কোভিড কথা - ২৯শে এপ্রিল, ২০২১
১। বাতাসের শতকরা ২১ ভাগই হল অক্সিজেন। এমনিতে একজন সুস্থ মানুষ এই ২১ শতাংশ অক্সিজেন নিয়ে দিব্য থাকতে পারে, কিন্তু কোভিডে ধরলে বা শ্বাসকষ্ট শুরু হলে তা মোটেই যথেষ্ট নয়। তখন প্রয়োজন শতকরা ৯৮ ভাগ বিশুদ্ধ অক্সিজেন। যা পাওয়া যায় অক্সিজেন সিলিন্ডার থেকে এবং বর্তমানে যার তীব্র আকাল সমগ্র দেশ জুড়ে।
২। জানেন কি, আমাদের দেশে অক্সিজেনের আদতে কোন ঘাটতি নেই? যেখানে এই পরিস্থিতিতেও দেশের মোট চাহিদা দৈনিক ৭০০০ মেট্রিকটন মাত্র, ভারতের উৎপাদন ক্ষমতা ৭৮০০ মেট্রিকটন। বর্তমান পরিস্থিতিতে ভারত সরকার যা বাড়িয়ে করেছেন ৯০০০ মেট্রিকটন।
২। আমাদের সমস্যা উৎপাদন নয়, সমস্যা হল পরিবহন। অক্সিজেন গ্যাসকে তো আর এমনি পরিবহন করা যায় না। -১৮৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের তরল অক্সিজেন পরিবহন করতে প্রয়োজন বিশেষ ধরণের ট্যাঙ্কার, যাদের বলে ক্রাইওজোনিক ট্যাঙ্কার।
৩। কি ভাবছেন এই ক্রাইওজেনিক ট্যাঙ্কার আমাদের নেই? নাঃ মশাই,দিব্যি আছে। কিন্তু যখন আচমকা ফিরে এল মহামারী, দেখা গেল সংখ্যা অপ্রতুল হলেও আছে তো, কিন্তু ছড়িয়ে আছে দেশ জুড়ে।
৪। ভারতে অক্সিজেন মূলতঃ তৈরী হয় রাউড়কেল্লা, দুর্গাপুর, ভাইজাগ ইত্যাদি স্টিল প্ল্যান্ট গুলিতে। খালি ট্যাঙ্কার গুলিকে এই প্ল্যান্টে পৌছানো এবং ভর্তি ট্যাঙ্কার নিয়ে যাওয়ার জন্য আপাততঃ কোমর বেঁধে নেমেছে ভারতীয় বিমানবাহিনী এবং ভারতীয় রেল।
৫। বায়ুসেনার সবথেকে বড় যুদ্ধ বিমান সি-১৭ গ্লোব মাস্টারে ভর্তি করে আনা হচ্ছে খালি ট্যাঙ্কার, আবার ভর্তি ট্যাঙ্কার নিয়ে দৌড়চ্ছে ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে।
৬। তেমনি একসাথে অনেকগুলি খালি বা ভর্তি ট্যাঙ্কার বহনের জন্য ভারতীয় রেল চালু করেছে RO-RO Train Service। সোজা কথায় Roll-on/roll-off। শয়ে শয়ে ট্যাঙ্কার একলপ্তে পরিবাহিত হচ্ছে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে।
৭। এছাড়াও সিঙ্গাপুর থেকে বেশ কিছু ক্রায়োজেনিক ট্যাঙ্কার আমদানি করেছে ভারত। বেশ কিছু ট্যাঙ্কার আনিয়েছে টাটাও।
৮। পাশে দাঁড়িয়েছে ভারতীয় সেনাবাহিনী।ভারতীয় সেনাদের জন্য DRDOর বানানো বিশেষ ভাবে তৈরী অক্সিজেন সিলিণ্ডারও দেওয়া হচ্ছে নানা হাসপাতালে।
৯। জার্মানি থেকে ২৫ খানা পোর্টেবল অক্সিজেন জেনারেশন প্ল্যান্ট কিনেছে ভারত। যা ঝটপট বাতাস থেকে নিঙড়ে নেবে বিশুদ্ধ অক্সিজেন।
