#তাম্রলিপ্তকড়চা #অনিরডাইরি
খামোখা বেনিফিট ডিসট্রিবিউশন প্রোগ্রামের দরকারটা কি? কেউ মারা গেলে বা প্রভিডেন্ট ফাণ্ডের টাকা তুলতে হলে বা পেনশনের সময় হয়ে এলে মানুষ এসে আবেদন পত্র জমা করবেন তাঁর এলাকার কালেক্টিং এজেন্ট বা এসএলওর কাছে। ট্রেড ইউনিয়নের প্রতিনিধিরাও অবশ্য অনেক সময় জমা করে যান তাঁদের সদস্যদের বিভিন্ন আবেদন-নিবেদন।
চেকিং,ভেরিফিকেশন,এনকোয়ারি করে দেখবেন আমাদের ইন্সপেক্টর সাহেবরা। সব ঠিক থাকলে তা উপরে উঠবে,না হলে আটকে রাখা হবে প্রয়োজনীয় নথিপত্রের জন্য। সরকারি ব্যবস্থায় একদম বাতিল তো কিছু হয় না, চট করে। ইন্সপেক্টর সাহেবরা ছাড়লে তবে দেখতে পাব আমি। আমি ছাড়লে, বড় সাহেব পাঠিয়ে দেবেন কলকাতা। কলকাতা অনুমোদন আর টাকা দিলে, ব্যাঙ্কে অ্যাডভাইজ পাঠাব আমরা। ব্যাস্ টাকা ঢুকে যাবে নির্দিষ্ট বেনিফিশিয়ারির অ্যাকাউন্টে।
মোদ্দা কথা হল, ঘরে বসেই অনুদান বা পেনশন পেতে পারেন যখন, খমোখা তাদের ডেকে এনে বিব্রত করা কেন বাপু। তাছাড়া একটা অনুষ্ঠান করার হ্যাপা কি কম? হল বুক করো, জেলায় হলে সে না হয় মাননীয় জেলাশাসক মহোদয়ের আনুকুল্যে ওণার হলগুলি আমরা বিনি পয়সায় পাই। অন্যত্র দিতে হয় বৈকি সামান্য কিছু ভাড়া। লাগে ফ্লেক্স, পিপিটি, ডামি চেক, ল্যামিনেট করা শংসা পত্র ইত্যাদি প্রভৃতি। প্রথম দিকে অবিকল ব্যাঙ্ক চেকের মত শংসা পত্র দিয়েছিলাম আমরা, পরদিনই তা নিয়ে ব্যাঙ্কে দৌড়ছিলেন কিছু মানুষ।সে কি কেলেঙ্কারি। সমাজের সবথেকে তলার, সবথেকে অবহেলিত মানুষগুলোকে নিয়ে আমাদের কারবার। শহুরে পারিপাট্য বা পরিশীলন আশা না করাই ভালো।
এর বাইরেও লাগে চা-জল- ন্যূনতম কিছু টিফিন।
খুব সাদামাটা অনুষ্ঠান করলেও, খুব কড়া হিসেব করে চললেও, খরচপত্র কখনই বাঁধা অঙ্কে আটকে থাকে না। ফলে বিল ছাড়তে গিয়ে হামেশাই হাতে থেকে যায় পেন্সিল। হেড আপিসে ফোন করে দরবার করতে হয়, ‘আর দুটো টাকা, আর একটা allotment হবে না?’
