Sunday, 8 January 2023

অনির ডাইরি ২৩ শে ডিসেম্বর, ২০২২

 


#তাম্রলিপ্তকড়চা  #অনিরডাইরি


টিম তাম্রলিপ্তর মুখপাত্র হিসেবে রীতিমত গর্বিত আমি। কি নেই, কে নেই আমার টিমে। ধর্ম নিয়ে আদৌ মাথা না ঘামানো লোকজন আছে, ঘোরতর নাস্তিক আছে, আছেন ধর্মপ্রাণ হিন্দু এবং মুসলমান, devout ক্রিশ্চান আছে, ভারত বর্ষের অন্যতম প্রাচীন ধর্ম যার নাম ‘সারি ধরম’ যেখানে প্রকৃতিই পরম এবং চরম উপাস্য সেই ধর্মের মানুষ আছেন, এমনকি আছে টিকিওয়ালা তিলককাটা বৈষ্ণব ও। মাছ-মাংস-ডিম -পেঁয়াজ-রসুন ছাড়ুন দীক্ষা না নেওয়া মানুষের হাতে অন্ন গ্রহন পর্যন্ত করে না ছেলেটি। একবার দুয়ারে সরকারের ক্যাম্প দেখে ফেরার পথে প্রবল বিষম খেয়েছিলাম আমি, জুন মাসের বেপোট গরম, ঠিক সেই মুহূর্তে এক ফোঁটাও জল অবশিষ্ট ছিল না আমার বা উত্তমকুমারের বোতলে। ছেলেটা সামনের সিট থেকে চটজলদি নিজের বোতল বার করে ধরেছিল আমার মুখের সামনে। জীবনে প্রথম বার বেজায় ভয় পেয়েছিলাম আমি,‘হ্যাঁ হে তোমার বোতল আমায় দিচ্ছ কেন? আমি তো দূর আমার বাপ-পিতেমহ ও কোনদিন দীক্ষা নেননি আর আমি কি রকম আমিষাশী তো জানোই। তোমার জল ছুঁলে দোষ হবে যে।’ ছেলেটা তাতে রেগে গিয়ে বলেছিল, ‘আপনি খান  তো।’ 


 এত বিচিত্র ধর্ম এবং বর্ণের সমাহার বলে, ঝোলেঝালে অম্বলে উৎসব লেগেই থাকে এ আপিসে। হোক না দরিদ্র শ্রম দপ্তর। আনন্দ আর উৎসবের আবার কুলীন অকুলীন কি? 


নগর বদল, বাসা পরিবর্তন এবং শ্রীমতী তুত্তুরীর নতুন স্কুলে ভর্তি তথা থিতু হবার জন্য কয়েকদিন ছুটি নিয়েছিলাম। ছুটি কাটিয়ে যখন কাজে ফিরলাম বড়দিনের ছুটি পড়তে বাকি মাত্র দিন চারেক। জনে, জনে আলাদা ভাবে এসে বলে গেল,‘ এদ্দিনে আপিসটা আবার প্রাণ পেল ম্যাডাম।’ কোন এক শ্রমিক সংগঠনের দুই বয়োজ্যেষ্ঠ প্রতিনিধি তো রীতিমত হুমকি দিয়ে গেল, ‘ স্যার(শৌভিক) গেলেন, গেলেন, আপনাকে আমরা কোথাও যেতে দিচ্ছি না। যত প্রমোশন আছে, সব পান, কিন্তু এখেনেই থাকেন।’ আরেকদল এসে একখানা একটা কাঠের পাল তোলা নৌকা উপহার দিয়ে গেলেন। ‘ অমুক রাজ্যে আমাদের জাতীয় অধিবেশন ছিল, এই ছোট্ট স্মারকটা ওখান থেকে আপনার জন্য কিনে এনিছি।’ 


