#অনিরডাইরি
‘হেল্লো শোন না পুপু বিয়ে করতে রাজি হয়েছে।’ পার্শ্ববর্তিনী তারস্বরে কাকে যেন বললেন। বাসে উঠেই সিট পেয়ে গেছি আজ। দুইজনের সিট। জানলার ধারের অল্প বয়সী ছেলেটি উঠে যাওয়ার পর ভদ্রমহিলা সরে গেছেন জানলার ধারে। পাশের সিটটি দখল করেছি আমি। যদিও ভদ্রমহিলার সেটা খুব একটা পছন্দ হয়েছে বলে মনে হয় না। আমার ডানদিকের তিন সিটের একদম ধারে বসে থাকা বৃদ্ধকে উনি ডেকেছিলেন ওণার পাশের সিটটি অলংকৃত করার জন্য। বৃদ্ধ যাননি। উল্টে হাসি মুখে আমায় বলেছেন,‘তুমি বসে পড়।’
রূপসী বাইপাসে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে, চা জল খেয়ে হুহু করে ছুটছে বাস। ঝড়ের মত সরে সরে যাচ্ছে দুর্মুঠ, দইসাই, মারিশদা, নাচিন্দা, কানাইদীঘি, হেঁড়িয়া, বাজকুল। মহিলা ব্যাগ থেকে প্রচুর ঘেঁটেঘুটে বার করে আনলেন একটা পুঁচকে বোতাম টেপা মুঠো ফোন। শুরু হল খোশগল্প। ভেবেছিলাম আজ বাসে উঠে একটু ঘুমাব। সে আর হবে বলে মনে হয় না।
পাশের মাসিমার খোশগল্প তো তাও অন্তত কর্ণপটহ বিদারণকারী নয়। গতকাল কি যে সাংঘাতিক একটা সিনেমা চলছিল বাসে, পৌনে দুঘন্টার বাস পথে সাকুল্যে গোটা পঁচিশ ত্রিশ ডায়লগ শুনেছি আমি বাকিটা পুরোটাই ঝাড়পিঠ। লাথি/ঘুঁষির ও যে এমন বজ্রনির্ঘোষ হতে পারে বাপের জন্মে প্রত্যক্ষ করিনি। গোটা সিনেমা জুড়ে নায়ক শুধু কেলিয়েই গেল আর সবাই পড়ে পড়ে মার খেয়েই গেল। ওয়ান ম্যান আর্মি আর কাকে বলে। একাই বিশ/ত্রিশ জনকে কোতল করছে তাও দাঁত খুঁটতে খুঁটতে। এক একটা ঘুঁষি মারছে শত্রু দশ বিশ ফুট উড়ে যাচ্ছে।মার্ভেল কমিকসের হাল্ক কাকাও লজ্জা পাবে ভাই। বাস থেকে যখন নেমেছিলাম রীতিমত মাথা টলছিল। বেলা বাড়ার সাথে সাথে বাড়ছিল দেশী হাল্কের গুঁতোও। প্রবল থেকে প্রবলতর হচ্ছিল মাথা টনটনানি। ফেরার পথেও নিস্তার মেলেনি, মাথা ব্যথা আরও বাড়াতেই বোধহয়, যে বাসে সওয়ার হয়েছিলাম তাতে গমগম করে চলছিল ঝিনচ্যাক নাচাগানার ভিডিও। উদোম নাচ ছিলেন মিঠুন দা আর গোবিন্দ।
আজকের বাসেও একটা ভিডিও স্ক্রিন আছে বটে, ঈশ্বরের অশেষ আশির্বাদ যে তিনি এ যাত্রা ঘুমন্ত। ইশ আমিও যদি একটু ঘুমাতে পারতাম! ঘুমাতে না পেরে মাসিমার গল্পে মন দিলাম। বুঝলাম কর্তা গিন্নীতে দীঘায় এসেছিলেন দিন দুয়েকের জন্য। একত্রিশ ডিসেম্বর উপলক্ষে ভিড় বাড়ার আগেই কেটে পড়েছেন মানে মানে। অতঃপর খাওয়াদাওয়া, গ্যাসঅম্বলের গল্প হল খানিক। দীঘায় মাতালদের বাওয়ালের গল্পও হল। ট্রেনে না ফিরে কেন বাসে ফিরছেন সে গল্পও হল বটে। সব শেষে আসল কথা, ‘শোন না পুপু বিয়ে করতে রাজি হয়েছে।’
আহাঃ এতক্ষণে একটা মনের মত টপিক পেলাম গো। কান খাড়া করে শুনতে লাগলাম, পুপুর জন্য কি খুঁজছেন মাসিমা ছেলে না মেয়ে। তাতে পুপুর লিঙ্গ সম্পর্কে সম্যক ধারণা পাওয়া যাবে, আর কিছুই না।মাসিমা বললেন,‘ হ্যাঁ রে, আমরা তো কবে থেকে বলছি, শেষ পর্যন্ত বাবুর মতি ফিরেছে বলতে পারিস। শোন না, ভালো মেয়ে সন্ধানে থাকলে একটু জানাস।’ বুঝলাম পুপু তাহলে ছেলে। মাসিমা নিশ্চয়ই মেয়ের জন্য মেয়ে খুঁজবেন না। এত উদার পাড়ার মাসিমারা বোধহয় এখনও হয়নি।
মাসিমা এবার কেমন মেয়ে চাই, সেই চরিত্রচিত্রনে নিমগ্ন হলেন। কুমারটুলিতে অর্ডার দিতে হবে নির্ঘাত, ভেবে হাই তুললাম। মাসিমা বললেন,‘ আমাদের পছন্দ অপছন্দ কিছু নেই। পুপুর পছন্দ হলেই হল।দুজনে দুজনকে দেখে বুঝে সিদ্ধান্ত নেবে, ব্যাস।’ এমনি সব গপ্পের চিত্রনাট্যে সাধারণত খুব একটা অদলবদল হয় না। আবার হাই চাপলাম। জনসমক্ষে হাই তোলা অভব্যতা, কার যেন লেখায় পড়েছিলাম। সুনীল গাঙ্গুলী কি? নাকি শঙ্কর?
