Monday, 16 January 2023

অনির ডাইরি ১৫ই জানুয়ারি, ২০২৩

 

#অনিরডাইরি 


ষষ্ঠ শ্রেণী, ষাণ্মাসিক পরীক্ষা, অঙ্কে পেলাম ৫২। মাথায়, পিঠে গদাগুম যা পড়ার তাতো পড়লই, তারপরেও মায়ের আর্তনাদে কেঁপে উঠল ধরিত্রী, দুলে উঠল আকাশ। ‘হে ঈশ্বর, আমার মেয়েটা বুঝি গণ্ডমূর্খই থেকে গেল।’ 


বাবা-মা দুজনেই চাকুরীরত। যৌথ পরিবার। উভয়ের ব্যস্ত দিনলিপিতে আমাকে নিয়মিত পড়ানোর মত সময়ের বড়ই অভাব। পড়াতে আসতেন প্রতিবেশিনী পুষ্প দিদিমণি। ওণার পঠন -পাঠন, সদ্য হাতে খড়ি হওয়া শিশুদের জন্য যতটা অব্যর্থ, ষষ্ঠ শ্রেণীর ডেঁপো ছাত্রীর জন্য যে ততোটা নয়, সেটা জানিয়ে উনি পঞ্চম শ্রেণীতেই অব্যাহতি চেয়েছিলেন। অত্যন্ত সম্ভ্রান্ত  পরিবারের গৃহবধূ ছিলেন ভদ্রমহিলা। ঐ 'নামেই তালপুকুর, ঘটি ডোবে না' টাইপ। কপালের  ফেরে ওণার স্বামীর ধূপ বিক্রয়ের সামান্য কটি টাকা ছাড়া, সেইসময় এই টিউশন ফিটুকুই ছিল দিদিমণির সংসার চালানোর একমাত্র সম্বল। মায়ের সহেলী ছিলেন। মাকে অসম্ভব ভালোবাসতেন, মাও বাসত বৈকি। সবে মিলে আমার হাত থেকে নিষ্কৃতি পাননি দিদিমণি। নিয়মিত আসতেন, সৎ ভাবে যতটুকু পারতেন পড়াতেন। এদিক-ওদিক থেকে গোঁজ দিত বাবা। পরিণাম যা হবার তাই হয়েছিল। 


ভালো মাস্টারমশাই/দিদিমণি কোথায় পাই বলে কদিন চুল ছিঁড়লেন জননী আমার। অতঃপর গিয়ে ধরলেন খোকন চন্দরকে। শ্রীমান খোকন, ওরফে অনিত কুমার সিনহা হলেন সম্পর্কে আমার বড়দা। নাঃ আমরা সহোদর নই, তার থেকেও বহু বহু গুণ বেশী। বড়দার জননী আর আমার মাতৃদেবী সহোদরা বটে, কিন্তু মায়েদের চার বোনের মধ্যে টানটা এতই বেশী যে আমরা তাঁদের পুত্রকন্যাগণ একে অপরকে সহোদর হিসেবেই গণ্য করি এবং পূর্ণ বিক্রমে একে অপরের হাড় জ্বালাই। 


চার দাদার একটি মাত্র বোন আমি। মাত্রা ছাড়া আদরে বেড়ে উঠেছি। সেজদা- ছোটদার হাতে গোটা কতক গাঁট্টা বা থাবড়া খেলেও বড়দা আর মেজদা ছিল অখণ্ড স্নেহের আধার। সদ্য রেলে চাকরিতে ঢুকেছে বড়দা, আপিস ফেরতা গুটি কয়েক টিউশনি তখনও করে বটে,সেটা অনেকটাই অভ্যাসের বশে। মাসি অর্থাৎ আমার মায়ের অনুরোধ ফেলতে না পেরে বড়দা এল আমায় পড়াতে। 


ঐ যে আপনারা বলেন না,প্রতিটি সফল পুরুষের পিছনে লুকিয়ে থাকেন একজন মহীয়সী, ঠিক তেমনিই প্রতিটি সফল নারীর পিছনে বেত হাতে দাঁড়িয়ে থাকেন একাধিক পূজনীয় পুরুষ। সাফল্যের নিরিখে আমায় যত নম্বরই দিন না কেন, জীবনে যতটুকু অর্জন করেছি তার জন্য তিন জন পুরুষই দায়ী। প্রথম এবং প্রধান পুরুষ অবশ্যই আমার বাপ, তৃতীয় পুরুষ তুত্তুরীর বাপ আর মধ্যম পুরুষ হল আমার বড়দা। 