আমার টিমের পাশাপাশি এদের জন্যও এই উৎসব গুলি করি আমরা। বিশেষ বিশেষ দিনে হাতে সামান্য দুটি টফি ধরিয়ে দিলে বা মণিবন্ধে একটা সস্তা সুতোর রাখি পরিয়ে দিলেও কি যে খুশি হয়ে যান এণারা। খুশি হয় শ্রমিকরাও। অনেকে তো বিশ্বাসই করতে পারে না। ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে প্রথম চোটে। ভাবে হয়তো দিয়ে আবার কেড়ে নেব আমরা।  


এতই অল্প পায় আমাদের শ্রমিকরা, তাতেই অভ্যস্থ হয়ে পড়েন। উটকো কিছু পেলেই তাই ভেবলে যান প্রথম চোটে। ভাবতে ভাবতেই মনে হল, এবারের বড়দিনের আগের শেষ কর্মদিবসটা শুক্রবার। ঐদিন এই আপিসে ট্রান্সপোর্টের কাজ হয় বলে সমবেত হন প্রচুর মানুষ। এসএলওরা আসে, আসেন বিভিন্ন শ্রমিক সংগঠনের প্রতিনিধিরাও। ঐদিন যদি সান্টা ক্লজ হো-হো-হো করে এণাদের সকলকে দুটি করে টফি দেন কেমন হয়? বড়দিন  হিসেবে তো আপিস সাজাবই আমরা। গতবছরও সাজিয়ে ছিলাম।  ভাঁড়ার ঘর থেকে ঝেড়ে ঝুড়ে বিগত বছরের ক্রিসমাস ট্রিটা বার করতে লেগেই পড়েছেন জহর বাবু। গতবছর অবশ্য কোন স্যান্টাক্লজ ছিল না। এ বছর তো থাকতেই পারে -


প্রথমে ঠিক হয়েছিল নতুন ইন্সপেক্টর শান্তনু কয়ালকে সান্টা বানানো হবে। তারপর মনে হল এক্কেবারে কচি, যদি দুঃখ পায়। তখনই রঞ্জিতের কথাটা মাথায় এল। ঘর ফাঁকা হতেই ফোন করলাম রঞ্জিতকে। ‘তোমাকে স্যান্টা হতে হবে।’ রঞ্জিতের প্রাথমিক প্রতিক্রিয়াটা এখনও কানে,‘ অ্যাঁ? এই রে!’ আসন্ন মাধ্যমিক পরীক্ষা সংক্রান্ত এক গুরুত্বপূর্ণ মিটিং এ ছিল রঞ্জিত। মিটিং শেষে যখন আপিসে ঢুঁ মারতে এল, দেখলাম ব্যাপারটা নিয়ে বেশ উৎসাহী।


এত বড় স্যান্টার জামাকাপড় পাই কোথায়? তমলুকে পুঁচকে স্যান্টাদের জামাকাপড় বিক্রি হচ্ছিল বটে, সেগুলিরই যা দাম। এত ধেড়ে স্যান্টার জামা কিনতে কিডনি না বেচতে হয় আমাদের। স্যান্টা নিজেই তার সল্যুশন বার করল, ‘একটা লাল জামা পরে নেব ম্যাডাম। আর একটা সাদা বা হাল্কা রঙের প্যান্ট। শুধু দাড়ি আর টুপিটা লাগবে।’ জানতে চাইলাম,লাল জামা তোমার আছে? রঞ্জিতের লাল জামা না থাকলেও দেখা গেল জহর বাবুর একখান লাল পাঞ্জাবি আছে। ওনাকে বলা হল,ওটাকেই কেচে শুকিয়ে নিয়ে আসতে। শুধু টুপি, গোঁফ আর দাড়িটা যোগাড় করতে পারলেই ঝিলিক মারবে আমাদের সান্টা বুড়ো।


