#কাঁথিরকিস্যা
‘কাল কখন ফিরলেন ম্যাডাম?’ জানতে চাইলেন নূপুর বাবু। সদ্য সদ্য কাঁথির মহকুমা শাসকের সরকারী নিবাসের সীমানা ছেড়ে বেরিয়েছি আমরা। গন্তব্য দীঘা বাইপাস।
দীঘা বাইপাস থেকেই বাস ধরব আমি। বেদজ্যোতি তাই বলেছে। বেদজ্যোতি আমার ইন্সপেক্টর,স্থানীয় ছেলে এবং তমলুক- কাঁথি রুটের নিত্যযাত্রী। আপাতত আমার পথপ্রদর্শকও বটে। হতোদ্যম হয়ে পড়লে ওকে দেখে অনুপ্রেরণা পাই। ও যদি পারে, আমি পারব না কেন?
এতদসত্ত্বেও সকাল থেকে কেন যে গরম হয়ে থাকে মাথা। ভোর বেলাতেই ধমকে দিই মেয়েটাকে সম্পূর্ণ অকারণে। নীরবে, নতমস্তকে মায়ের কটু কথা শুনে, স্কুলের রাস্তা ধরে তুত্তুরী। পলকে শতছিন্ন হয়ে যায় তুত্তুরীর মায়ের হৃদয়। মা হওয়া কি মুখের কথা!
একরাশ মনখারাপ নিয়েই রওণা দিই আপিসের পথে। সঙ্গী বলতে নূপুর বাবু। গাড়ি চালাতে চালাতে নানা প্রশ্ন করেন ভদ্রলোক। অনেক মজার মজার কথাও বলেন। যেমন আগের দিনের বাসটা আমায় সেন্ট্রাল বাসস্ট্যান্ড যাবে বলেও, শেষ পর্যন্ত খড়্গপুর বাইপাসে নামিয়ে দিয়েছে শুনে উনি বললেন,‘ফের যদি এমনি বলে ম্যাডাম, আপনাকে কিছু করতে হবে না, আপনি শুধু বাসের নম্বরটা টুকে নিবেন।’ নম্বর টুকে যে কি করব ভগবান জানে। হাসি চেপে জানলার বাইরে তাকাই আমি। নূপুর বাবু এবার পড়েন, টোটোওয়ালাকে নিয়ে। কেন টোটোওয়ালা আমায় মহকুমা শাসকের করণ অবধি পৌঁছে দেয়নি? ‘লাইসেন্স নিয়েছে আর প্যাসেঞ্জার নিবেনি? বললেই হল? ফের যদি কেউ এমন করে, তাহলে আপনি ম্যাডাম, তাকে আটকে রেখে আমায় ফোন করবেন। আমি ছুট্টে চলে যাব-’।
ধেড়ে গাড়িটা নিয়ে উনি ছুটে আসবেন আমার হয়ে টোটোওয়ালার সাথে ঝটাপটি করতে,ব্যাপারটা কল্পনা করে হাসি চাপা দায়। মন খারাপ জানলা গলে পালায়। দূর থেকে দৃশ্যমান হয় দীঘা বাইপাস। চৌমাথায় হর্ন বাজাচ্ছে একটা বাস। বাসের সামনে গিয়ে দাবাং স্টাইলে গাড়ি দাঁড় করালেন ভদ্রলোক। ‘ম্যাডামকে তুলে লাও তো। নিমতৌড়ি ডিএম আপিসে নাবিয়ে দেবে।’
বাসে উঠে গেলাম,বেদজ্যোতির সাথেও দেখা হয়ে গেল। নূপুর বাবু তখনও নীচে দাঁড়িয়ে, ‘তাহলে ম্যাডাম, সব ঠিক আছে তো? আপনি যদি রোজ এক টাইমে বেরোন, তাহলে সেরকম হলে আপনার জন্য একটা সিট বেঁধে রাখতে বলব।’ হাত নেড়ে ইশারায় বলি, এবার যান। রোজ একসময়ে বেরোন আমার অসাধ্য। কোনদিন পাঁচ মিনিট লেট করে ফেলি তো কোনদিন দশ মিনিট আগে হয়ে যায়। লেট হলে বাস পালায়। আর জলদি এলে বাস লেট করে। এযেন এক অলাতচক্র।