১০। পরিস্থিতি বদলাচ্ছে। তবে রাতারাতি তো আর বদলাবে না। বদলাতে লাগবে সময়। বিশেষজ্ঞরা ইতিমধ্যেই বারংবার বলে চলেছেন আগামী ১৫-২০শে মে’র মধ্যে শীর্ষে পৌছাবে করোণার দ্বিতীয় ঢেউ। যখন দৈনিক সংক্রমণের মাত্রা ছোঁবে ৫ থেকে ১০ লাখ। প্রত্যহ মারা যাবেন পাঁচ থেকে দশ হাজার মানুষ। তাই এই মুহূর্তে সবথেকে জরুরী যেটা, সেটা হল সাবধানে থাকুন। নিয়ম মেনে চলুন। মাত্র কটা দিন। চায়ের ঠেকের মাতব্বররা যাই বলুক না কেন, সরকার সচেতন হয়েছে, লোহার বাসরঘরের ফুটোও মেরামত করার আপ্রাণ চেষ্টা চালাচ্ছে। পরিস্থিতি বদলাবেই। আপাততঃ যেটা করবেন-
ক) মাস্ক, স্যানিটাইজার, দূরত্ববিধি ছাড়াও রোজ জিঙ্কওয়ালা একটা ভিটামিন খান নিয়ম করে।
খ) খান ভিটামিন সি।
গ) মাপতে থাকুন অক্সিজেন। অক্সিজেনের মাত্রা ৯৫ এর সামান্য নীচে নামলেই অক্সিজেন খুঁজতে বেরোবেন না। প্রুনিং পোজিশনে শুয়ে পড়ুন। জানেন তো আমাদের দুই ফুসফুসেরই কিছুটা অংশ বিশেষতঃ মাঝের অংশটুকু সাধারণ ভাবে অব্যবহৃত থেকে যায়। এমতবস্থায় যদি বুকের নীচে দুটো বালিশ রেখে উপুড় হয়ে শুয়ে পড়েন, ফুসফুসে যে চাপ পড়ে, তাতে চলতে শুরু করে ঐ অংশটুকুও। সকাল বিকাল আধঘন্টা করে অমন শুয়ে থাকুন। মাঝে মাঝে পাশ ফিরে শোন। তবে দুটো হাতই যেন একদিকে থাকে। তারপর পীঠে বালিশ ঠেস দিয়ে কিছুক্ষণ বসুন। এতেই কাজ হবে।
সবশেষে বলি আবারও সাবধানে থাকুন, অযথা আতঙ্কিত হবেন না। ভরসা রাখুন। এই অন্ধকারেও আমরা একা নই। বন্ধুরা আছেন। রাশিয়া যেমন কথা দিয়েছে প্রতি সপ্তাহে ৪ লক্ষ করে রেমডেসিভার পাঠাবে। পাঠাবে অক্সিজেন। ক্রায়োজেনিক ট্যাঙ্কার। এমনকি পাশে দাঁড়িয়েছে পাকিস্তানও।
ভিরাফিনের গল্প শুনেছেন তো? আমাদের নিজেদের তৈরী ওষুধ, বানায় আমাদের ঘরের কোম্পানি Zydus Cadila। ভিরাফিন কিন্তু অনেক দিন ধরেই বাজারে চলে, হেপাটাইটিস-বি এর ওষুধ হিসেবে। ভিরাফিন যেটা করে তা হল আমাদের শরীরে ইন্টারফেরন আলফা নামক কোষের সংখ্যা বাড়িয়ে দেয়। যারা মুখোমুখি যুদ্ধ করে শরীরে অনুপ্রবেশকারী যে কোন অবাঞ্ছিত অতিথির সাথে। হেপাটাইটিস বি ভাইরাসও RNA ভাইরাস আর কোভিডও তাই। পরীক্ষা করে দেখা গেছে মাত্র সাতদিনে কোভিডকে ঠেঙিয়ে বের করে দেয় এই ওষুধ। রাতারাতি ভারত সরকার অনুমতি দিয়েছে ভিরাফিন ব্যবহারের, তবে শুধু মাত্র হাসপাতাল গুলিতে।
যাই হোক মোদ্দা কথা আবার বলি- সাবধানে থাকুন। অন্তত ২০শে মে অবধি টিকে থাকুন। তারপর পরিস্থিতি বদলাবেই। আমি ভয়ানক আশাবাদী।
কোভিড কথা- ৩০শে এপ্রিল, ২০২১
আজকের পরিসংখ্যান দেখেছেন নাকি? সরকারি বুলেটিন অনুযায়ী গত ২৪ ঘন্টায় রাজ্যে নতুন করোনা আক্রান্ত ১৭,৪১১, মোট নমুনা পরীক্ষার(৫৩,২৪৮) প্রায় ৩২.৬৯% । মৃত ৯৬ জন।
সারা ভারতের আজকের পরিসংখ্যান এখনও সম্পূর্ণ নয়, কিন্তু গতকালই আক্রান্ত হয়েছিলেন ৩ লক্ষ ৮৬ হাজার মানুষ। মৃত সাড়ে তিন হাজার। বিগত বেশ কিছুদিন ধরে এই পরিসংখ্যান খুব মনোযোগ দিয়ে দেখছি আমি, দেখাচ্ছি আমার টিমকে। কারণ যাই হোক, আপিসটা তো করতে হবে-। আবার পিতৃদত্ত প্রাণটাও বাঁচাতে হবে। তো যা বলছিলাম, নিয়মিত পরিসংখ্যান পর্যবেক্ষণ করলে যেটা চোখে আঙুল দিয়ে দেখা দেয় তা হল, প্রতিনিয়ত যে সংখ্যক মানুষ খাতায়কলমে আক্রান্ত হচ্ছেন, মারা যাচ্ছেন তার শতকরা ১ ভাগ মানুষ।
