Sunday, 8 January 2023

অনির ডাইরি ৫ই জানুয়ারি, ২০২৩

 


#তাম্রলিপ্তকড়চা 

তমলুকে জয়েন করে ইস্তক একাধিক বার শোকজ খেয়েছি ওপর থেকে। সবথেকে প্রথম শোকজটা ছিল একদল এসএলওর নালিশের ভিত্তিতে। নালিশখানা প্রত্যক্ষ ভাবে আমার নামে ছিল না যদিও, ছিল আমার চেয়ারের বিরুদ্ধে। তবুও, শোকজ তো রে বাবা- 


যাঁর সইয়ে শোকজ এর মেলটা এসেছিল, তাকেই  ফোন করে চড়াও হলাম,‘ এত বছর চাকরি করে, শেষে আমার বিরুদ্ধে এই অভিযোগ? আর তোমরা সেসব বসে বসে শুনছ?’ উনি অসহায় ভাবে বললেন, ‘ তাও তো নালিশের চিঠিটা তোমায় পাঠাইনি। আরো কদর্য ভাষায় লেখা হয়েছে সে চিঠি।’ তাই নাকি? তা কি এমন কদর্য ভাষায় আমার থুড়ি আমার চেয়ারের বদনাম করেছে ব্যাটারা? উনিও পাঠাবেন না, আমিও ছাড়ব না। অনেক ধস্তাধস্তির পর শেষমেষ চিঠিটা যোগাড় করলাম। 


পড়লাম। নাঃ তেমন খারাপ কিছু লাগল না। ওদের কিছু নালিশ ছিল, সেটা তেমন অন্যায্য কিছু না। চেয়ারে বসার পর, সে কথা আমাকে জানিয়েও ছিল মৌখিক ভাবে। কিন্তু সেই ব্যথায় মলম দেওয়ার সাধ্য আমার ছিল না। ব্যর্থ মনোরথ হয়ে, আমার ওপরমহলে জানিয়েছে আর কি। শোকজের জবাবে সেকথাই লিখলাম। আর মৌখিক ভাবে ব্যাটাদের ডেকে বললাম, বাপুরে একটু সময় দাও। তোমাদের অভিযোগ গুলোকে যদি ভালোবাসায় না বদলাতে পেরেছি, তো আমি টিম চুঁচুড়ার অনিন্দিতা ম্যাডাম নই। 


তারপর, বদলে গেছে ছটা ঋতু। এদিকে বুড়ো রূপনারায়ণ আর ওদিকে বুড়ি কংসাবতীর বুক দিয়ে বয়ে গেছে কতই না বারি ধারা। সেদিনের নালিশওয়ালাদের থেকে আর কোন নালিশের চিঠি যায়নি কলকাতা। বরং আজকাল ওরা এসে বলে যায়, কথায় কথায় যে ,‘ আপনি আছেন তো, আমাদের অভিভাবক।’ বকলে, ধমকালে, ঘর থেকে দূর করে দিলে, মুখ চুন করে চলে যায়, পরের দিন এসে বত্রিশ পাটি দেখিয়ে বলে, ‘আপনি মায়ের মতো, ভালোবাসেন তাই বকেন।’ 


আর উপহার!সে যে কত পাই তার ইয়ত্তা নেই। আজই যেমন পেলাম, প্রণব বাবু আর লাবণীর থেকে। প্রণব বাবু আমাদের কোলাঘাটের এসএলও। তাঁর কন্যা লাবণী। ভদ্রলোক একদিন এসে বলে গিয়েছিলেন বটে,‘ আমার মেয়েটা  আপনাকে দেখতে চায়। একদিন নিয়ে আসব?’ বলেছিলাম হ্যাঁ, কেন আনবেন না। 