’অসবর্ণ হলেও আপত্তি নেই। এমনকি পুপু বলেছে হিন্দু না হলেও কোন সমস্যা নেই। ভালো মুসলমান মেয়ে থাকলেও জানাস।’ চোখ বন্ধ করে ঘুমানোর চেষ্টা করছিলাম আমি। চমকে উঠলাম সহসা। মাসিমা বলে কি? এই বিষে আচ্ছন্ন ধরায় উনি পুত্র বা পুত্রতুল্য কারো জন্য বিবাহযোগ্যা পাত্রী অন্বেষণ করছেন এবং তাও জাত ও ধর্মের ঊর্ধ্বে। অসবর্ণ বিবাহে আপত্তি নেই তা তো হরদম চোখে পড়ে কিন্তু অস্বধর্মে বিয়ে করতে চায় এ কে ভাই?
নামার সময় হয়ে আসছে। আজও টাইমের গণ্ডগোল করেছি আমি। যত সকাল সকালই বেরোই না কেন, রোজই লেট হয়ে যাচ্ছে। সময়টাকে কিছুতেই মুঠোয় ধরতে পারছি না। পাশের ভদ্রমহিলা ফোন ব্যাগে ভরে চুপচাপ জানলার বাইরে তাকিয়ে আছেন। ইতঃস্তত করে জিজ্ঞাসা করেই ফেললাম,‘কোথায় নামবেন মাসিমা?’স্নেহ মিশ্রিত স্বরে বললেন,‘সাঁতরাগাছি।’ অতঃপর জানতে চাইলেন,‘তুমি কোথায় নামবে মা?’ জানালাম আমি সামনেই নামব। জানতে চাইলাম, ওণারা নেমে ট্রেন ধরবেন নাকি বাস। ভদ্রমহিলা মুখ খোলার আগেই ডান পাশের হাসিমুখ বৃদ্ধ মাঝে ঢুকে পড়ে জানাল,‘সাঁতরাগাছি মানে ঠিক সাঁতরাগাছি নয়, তার থেকে দুটো স্টপেজ পর নামব আমরা।’ জানতে চাইলাম বাকসাড়া না বেলেপোল? ভদ্রমহিলা তাজ্জব হয়ে হাসি মুখে বললেন তুমি চেনো? এবার আমার হাসার পালা, আমার শহর আর আমি চিনব না!
ভদ্রলোককে ইশারায় আমার সিটটা দখল করতে বলে উঠে পড়লাম। দিন কয়েক আগে এমনি এক শহরবাসীর সাথে গল্প করছিল তুত্তুরী, ছেলেটি এমন সব বিস্ফোরক তথা সাম্প্রদায়িক কথাবার্তা বলছিল যে, মাঝপথে শৌভিককে মেসেজ পাঠিয়েছিলাম আমি,‘সার্ফের জল রেডি রাখিস। বাড়ি গিয়ে মেয়েটার কানে ঢালব। যা ময়লা ঢোকাচ্ছে আমার মেয়ের মাথায়, আক্ষরিক অর্থে ব্রেন ওয়াশ না করে উপায় নেই।’
সেদিন বাস্তবিকই মনে হয়েছিল শহরটা পচে গেছে বুঝি, ইউটিউব আর হোয়াটসঅ্যাপর সৌজন্যে পাঁচশ বছরের বুড়ি শহরটার রন্ধ্রে রন্ধ্রে ছড়িয়ে পড়েছে সন্দেহ আর বিদ্বেষ। আজ এই ২০২২ এর শেষ কর্মদিবসে এসে মনে হল, নাঃ প্রিয় শহর, একটুও বদলাও নি তুমি। এখনও আশা আছে।
No comments:
Post a Comment