাসি ছিল, “কাল রাতে কি খাইছিলা?” বলে শুরু হত ঝাড়। ঝাড়ের চোটে অলিভিয়া বলতও না, গোটা ক্লাশ সুরভিত হয়ে জানান দিত, আজ অলিভিয়া মঞ্চে অবতীর্ন। তবে হাইট হয়েছিল, যেবার মাসির বকুনীর ঠেলায় দেবদত্ত আবার করে ফেলেছিল। রামঃ। রামঃ।
বেলা বারোটায় ছুটি। ক্লাশ থেকে নীচে হলঘরে নেমে কোস্তাকুস্তি করা।কোঁৎকা মারার নেট প্রাকটিশ, তারপর যার নাম ডাকা হবে সে বাকিদের ভেঙচে, গুঁতিয়ে একপাক নেচেই দৌড়। যার পরণে টাটকা জামা, বগলে পাউডারের খুশবু, তার বাবামায়ের সেদিন লজ্জায় অবনত মস্তক। “কাল রাতে কি খাইছিলা”!
কটা দিন বাবা-মা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে নিয়ে এল। তারপর দেওয়া হল আয়া মাসির জিম্মায়। এণারা ঐ ইয়ে সাফ করা টাইপ নন, এণাদের কাজই হল, স্কুল থেকে একপাল এঁড়ে-বকনা বাছুরকে গলায় দড়ি বেঁধে নিয়ে বেরোনো, এবং পোস্টম্যানের মত বাড়ি বাড়ি দিয়ে খোঁটায় বাঁধা। হাতে একটা ছড়ি নিলে পাক্কা ডগ ট্রেনার মাইরি।
প্রথম কদিন কনক দি, তারপর পান্না দির ওপর দায়িত্ব পড়ল। কনকদি বেশ রাগী ছিলেন। পান্নাদি মাটির মানুষ। ফলে আমাদের বাঁদরামি বাড়তে লাগল লাফিয়ে লাফিয়ে। সবকটা ব্যাগ হাতে ঝুলিয়ে, সবার হাত ধরে, ঐ রোদে সাধাসিধে শাড়ি পরা পান্নাদি যখন কারো বাড়ি গিয়ে কড়া নাড়তেন, পলকে ময়দান সাফ। যে যার বাড়িতে পারতাম ঢুকে যেতাম। দিনকালও কত ভালো ছিল, এখন ভাবলে তাজ্জব লাগে। একজন দাদু বসে থাকতেন,বারন্দার ইজিচেয়ারে, আগে তাঁকে দেখতে যেতাম। দেখতে পেলেই,কপালে হাত ঠেকিয়ে বলতেন,“পেন্নাম হই মহারাণী।” কোনদিন বলতেন,“মহারাণী ভিক্টোরিয়া। ” উফ্ ফূর্তির প্রাণ গড়ের মাঠ। দ্বিতীয় বাড়িতে কড়া নাড়ার পর, পালিয়ে একটা বড় বাড়ির উঠোনে। চৌবাচ্ছায় খানিক জল ছপছপ করতে না করতেই পান্নাদি কোলে করে ধরে নিয়ে যেত। কি ভাবে টের পেত কে জানে? এমনই এক বাড়িতে এক বুড়ি ঠাকুমাকে একবার বলেছিলাম,“কি করছ?ডিম সিদ্ধ বুঝি? আমি ডিম খেতে খুউব ভালোবাসি”। উনিও চমকে যাওয়া সুরে বলেছিলেন,“হ্যাঁ মা, তোমার জন্যই তো করছি”। পান্না দি সেবার সময়মত শুধু উদ্ধার করেছিলেন তাই নয়, কান ধরে অনেকটা হাঁটিয়েছিলেন। হ্যাংলামোর একটা সীমা থাকা উচিৎ।
দেখতে দেখতে কবে যে নার্সারি-প্রিপেরেটরি শেষ হয়ে গেল। শেষ ফাংশনে নাচলাম,সেবার তাসের দেশ নৃত্যনাট্য হয়েছিল। সেই প্রথমবার মেক্যাপম্যান এসেছিল। নাচগান শেষে, শীলাদির মনকেমন করা ভাসন। ততোদিনে স্কুল শেষের মর্ম বুঝে গেছি সকলে,আর দেখা হবে না। কোনদিনও না। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে শুরু হওয়া কান্না ক্রমে ডুগরে ডুগরে উঠল। বাবা মায়েরাও অনেকে চোখের জল ধরে রাখতে পারলেন না। যেভাবে বাবার হাত ধরে প্রথম পা রেখেছিলাম,তেমনি এবার ফেরার পালা।যতই স্বপ্নের মত হোক ইস্কুলবাড়ি,স্বপ্ন তো একসময় ভাঙে নাকি? ভাঙতেই হয়, যখন ডাক পাড়ে জীবন, ঐ যে ফিরিঙ্গী ভাষায় বলে না,“লাইফ ইজ কলিং”।
No comments:
Post a Comment