তা সত্ত্বেও আমরা করি, করি তার প্রথম এবং প্রধান কারণ হল, মানুষগুলোকে খুব দেখতে ইচ্ছে করে। কে সেই মেয়ে, যে কর্মসূত্রে আপাতত অন্য রাজ্যের অধিবাসিনী, যার বিড়ি শ্রমিক মা নদী তীরে জমা করে রাখা মাটি চাপা পড়ে মারা গেছেন অকালে? বর্ষায় পাঁচিল ধ্বসে পুত্র হারা হয়েছেন যে মা, মারণ ব্যাধি কেড়ে নিয়েছে যাঁর স্বামীকে, বয়স হয়ে গেছে বলে আর যোগাড়ের কাজ জোটে না যে ভদ্রমহিলার, গায়ে জোর নেই বলে আর মালপত্র লোডিং এর কাজ করতে পারেন না যিনি বা চোখে কম দেখেন বলে বাস চালানো ছেড়ে দিয়েছেন যে বৃদ্ধ ভদ্রলোক তাদের আমি অন্তত ব্যক্তিগত ভাবে দেখতে চাই। চাই দুটো কুশল বিনিময় করতে, শুনতে চাই তাদের গল্প, বলতে চাই, ' ভালো থাকবে/এন।' নিছক নিষ্প্রাণ পোর্টাল আর শুকনো ব্যাঙ্ক অ্যাডভাইজ নয়, যে রক্তমাংসের মানুষগুলোকে পরিষেবা দিলাম আমরা তাদের সাথে আলাপিত হতে চাই। খোলাখুলি কথা বলতে চাই, টেবিলের এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্তে।
বাঁধাগতের দপ্তরী জীবনের বাইরে, এই দিনগুলো যেন এক ঝলক টাটকা বাতাস বয়ে আনে।পরিচিত মধ্যবিত্ত জীবনের বাইরেও যে একটা দুনিয়া আছে, এই দিনগুলো নতুন করে তা দেখায়। অনুষ্ঠান গুলো যে শুধু একতরফা ভাবে আমারই প্রিয় তা নয়,ভালোবাসে আমার টিমের প্রতিটি সদস্যই। সেদিনই গল্প শোনাচ্ছিল এক জুনিয়র ইন্সপেক্টর, ‘বুঝলেন তো ম্যাডাম, ওরা আদিবাসী। মাটির ছোট্ট একটা ঘর। যখন ইন্সপেকশন করতে গেছি, বাড়ির কর্তা কাজে বেরিয়েছে। বউটা দুটো ছোট বাচ্ছাকে খেতে দিয়েছে। কি খাচ্ছে জানেন ম্যাডাম, দেখলে আপনার চোখ ফেটে জল আসবে। শুধু গরম ভাত আর আলু- উচ্ছে সিদ্ধ। আর কিচ্ছু নয় ম্যাডাম। আর কিচ্ছু নয়। ’ আবেগ তাড়িত স্বরে বলছিল ছেলেটা। আমার কিন্তু ভীষণ গর্ব হচ্ছিল আমার পরিবারের এই তরুণ সদস্যের জন্য। কতই না অভিযোগ থাকে সাধারণ মানুষের সরকারি দপ্তরের অমানবিক মুখ নিয়ে, সরকারি কর্মচারীদের নিয়ে। আসলে তো আমরাও হুকুমের নৌকর। আমাদেরও হাত- পা বাঁধা থাকে।
এই ধরণের অনুষ্ঠান করার পিছনে আরেকটাও কারণ থাকে, সবার সাথে দেখা হওয়া। সত্যি কথা বলতে কি তমলুকের দায়িত্বভার গ্রহণ করার পর, দেখেছিলাম এখানে চট করে কেউ আমার আপিসে আসে না। এসএলও/সিএ ছাড়ুন ব্লক/পুরসভার সিকেসিও/ ইন্সপেক্টররাও কেউ খুব একটা আসত না সদর আপিসে। নির্দিষ্ট দিন ছাড়া কেমন যেন খাঁ খাঁ করত আপিসটা। চুঁচুড়ায় তো তাড়ানোই যেত না লোকজনকে। সবসময় গমগম করত আপিসটা। আর এখানে ডেকে পাঠাতে হত। প্রথম আলাপে তাই সাফ জানিয়ে দিয়েছিলাম, এমন করলে হবেনি বাপু। আপিসটা তোমাদেরও। না এলে আমাদের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে উঠবে কেমনে? সুযোগ পেলেই চলে আসুন, কাজে আসুন, অকাজেও আসুন।