বেদজ্যোতি যদিও আশ্বস্ত করে, ‘বাস অনেক পাবেন ম্যাডাম। একটু দাঁড়িয়ে গেলেই স্টেট বাসও পেয়ে যেতে পারেন। দারুণ আসে বাস গুলো।’ নূপুর বাবু আবার কিছুতেই স্টেট বাসে চাপানোর পক্ষপাতী নন। ‘সব জানলা খোলা, প্রচণ্ড হাওয়া ঢোকে। স্টেট বাস শীতকালে ভালো না। আপনাকে আমি ভালো এসি বাসে তুলে দিব। দেখবেন ভিতরে কেমন ওম পাবেন। উঠে ঘুমিয়ে পড়বেন, ওরা ঠিক ডেকে দেবে। আমি বলে দিব খন।’
ঘুমানো অবশ্য অত সহজ নয়। প্রথমদিন যে এসি বাসটিতে উঠেছিলাম, তাতে রমরম করে কি যেম একটা সিনেমা চলছিল। কোন দক্ষিণী ছবির হিন্দি ভাষান্তর। কোনটা নায়ক আর কোনটা যে খলনায়ক বোঝা দায়। কথায় কথায় ধুন্ধুমার। আর না হলে দক্ষিণী নাচগান আর বিটকেল প্রেম। তেমনি সব সংলাপ, যেমন, ‘ভাই রে ভাই,রক্কি ভাই’ বা ‘তু ব্যাড হ্যায়, তো ম্যাঁয় তেরা ড্যাড হ্যায়। সমঝা না!’ বা ‘তু গ্যাংস্টার হ্যায়, তো ম্যায় মনস্টার হ্যায়।’ ইত্যাদি প্রভৃতি। পুরো সিনেমাটাই কেমন যেন ধুলোয় মাখা ধুসর রঙের। দেখব না, দেখব না করেও বেশ খানিকটা দেখেই ফেললাম। পাশ থেকে বেদজ্যোতি বলল, ‘ম্যাডাম এই বাসে রোজ এই সিনেমাটাই চলে।কালও দেখতে পাবেন। এখন ঘুমিয়ে পড়ুন।’
সত্যিই ঘুমিয়ে পড়েছিলাম, ভালো করে ওড়না মুড়ি দিয়ে। ঘন্টা দেড়েক পর যখন ঘুম ভাঙল, বাস কোলাঘাট ব্রীজ পেরোচ্ছে। কি সর্বনাশ! আমরা তো পূব মেদিনীপুরের সীমানা ছাড়িয়ে হাওড়া জেলায় ঢুকে পড়ব গো। কেউ ডাকেও নি। টিকিটও তো কাটেনি। কি জ্বালা।
এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখি বেদজ্যোতিও ঘুমাচ্ছে। ঠেলে তুললাম ব্যাটাকে। দেউলটিতে নামতে হবে। তারপর উত্তমকুমারকে ডেকে নেওয়া ছাড়া গতি নেই। ঘুম চোখে জানলার বাইরে খানিক তাকিয়ে থেকে জড়ানো গলায় বেদজ্যোতি বলল,‘ম্যাডাম, এটা তো নরঘাট ব্রীজ। নীচে রূপনারায়ণ নয়, হলদি নদী। এখনও নন্দকুমারই আসেনি। আর একটু ঘুমিয়ে নিন।’