আজও মনে আছে, প্রথম দিন পড়াতে এসে কত্ত খোশ গল্প করেছিল বড়দা। টিভি দেখা নিয়ে মা এত খিটখিট করে কেন, কি কি দেখতে ভালোবাসি ইত্যাদি প্রভৃতি। তখনও কেবল্ আসতে বাকি এক দশক, দূরদর্শনই ভরসা। বোকার মত বলে বসেছিলাম, সোমবারের সুপার হিট মুুকাবিলা আমার ভয়ানক প্রিয়। অপেক্ষা করে থাকি বুধবারের চিত্রহার আর শনিবারের হিন্দি ফিচার ফিল্মের জন্য। গপ্প শেষে বইপত্র নাড়াচাড়া করে, বাড়ি ফেরার সময় ভবিষ্যতের নির্ঘন্ট শুনিয়ে গিয়েছিল বড়দা,প্রতি সোম, বুধ আর শনিবার আপিস ফেরৎ পড়াতে আসবে। অঙ্ক দিয়ে শুরু করে মাস ঘোরার আগেই বাংলা ইংরেজি ভিন্ন অন্য সব বিষয়ের দায়িত্ব ঘাড়ে তুলে নিল বড়দা। 


বাংলা-ইংরেজি পড়ানো, উত্তর, রচনা, প্যারাগ্রাফ লিখে দেবার দায়িত্ব ছিল বাবার।একবার বাবা লিখে দিলে তা নিয়মিত পড়ানো, পড়া ধরা আর লিখতে দেবার কাজটা অবশ্য বড়দাই করত। বলতে ভুলে গেছি, সবটুকুই কিন্তু ছিল অবৈতনিক। ধীরে ধীরে অন্য টিউশনি গুলো ছেড়েই দিল বড়দা। আমিই রয়ে গেলাম একলা একেশ্বরী, বড়দার সবটুকু অবসর জুড়ে। আপিস ফেরতা আমাকে পড়ানো আর আমাকে পড়িয়ে বঙ্গমিলনী ক্লাবে বন্ধুদের সাথে আড্ডা মারা, দীর্ঘ ছ-সাত বছর এই ছিল বড়দার জীবনের প্রধান মনোরঞ্জন। 


দশম শ্রেণীতে অন্যান্য সহপাঠিনীদের মত আমিও ভর্তি হলাম এক কোচিং এ। তবুও সরে যায় না বড়দা। আগের মতই চলতে থাকে সবকিছু। কোচিং এর পড়াও অভ্যাস হতে থাকে বড়দার তত্ত্বাবধানে। দেখতে দেখতে এসে পড়ে মাধ্যমিক পরীক্ষা। পরীক্ষার দিন চারেক আগে কানের ব্যথায় কাহিল হয়ে পড়ি আমি। সদ্য হাসপাতাল থেকে ছাড়া পাওয়া বাবা বা ঘর-বাহির সামলে হাঁপিয়ে পড়া মায়ের জন্য অপেক্ষা করেনি বড়দা, অফিস কামাই করে, কান ধরে আমাকে নিয়ে গিয়ে ডাক্তার দেখিয়ে ওষুধ কিনে দিয়ে গিয়েছিল বাড়ি। রেজাল্ট বেরোল, স্টার পেলাম। অঙ্কে লেটার। আজকালকার দিনে অতি দীন হলেও, সে সময় আমার কাছে ওটা ছিল স্বপ্নের মত।  মা আর বাবার অফিসে ফোন করে খবরটা দিয়েই,  স্কুল থেকে সোজা দৌড়ালাম বড় মাসির বাড়ি। বাবা-মা-দাদা কেউ সেদিন অফিস যেতে চায়নি। আমিই জোর করে পাঠিয়েছিলাম। বড় মাসির গলির মুখে দাদার সাথে দেখা, রাস্তা না পেরিয়েই চিৎকার করে উঠলাম   ‘দাদা আমি অঙ্কে লেটার পেয়েছি’ । আজও মনে আছে, আনন্দের অভিঘাতে সামান্য টলে গিয়েছিল বড়দা। 


একাদশ শ্রেণীতে ভর্তি হলাম। ইতিহাসের পুনরাবর্তন ঘটল যেন। পঞ্চম শ্রেণীতে পুষ্প দিদিমণির মতই এবার অব্যাহতি চাইল বড়দা। যদিও দুজনেই বিজ্ঞানের ছাত্রছাত্রী। তাও এত বছর পর একাদশ-দ্বাদশের বিজ্ঞান বিভাগ পড়ানো মোটেই সহজ নয়, বরং বেশ মুস্কিল। সেটাই অকপটে জানাল বড়দা।  শুনে সে কি হাপুস নয়নে কান্না আমার। প্লিজ বড়দা তুমি আমায় ছেড়ে যেও না। কোচিং এর পড়া কিচ্ছু মাথায় ঢুকছে না আমার। 