সমস্ত উৎসব অনুষ্ঠান উপলক্ষে তাই মিলিত হই আমরা। বানিয়ে নিই মিলনের অছিলা। বাইশের বছরের শেষ কর্মদিবসেও তেমনি মিলিত হবার ব্যবস্থা করেছিলাম আমরা। তবে এবার আর সদর আপিসে নয়, অনুষ্ঠান হবে ময়নায়। ময়না আমার সবথেকে অবহেলিত সন্তান। প্রায় সাত-আট বছর হল ময়নায় কোন পাকা ইন্সপেক্টর নাই। নেই কোন সিকেসিও। ফলে ময়নাকে আমি যখন পাই, বলা যায় ময়না ছিল পক্ষাঘাত গ্রস্ত। জমে উঠেছে কাজের পাহাড়। নিত্য অসন্তোষ। এসএলওদের মধ্যেও চাপা বিক্ষোভের আগুন। নালিশের ঠেলায় জিভ বেরোনোর খাপ। সেখান থেকে বিগত এক বছরে আমার দুই সুযোগ্য ইন্সপেক্টর প্রথমে শ্রী রঞ্জিৎ রাণা এবং পরে শ্রী সৌরভ চৌধুরীর দাক্ষিণ্যে অনেকটাই সেরে উঠেছে ময়না। খরা কাটিয়ে বেরোতে শুরু করেছে বেনিফিটের ফল্গু ধারা। তেমনি অনুদান প্রাপ্ত কিছু মানুষকে নিয়ে বছরের শেষ কাজের দিনটা কাটানোর পরিকল্পনা ছিল আমাদের।
সেই উপলক্ষেই হলদিয়ার বড় সাহেবকে নিমন্ত্রণ জানাতে গিয়ে জানতে পারলাম তিনটি বোর্ডের মাথা তথা আমাদের অতিরিক্ত শ্রম কমিশনার সাহেব ঐ দিন খোদ হলদিয়ায় আসছেন শিল্প তালুক সংক্রান্ত মিটিং করতে। এ সুযোগ কি ছাড়া যায়? ইতিপূর্বে আমাদের কোন অনুষ্ঠানে এ সিইও সাহেব থাকতে পারেননি। যদি ঐদিন আমাদের পনেরো কুড়িটা মিনিট সময় দেন, পুরো টিম তাম্রলিপ্ত ধন্য হয়। বিশেষতঃ ময়নার জন্য এটা বিরাট ব্যাপার হয়।
আমাদের বড় সাহেবের অনুরোধ ফেলতে পারেন না সিইও স্যার। সম্মতি দেন উপস্থিত থাকার। শুধু দুটো শর্ত ছিল, প্রথমতঃ অনুষ্ঠানটি বছরের শেষ কর্মদিবসে করা যাবে না। কারণ ঐ দিন বিশেষ কারণবশতঃ নবমহাকরণের আপিস ছেড়ে আসতে পারবেন না উনি। আর দ্বিতীয়তঃ অনুষ্ঠানটি জেলাশাসকের করণে করতে হবে এবং তাতে আমন্ত্রণ জানাতে হবে খোদ জেলাধীশকে।
আমাদের খামখেয়ালী - তুচ্ছ অনুষ্ঠানে ইতিপূর্বে কখনও ডিএম সাহেবকে ডাকার কথা আমরা ভাবিওনি। আমাদের দৌড় বড়জোর মহকুমা শাসক অবধি। তাও যখন তিনি আমার গৃহকর্তা ছিলেন। অন্যথায় হলদিয়ার বড় সাহেব আর আমরাই নিপটে নিই নিজেদের মত করে। এত্ত বড় সাহবদের খাতিরযত্ন করার সাধ্য কি আমাদের। সময়ও বেশ কম। ইয়ে বাজেটের কথা বলে আর লজ্জা পেতে চাই না। ভাগ্যে ক্যান্টিনে ধারবাকি চলে।