বারোটা থেকে মিটিং ডেকেছিলাম। আপিসে ঢুকে দেখি, ১১টা থেকেই লোকজন এসে বসে আছে। কটা দিন ছুটি নিয়েছিলাম নতুন করে সংসার গোছানো আর তুত্তুরীকে নতুন স্কুলে থিতু করানোর জন্য, পালিয়ে তো যাই নি। যাবার আগে ম্যারাথন মিটিং করে প্রায় মিটিয়ে এনেছিলাম সমস্যা গুলো। গুটি কয়েক সিদ্ধান্তে যদিও উপনীত হয়নি কেউই। বলেছিলাম ধৈর্য ধরতে। বলেছিলাম উভয়পক্ষকে সামনাসামনি বসে আরেকদফা আলোচনা করতে। যদি মিটে যায় বা যদি নাও মেটে আমাকে যেন জানায়, তেমন হলে ছুটির মধ্যেই চলে যাব একদিন, শুধু ওদের জন্য।
বাবুরা আমার কথা খানিক শুনেছেন খানিক শোনেননি। ধৈর্য ধরেননি মোটেই। ঝটপট দ্বিপাক্ষিক আলোচনায় বসে পড়েছেন। বসেও যখন কোন সমাধান সূত্র বেরোয়নি, সৃষ্টি হয়েছে উত্তেজনা। ঘটেছে কিছু অপ্রীতিকর ঘটনাবলী। নির্মূল হতে বসা রোগ ছড়িয়ে পড়েছে প্রতিটি অঙ্গ থেকে তন্ত্রে।
ঝাড়া সাড়ে পাঁচ ঘন্টার মিটিং করে আবার পূর্বের জায়গায় ফিরতে ফিরতে রীতিমত কালঘাম ছুটে গেছে আমার। টিফিন করারও অবকাশ হয়নি কারো। বেলা আড়াইটে নাগাদ বলেছিলাম,সবাই চাইলে খেয়ে আসতে পারেন। কেউ রাজি হয়নি নড়তে। খাওয়া বলতে বার তিনেক জহরবাবুর হাতে বানানো আদা দেওয়া কালো চা। কোথা থেকে যে আদা জোগাড় করে এনেছে লোকটা ভগবান জানে।
শেষে তিনটে নাগাদ শুভাশিষকে বলতে বাধ্য হলাম, একটু ভালো দুধ চা আর বিস্কুট আনতে পাঠাও। একে খালি পেট তারওপর আমার বকুনি, মরে যাবে যে লোকগুলো। পাঁচটা দশ নাগাদ সবপক্ষ একসাথে করজোড়ে বলল,‘ছেড়ে দিন ম্যাডাম। মাথা ভোঁ ভোঁ করছে।’
সবকটাকে তাড়িয়ে টিফিন বাক্স খুলতে যাচ্ছি, জনা ছয়েক নেতা ঢুকে এসে অনুরোধ করল,‘ম্যাডাম, আজকের মিটিং এ কি হল, সেটা শ্রমিকদের যদি আপনি একটু বলে দেন তো খুব ভালো হয়। ’ বলাশোনার পাঠ যখন শেষমেষ মিটল রীতিমত গা গুলোচ্ছে। খাবারটা পচে গেল নাকি কে জানে। উত্তমকুমার বলল,‘ থাক ম্যাডাম আপনাকে আজ আর বাসে গিয়ে কাম নেই। আমি ছেড়ে আসি বরং।’ বেদজ্যোতিকেও সঙ্গে নিলাম আমরা, ওর বাড়ির কাছেই যাচ্ছি যখন। সঙ্গে নিলাম হক বাবুকেও। নন্দকুমার মোড়ে নামিয়ে দেব বলে। ঐ রাস্তাতেই যখন গাড়িটা যাবে, মুড়ির টিনের মত যতজনকে চেপেচুপে নিয়ে যাওয়া যায়, তুলে নিই আমি।