আজ সকালে যখন মেয়েটাকে নিয়ে এলেন, তখন তীব্র ব্যস্ততার চোটে সকলের নাভিশ্বাস উঠছে। আড়াইটে থেকে আমাদের বেনিফিট ডিসট্রিবিশন প্রোগ্রাম। হলদিয়ার বড়সাহেব আসবেন, বোর্ডের সিইও স্যার আসবেন। কানাঘুষো চলছে, উপস্থিত থাকবেন নাকি খোদ ডিএম সাহেবও। তাদের খাতির যত্নের সুবন্দোবস্ত করা, রিপোর্ট বানানো, লোকজন যোগাড় করা, ব্যানার, ফ্লেক্স, ডামি চেক, PPO, শংসা পত্র, টিফিন,জল, চা ইত্যাদি প্রভৃতির ধাক্কায় যে যেদিকে পারে দৌড়াচ্ছে। ভুলভাল কাজ এবং কথার জন্য জনৈক ট্রেড ইউনিয়ন নেতাকে উদোম ঝাড়ছি আমি, তারই মধ্যে সকন্যা উপস্থিত প্রণব বাবু। ‘এই যে ম্যাডাম, আমার মেয়ে। সেই যে বলেছিলাম না, ও আপনাকে দেখতে চায়।’ 


একা প্রণব বাবু এলে, সেই মুহূর্তে কপালে সলিড দুঃখ ছিল। কার রাগ যে কার ওপর ঝেড়ে দিতাম। ভাগ্যে মেয়েটা সঙ্গে ছিল। চড়াই থেকে উৎরাইয়ে সুর নামিয়ে বললাম,‘ একটু বাইরে বসুন প্লিজ। ডাকছি।’ তারপর যা হয় আরকি, ব্যস্ততার অভিঘাতে ভুলেই গেলাম। মাঝে প্রণব বাবু এবং জলধরকে ডেকে কি সব নির্দেশও দিলাম আমি। উনিও বললেন না, আমিও বেমালুম ভুলে গেলাম মেয়েটার কথা। বেশ অনেকক্ষণ পর ফাঁকা হয়ে চেম্বার ছেড়ে বেরিয়েছি, দেখি আমার ঘরের সামনের ভিজিটর্স চেয়ারে একদল বেনিফিশিয়ারির মাঝে শুকনো মুখে বসে আছে মেয়েটা। 


তড়িঘড়ি ডেকে পাঠালাম বাপ আর মেয়েকে। মার্জনা চাইলাম নিজের ব্যস্ততা এবং ভুলো মনের জন্য। মেয়েটা একগাল হেসে ব্যাগ থেকে বার করল চারটে অপরূপ সুন্দর গয়নার সেট। সবকটাই কাপড়ের ওপর হাতে আঁকা। অবাক হয়ে জানতে চাইলাম তুমি এঁকেছ? মেয়েটা সলজ্জ হেসে ঘাড় নাড়ল আর প্রণব বাবু একগাল হেসে বলল,‘ঐ তো করে ম্যাডাম। সারা রাত জেগে।’ বাপরে! শুনলাম মেয়েটি বিএ, এমএ পাশ করে, বিএড ও করে ফেলেছে। বেশ কিছু হাতের কাজের ছবি ও ভিডিও দেখাল। শাড়ি,ব্লাউজে এঁকেছে মেয়েটা, বানিয়েছে ওয়ালহ্যাংগিং। বড়ি দিয়েছে যেন আল্পনা। 

কি যেন ফাইল বগলে ঘরে ঢুকেছিল শুভাশিস, মেয়েটির কাজ দেখে মুগ্ধ হয়ে বলে উঠল,‘তুমি বুটিক খুলেছ? না খুলে থাকলে খুলে ফেল শীঘ্রই। ’ কন্যা গর্বে গর্বিত প্রণব বাবু  বললেন,‘ পাড়ার সব বাচ্ছা স্কুলের হাতের কাজ গুলো ওকে দিয়েই করায়। ’ 