দেখতে দেখতে এসে যায় নির্দিষ্ট দিনটা। বড় হলটা পাই না আমরা। মাঝারি হলের জন্য কমিয়ে দিতে হয় লোক। কোলাঘাটের সৌম্য অনুষ্ঠানের নাম দেয়, ‘শ্রমিকসঙ্গে নববর্ষ- ২০২৩’। অফিস আসার পথে ফ্লেক্স ছাপিয়ে আনে শুভাশিস। সময় জানিয়ে আরেকবার পেনশনারদের ফোন করে নেয় নন্দন। রঙিন শংসা পত্র ল্যামিনেট করিয়ে এনে শান্তনু দেখে Seikh/Sekh আর Sk এ বিস্তর গোলমাল। গোলমাল মাঝি আর মাজিতেও। নন্দকুমার থেকে রামচন্দরের নাম ঢোকানোর জন্য পিড়াপিড়ি করতে থাকে রঞ্জিৎ। রাগের চোটে কোথা থেকে ল্যামিনেট করার মেশিনটাই তুলে নিয়ে চলে আসে শান্তনু।চটজলদি ভিআইপি ফোল্ডারের রিপোর্ট বানায় বেদজ্যোতি। সেজেগুজে হাজির হয়ে যায় আমাদের মেয়েরা। কাউকে কিছু বলতে হয় না। তেল দেওয়া যন্ত্রের মত নিজ নিজ দায়িত্ব পালন করে যায় আমার টিম।
ঘড়ি ছোটে, সঞ্চালনা মক্স করি সৌম্য আর আমি। কোনটা কে বলবে। সম্প্রতি আমাদের টিমের এক সদস্যকে হারিয়েছি আমরা। নন্দকুমার ব্লকের কল্যাণপুর পঞ্চায়েতের এসএলও তাপস বাবু পাড়ি দিয়েছেন অমৃত লোকে। তাঁর স্মৃতির উদ্দেশ্যে এক মিনিট নীরবতা পালনের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম আমরা। সৌম্য প্রস্তাব দেয় তাপস বাবুর সাথে আমাদের মৃত বেনিফিশিয়ারিদের উদ্দেশ্যেও এক মিনিট নীরবতা পালন করা হোক।
দেখতে দেখতে এসে যায় মাহেন্দ্রক্ষণ। বড় সাহেবের জন্য নীচের গেটে প্রতীক্ষারত ইন্সপেক্টর রঞ্জিত দৌড়ে এসে খবর দেয়, সিইও স্যার এসে গেছেন। সাথে ডিএম স্যারও আসছেন। আর আসছেন এডিএম ম্যাডাম। হক বাবু আর শুভাশিস ইশারায় জানায়, আছে আছে ফুল আর উত্তরীয় দু-চার খানা বেশিই আছে। চন্দনের ফোঁটা, পুষ্পস্তবক, উত্তরীয় দিয়ে মাননীয় অতিথিদের বরণ করে নেয় আমাদের মেয়েরা। প্রারম্ভিক ভাষণ দেন হলদিয়ার বড় সাহেব। এডিএম ম্যাডাম বক্তৃতা থেকে অব্যাহতি চান। মূল্যবান বক্তব্য রাখেন ডিএম সাহেব। সবশেষে মাইক হাতে নেন আমাদের সিইও মহোদয়।
ঘড়ি ছোটে। বেনিফিট প্রদান শুরু হয়। সৌম্যর হাতে মাইক, একে একে নাম পড়া হয়। কে পাচ্ছেন,কি পাচ্ছেন,কোথা থেকে পাচ্ছেন। বার বার ময়নার নাম উঠতে থাকায় বোধহয় কুঞ্চিত হয় ডিএম সাহেবের ভ্রু। সৌম্যকে থামিয়ে মাইক ধরি আমি। বলি ময়না আমার দুর্বলতম LWFC ছিল। রঞ্জিত আর সৌরভের জন্য আজ অন্তত লাঠি নিয়ে হাঁটছে। ডিএম স্যার খুশি হয়ে দেখতে চান এই রঞ্জিত আর সৌরভ কারা। উঠে দাঁড়ায় আমার দুই ইন্সপেক্টর। ভূয়সী প্রশংসা পায় জেলাধীশের কাছে। হাততালিতে ভেসে যায় পেক্ষাগৃহ। তারই মধ্যে সৌরভ বলে ওঠে, ‘ একলা পারতাম না স্যার। প্রচুর সাহায্য পেয়েছি ময়নার SLOদের থেকে। যা করেছি, সবাই মিলেই করেছি।’
অনুষ্ঠান শেষ হয়ে যায়, মান্যগণ্য অতিথিরা বিদায় নেন। সন্ধ্যে নামে। ব্যাগ গোছাই। অন্য এক যুদ্ধের জন্য। আগামী কাল ছুটি, বাসে নির্ঘাত আজ মারকাটারি ভিড় হবে। হেঁড়িয়া অবধি সিট পাবার কোন গল্প নেই। বেরিয়ে আসছি, কে যেন বলল,‘ কাজ না তুলতে পারার জন্যই বকুনি খেয়েছি এতদিন। এই ভাবে সবার সামনে দাঁড় করিয়ে প্রংশসা-'।
No comments:
Post a Comment