যেহেতু যোশুয়ার পরব, তাই আপিস সাজানোর দায়িত্বটাও ওর। সঙ্গতে শান্তনু আর হকবাবু। উফঃ পুরো ভারতের পতাকা মাইরি। মুস্কিল হল, যখন গত বছরের ক্রিশমাস ট্রিটা বার করা হল, দেখা গেল তিনি আর অক্ষতদেহী নন। গরীর আপিসের সস্তার গাছ, একবছরেই তিনি রীতিমত ল্যাংড়াচ্ছেন এবং একটা হাত ভেঙেছেন। বিকল্প হিসেবে ঝাউ গাছের খোঁজ পড়ল। কাছাকাছি কারো বাড়িতে পাওয়া গেল না। একটা নার্সারি দেবে বলল, দাম চাইল পঞ্চাশ টাকা, তাও ভাড়ায়। ছুটির পর খুলে নিয়ে চলে যাবেন ওণারা। যোশুয়া বিরক্ত হয়ে বলল,‘ থাক ম্যাডাম। আমাদেরটা দিব্যি আছে।’ 


ল্যাংড়া ক্রিশমাস ট্রিকে কি ভাবে যেন খাড়া করে ফেলল ওরা, ভাঙা হাতটাও সেট করা হল। সেই হাতে বল, তারা, পুঁচকে স্যান্টা পুতুলও ঝোলানো হল দিব্যি। বাক্সবন্দি দীপাবলীর আলোগুলো নব উদ্দীপনায় জ্বলে উঠল বেথলেহেমের শিশুকে অভর্থ্যনা করার উদ্দেশ্যে। ডিএম আপিসের নকল সিলিং এ ফুটে উঠল নীল সোনালী তারার দল। যোশুয়া বলে বড়দিনের আসল প্রতীক এই তারাদের দল। রাংতার ঝুলঝুলি ঝুলতে লাগল এদিকে-সেদিকে। আমার আর সৌম্যজিতের টেবিলেও ঝুলল ঝিল্লির মালা। সর্বত্র বড়দিন আর বর্ষশেষের সৌরভ। 


সবই হল, সবই পাওয়া গেল, মিলল না কেবল স্যান্টার গোঁফ আর দাড়ি। কি হবে এবার? আমি বললাম, ‘গালে সাদা তুলো চিপকে দাও ব্যাটার’। সৌম্যজিৎ তো আরেক কাঠি সরেস, বলল,‘আর ভুরুতে কোলগেট।’ রঞ্জিতের স্পোর্টিং স্পিরিট তুলনাহীন, রাগ করা তো দূরস্থান। উল্টে সে নিজেও নানা মতামত দিতে লাগল। শেষ পর্যন্ত অবশ্য তেমন কিছু করতে হয়নি। মা বর্গভীমার মন্দিরের কাছের একটা দোকান থেকে মিলল একখান যুৎসই মুখোশ। 


জহর বাবুর লাল পাঞ্জাবি, টুপি আর মুখোশ পরে তৈরি হয়ে গেল আমাদের স্যান্টা। ঝোলা কোথায় পাই, একখান কার্ডবোর্ডের বাক্সেই ঢালা হল ট্রফি। সারাদিন যত অসংগঠিত শ্রমিক এলেন, শ্রমিক সংগঠনের প্রতিনিধিরা এল, আমাদের এজেন্ট এসএলরা এল সবার হাতে ধরানো হল দু একখান করে ল্যাবেঞ্চুষ। কতজন যে আমাদের সান্টার সাথে সেলফি তুলল তার ইয়ত্তা নেই। বেচারা রঞ্জিত সারাদিন একবার করে মুখোশ খুলছিল আর একবার করে পরছিল।


 কি সব যেন মিটিং ছিল, কারা যেন লাইফ সার্টিফিকেট সই করাতে এল, কিসের যেন ট্রেনিং হল, বড় সাহেবের রিভিউ মিটিং হল সবেতেই হাসি মুখে হাজির আমাদের স্যান্টা। জীবন বড় ছোট বাবুমশাই, কাল কি হয় কে জানে, সেই চিন্তায় খামোখা আজটাকে নষ্ট করে লাভ কি-।ভালো থাকুক না সবাই। চেতন থেকে অবচেতনে আমরা সবাই বোধহয় সেটাই চাই,তাই না।

No comments:

Post a Comment