এমতবস্থায় আজকে আত্মপ্রকাশ করা মাননীয় মূখ্য সচীবের যে অর্ডারটিকে (618-ISS/2M-22/2020 dated 30th April, 2021) ঘিরে এত বিতর্ক, এত বিশেষ ভাবে অজ্ঞ মতামতের আদানপ্রদান চলছে, সেটা যদি একটু কষ্ট করে পড়ে দেখেন, তাতে কোথাও 'আংশিক লকডাউন' শব্দবন্ধটি ব্যবহারই করা হয়নি।
এতে বলা হয়েছে যে বিগত ২৫ এবং ২৯ তারিখে প্রকাশিত ভারত সরকারের স্বাস্থ্য এবং পরিবার কল্যাণ দপ্তরের দুটি নির্দেশনামা অনুসারে এবং বিপর্যয় মোকাবিলা আইনের ২২ নং ধারা অনুসারে-
'১। সমস্ত শপিং কমপ্লেক্স, মল, বিউটি পার্লার, সিনেমা হল, জিম, সুইমিং পুল, স্পা, রেস্তোরাঁ, বার সব অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ থাকবে। কিন্তু হোম ডেলিভারি এবং যাবতীয় অনলাইন সার্ভিস খোলা থাকবে।'
অর্থাৎ রেস্তোরাঁ বন্ধ বলে যারা হাহুতাশ বা মুণ্ডপাত করছিলেন, তা কিন্তু যথার্থ নয়। গিয়ে বসে খেতে পারবেন না বটে, সুইগি, জ্যোমাটো কিন্তু এনে দিতেই পারে। মল বন্ধ বটে কিন্তু চলতেই পারে অ্যামজন, মিন্ত্রা বা নাইকাতে শপিং।
'২।যাবতীয় সাংস্কৃতিক, সামাজিক, শিক্ষামূলক বা বিনোদনমূলক জমায়েত নিষিদ্ধ। '
এখন এই নিয়ে যদি আপনার মটকা গরম হয়, তো দাদা/দিদি আইসব্যাগ কিনে নিন না একটা।
'৩। বাজার/হাট খোলা থাকবে সকাল ৭-১০টা আর বিকাল ৩-৫টা। কিন্তু যাবতীয় মুদির দোকান, ওষুধের দোকান বা মেডিক্যাল ইকুইমেন্টের দোকান ইত্যাদি আপদকালীন পরিষেবা মূলক দোকানগুলি এই নিয়মের মধ্যে পরে না। '
আর বলা হয়েছে যে 'কাউন্টিং হল বা বিজয়ীদের মিটিং, মিছিল , রালি ইত্যাদি কেবল মাত্র নির্বাচন কমিশনের ২৭ শে এপ্রিলের নির্দেশ নামা মেনেই হবে। বলা হয়েছে কেউ যদি এই নির্দেশনামা উলঙ্ঘন করেন তবে বিপর্যয় মেকাবিলা আইন এবং আইপিসি অনুসারে তার বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।'
মোটামুটি আক্ষরিক তর্জমা করে দিলাম, অর্ডার নম্বরটিও দিলাম, পারলে একবার আসল অর্ডারটি পড়ে নিন। ভুলত্রুটি হয়ে থাকলে নিজগুণে মার্জনা করবেন।
এখন আপনি প্রশ্ন করতেই পারেন এই নির্দেশনামা কবে থেকে বলবৎ হবে? উত্তর হল আজ থেকেই। পড়তে গেলেই দেখতে পাবেন লেখাই আছে, ‘This order will take immediate effect’। কতদিন পর্যন্ত? যতদিন না পরবর্তী নির্দেশনামা বেরোচ্ছে। ততদিন পর্যন্ত সাবধানে থাকুন, নিয়ম মেনে চলুন, মাস্ক পরুন, হাত সাফ রাখুন, ভিটামিন খান, অক্সিজেন মাপুন আর প্লিজ প্লিজ উল্টোপাল্টা গুজব ছড়াবেন না বা তাতে কান দেবেন না। কেমন?
No comments:
Post a Comment