সামনে রাখা চারটে গয়নার মধ্যে একটি সেট তুলে নিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, এটার দাম কত? মেয়ে এবং মেয়ের বাবা হাঁহাঁ করে উঠল। ‘দাম আবার কি ম্যাডাম। এগুলো সব আপনার জন্য এনেছি। উপহার। আপনাকে নিতেই হবে।’ নেব তো অবশ্যই। তাই বলে বিনা মূল্যে কেন? আর এতগুলোই বা কেন? একটা নিই। মেয়েটি নাছোড়বান্দা,‘না ম্যাডাম। বাবার মুখে শুনেছি, আপনি সাজতে ভালোবাসেন,আপনার জন্যই বানিয়ে এনেছি। সব আপনার। মা বলেছে ম্যাডামকে পরিয়ে একটা ছবি তুলে আনবি।’ 


পুরো গলে গেলাম গো। অনলাইনে কেনা কানের ঝুটো দুলটা খুলে তৎক্ষণাৎ পরে ফেললাম মেয়েটার হাতে বানানো গয়না। ভাবলাম উপহার পর্ব সমাপ্ত হল বুঝি। ও হরি! 


ব্যাগ থেকে বেরোল মস্ত বড় ডাব্বা ভর্তি গয়না বড়ি, নিজের হাতে দিয়েছে মেয়েটা। প্রণব বাবু বললেন, ' ওর মাও একটু সাহায্য করিছে বৈকি। ডালটা বেটে দিইছে, ভিডিও তুলে দিইছে।' এটা নিতে কোন ওজর আপত্তি করলাম না। পূর্ব মেদিনীপুরের গয়না বড়ি আমার ভয়ানক প্রিয়। বলতে নেই, তমলুকে আসা অবধি এই বস্তুটা কখনও কিনে খেতে হয়নি। কখনও আশিষ দিয়েছে, তো কখনও অরূপ তো কখনও SDO বাংলোর সিকিউরিটি ছেলেগুলো এনে দিয়েছে কৌটো ভর্তি করে। কারো বউ কারো বা মায়ের হাতে বানানো গয়না বড়ি। কারো মেয়ের হাতের এত নক্সা করা বড়ি আজ অবধি পাইনি। মাথায় ঠেকিয়ে ব্যাগে ঢোকানোর চেষ্টা করছি, বাপ আর মেয়েতে ক্ষণিক চোখে চোখে কি কথা হল, তারপর একরাশ সংকোচ নিয়ে মেয়েটা বলল, " ম্যাডাম রেগে যাবেননি, আপনার জন্য আর একটা জিনিষ আনতেছি।" 


আবার কি? এত মাল নিয়ে বাসে ফিরব কেমন করে? ইতিমধ্যে মেয়েটার ব্যাগ থেকে বেরিয়েছে সোনালী রাংতায় মোড়া একটা মস্ত মণ্ড। প্রণব বাবু বললেন,‘আপনার জন্য ও নিজের হাতে কেক বানিয়ে  আনতেছে ম্যাডাম। এটা আপনাকে নিতেই হবে।’ এমন অমূল্য উপহার কি আদৌ ফেরানো যায়? 


 চেপে চেপে ব্যাগে ঢোকালাম যতটা পারলাম। বড়ির কৌটো উত্তমকুমারকে দিয়ে বললাম,‘ কাল নেবো।  যত্ন করে রেখো। আমার বড়ি ভাঙলে কিন্তু-’। বাক্য সম্পূর্ণ করার পূর্বেই ডাব্বা বগলে কেটে পড়ল উত্তমকুমার। অরূপকে ডেকে বললাম,‘শুধু আমার একার নয়, তিনজনেরই একটা ভালো দেখে ছবি তোলো তো-’। এই ভালোবাসা আর এই মুহূর্ত গুলোর জন্যই তো বেঁচে থাকা। নইলে তো সবটুকুই নেহাৎ চাকরগিরি।

No comments:

Post a Comment