গাড়িতে বসে সবে টিফিন কৌটো খুলে মুখে এক গরাস দিয়েছি, উত্তমকুমার জানাল, গাড়ি আজ আর নড়বে না। কি হয়েছে ভগবান জানে,স্টার্টই নিচ্ছে না ব্যাটা। হক বাবু আর বেদজ্যোতিতে মিলে বেশ খানিকটা ঠেলল গাড়িটাকে, বনেট খুলে খুটখাট করল সবাই মিলে। গাড়ি আর নড়েই না।রাত বাড়ছে। এখন বাসে ভিড়ও হবে প্রচণ্ড। আর একটু আগে বেরোলে ভালো হত। আর সময় নষ্ট করা উচিৎ নয়। টিফিন বাক্স বন্ধ করে উঠে পড়লাম আমরা। কালেক্টরেটের গেট দিয়ে বেরোচ্ছি, একটি ছেলে একগাল হেসে বলল, ‘ম্যাডাম আজ হেঁটে যাচ্ছেন?’ ঘাড় নেড়ে বললাম, হ্যাঁ রে বাবা। দেখ না, আজই গাড়িটা বিগড়েছে।
নিমতৌড়ি বাসস্ট্যান্ড এখান থেকে হাঁটা পথে বেশ খানিকটা। পাশের হাইরোডে গিয়ে দাঁড়ালাম তিনজনে। তেমন আলো নেই এখানে। কে জানে হাত দেখালে বাস আদৌ দাঁড়ায় কি না। হক বাবু আর বেদজ্যোতি যদিও আশ্বস্ত করল,‘ বাসের বাবা ও দাঁড়ায়।’ একখানা বাস বেরিয়ে গেল পাশ দিয়ে, উঠতেই যাচ্ছিলাম, বেদজ্যোতি আটকাল। ‘কেমন ভিড় দেখছেন ম্যাডাম। গোটা রাস্তা দাঁড়িয়ে যেতে হবে। একটু দাঁড়ান, পরে আরো বাস পাবেন।’ ঘড়ি দেখে হিসেব করলাম, বাড়ি পৌঁছাব কটায়। খেতে পাব কখন। সকালের ভাত খাবার পর সাড়ে আটঘন্টা কাটতে চলল।
ব্যাগের মধ্যে ঝনঝনিয়ে উঠল মোবাইল, কিঞ্চিৎ বিরক্ত হয়ে ব্যাগ থেকে ফোনটা বার করে দেখলাম, উত্তমকুমার। বাস পেয়েছি কিনা জানতেই ফোন করছে নির্ঘাত। অনুমাণ অকাট্য, ঠিক তাই বলল উত্তমকুমার,‘বাসে উঠে গেছেন? ’ বললাম না। অতঃপর উত্তমকুমার বললেন,‘উঠবেননি। উঠবেননি ম্যাডাম। আমি আসছি।’ হু হু করে হর্ন বাজাতে বাজাতে ছুটে এল উত্তমকুমারের গাড়ি। উঠে যে যার সিটে বসে, টিফিন বাক্স খুললাম আমি, আর হক বাবু শুধোলেন, ‘তোর গাড়ি চলল কি করে রে উত্তম।’ মহানায়কের স্টাইলে আমাদের উত্তমকুমার বলল,‘আপনারা ঠেলতে পারেননি তাই চলেনি। আমি পাঁচটা ড্রাইভার ডাকলাম, সবাই মিলে হেঁইও করে ঠেলল, ব্যাস অমনি-। স্টার্ট নিতেই আমি ম্যাডামকে ফোন করলাম। ভয় পাচ্ছিলাম, যদি আপনারা বাসে উঠে পড়েন।’ হকবাবু বললেন,‘আবার যদি বন্ধ হয়ে যায়, কি করবি?’ ফোঁৎ করে নিশ্বাস ফেলল উত্তমকুমার, ‘ এই যে স্টার্ট লিয়েছে, আর স্টার্টের বাবাও বন্ধ হবেনি। দেখে নিবেন।’ খোলা জানলা দিয়ে ছুটে আসছে শেষ ডিসেম্বরের সন্ধ্যের হিমেল হাওয়া, সকালে বানানো আলুকপি বিনের তরকারি এক চামচ মুখে দিয়ে প্রবল স্বস্তির শ্বাস নিলাম আমি। চালাও পানসি কাঁথি নগরী। এই তো জীবন কালি দা।
No comments:
Post a Comment