একাদশ দ্বাদশে আমার সঙ্গ না ছাড়লেও, কলেজে ভর্তি হবার পর বড়দা বলেই দেয়, আর নয়। এবার 'একলা চলো রে'। ‘আর আমায় ডাকলেও পাবি না।’ ততোদিনে বড়দার জীবনেও ঘটে চলেছে অনেককিছু। বাড়িতে আসতে চলেছে নতুন অতিথি,  নাগেরবাজারের মিত্র বাড়ির আদরের দুলালী শ্রীমতী রিঙ্কু ওরফে বড় বৌদি। সে কি উত্তেজনা। বিয়ের দিন বরের গাড়িতে এক চিলতে জায়গা পাবার জন্য সে কি আকুতি। প্লিজ বড়দা,আমায় ফেলে বিয়ে করতে যেও না। ১৯৯৯ সালের ১৫ই জানুয়ারীর সন্ধে বেলা, বড় মেসোমশাই আর বাবার সাথে বর নিয়ে গেলাম আমিও। পরদিন কাক ভোরে মেজদার সাথে বউ আনতেও গেলাম আমি। 


আজও মনে পড়ে বধূ বিদায়ের আগে চলছে আশির্বাদ পর্ব। বৌদির গতরাতের সাজসজ্জা প্রায় বিলুপ্ত চোখের জলে। বৌদির পাশেই ঘরোয়া  শাড়ি পরে বসে আছেন মাসিমা অর্থাৎ বৌদির মা। দুই হাতে চেপে ধরে আছেন আদরের কন্যার দুই হাত। দুজনেই কেঁদে চলেছেন অনর্গল। যতবার আশির্বাদ করতে ডাকা হচ্ছে মাথা নেড়ে না বলে চলেছেন মাসিমা। মেসোমশাই একাই বসলেন আশির্বাদ করতে। পাছে চোখের কোণ ছাপিয়ে যায়, তড়িঘড়ি উভয়ের মাথায় ধান দূর্বা দিয়েই উঠে পড়লেন মেসোমশাই। পুরুষদের কাঁদতে নেই যে। সরে যাবার আগেই ঝাঁপিয়ে পড়ল বৌদি, দুই হাতে চেপে ধরল বাবার পা, করুণ স্বরে ডুকরে উঠল,‘ও বাবা, বাবা গো।’ সে যে কি করুণ দৃশ্য। ডুকরে ডুকরে কাঁদতে লাগলাম আমিও। আক্ষরিক অর্থেই কেঁদে ভাসালাম। 


বউদির সাথে ফোঁপাতে ফোঁপাতেই গাড়িতে উঠলাম। ওঠার সাথে সাথেই খটাস্ করে এক গাঁট্টা মারল মেজদা। আর বড়দা তাজ্জব হয়ে বলে উঠল, ‘তুই ঠিক কোন পক্ষে আছিস বল তো?’ ১৯৯৯ থেকে আজ অবধি, আমি চিরকালীন আমার বৌদির দলে। যেদিন লেবার সার্ভিসের তকমা লাগেনি, শৌভিককে চিনতামও না, তুত্তুরী ঘুমিয়ে ছিল আমার মায়ের কোন গহীন স্বপনে, যেদিন ফেসবুক ছিল না, ইনস্টাগ্রাম ছিল না, যেদিন জীবন ছিল বড়ই দীন, নিছক অতি নিম্নসাধারণ, সেদিন বড় আর মেজ বৌদি ছিল আমার সহেলী। বড় মাসির বাড়ি গিয়ে বৌদিদের সাথে রাত্রিবাস করাটাই ছিল জীবনের প্রথম তথা সবথেকে উত্তেজনা মাখা, ‘গার্লস্ নাইট আউট।’ আর বাবু অর্থাৎ শ্রীমান অরিত্র, ওরফে আমার জ্যেষ্ঠ ভ্রাতুষ্পুত্র যখন ভূমিষ্ঠ হল, সাময়িক ভাবে মনে হল গোটা পৃথিবীটাই বুঝি ঘুরতে লেগেছে পুঁচকে নবজাতককে কেন্দ্র করে। 


দেখতে দেখতে কত্ত বছর পেরিয়ে গেল। পাবলিক সার্ভিস কমিশনের আপিস থেকে প্রথম চাকরী পাবার খবর পাঠালাম বড়দাকে। পাড়ার কম্পুউটার সারানোর দোকান থেকে ফোন করে জানালাম, লেবার সার্ভিস পেয়ে গেছি দাদা। আয়লা মাথায় আমায় শ্বশুরবাড়ি পৌঁছে দিয়ে এল বড়দা। শ্রীমতী তুত্তুরী এলেন।  আরো কতকিছুই না ঘটে গেল। বদলে গেল পৃথিবী। বড়দা আর বড়বৌদি শুধু রয়ে গেল একই রকম। আমার দেখা সবথেকে রোম্যান্টিক জুটির আজ ২৪ তম বিবাহবার্ষিকী। এক আকাশ শুভেচ্ছা আর শুভকামনা রইল বড়দা আর বড়বৌদি তোমাদের জন্য। খুব ভালো থেকো, সুস্থ থেকো দোঁহে। এমনি একে অপরের ভালোবাসায় জবজবে থেকো। এমনি ছাতা হয়ে থেকো এই অধমের মাথার ওপর।

No comments:

Post a Comment