Tuesday, 13 April 2021

অনির ডাইরি, ১৩ই এপ্রিল, ২০২১

 



বলেছিলাম, আগামী কাল নীল, একটা বেল এনো তো। তা এনেছেন বটে, তবে আমার সুবিধার কথা ভেবে বেলটিকে ফাটিয়ে এনেছেন।  তাই দিলাম ঠাকুরকে, 'প্রভু, তোমার যা অভিরুচি'। 


এই বাড়ির নিয়মকানুন কিছুই জানি না। শ্বশুরমশাই যেমন কড়া নাস্তিক, শাশুড়ীমা তেমনি প্রগতীশীলা। উপোসতিরেস প্রসঙ্গে প্রথমেই জানিয়ে দিয়েছিলেন, ‘তোমার যা প্রাণ চায়,কোরো-’। এমনিতে যে আমি খুব ধর্মপরায়ন লক্ষ্মীমন্ত মেয়ে তা নই, বরং সর্বার্থে লক্ষ্মীছাড়া, অলবড্ডে তথা হদ্দ কুঁড়ে ‘নারী বদ’ বলে অত্যন্ত শ্লাঘা বোধ করি, তবুও বছরে ছটা ষষ্ঠী অার দুটো অষ্টমী করেই ফেলি টুকটুক করে। সবটুকুই আমার বাপের বাড়ির নিয়ম মেনে।  কেন করি? এ প্রশ্ন বিগত এক যুগে আমার শ্বশুরমশাই তথা তাঁর জ্যেষ্ঠ পুত্র অগণিত বার করেছেন- জবাবটা আমিও ঠিক জানি না। করি, কারণ মা করত, থুড়ি এখনও করে। আর করি, মেয়েটার শিকড়ে খানিক বাঙালীয়ানার মাটি জোগাতে। বড় বেশি ট্যাশ তৈরি হচ্ছে এরা, একটু তো বাঙালী হোক, বারো মাসে বাঙালির তেরো পার্বণের সাথে কিছুটা তো আলাপ জমুক। 


জৈষ্ঠ্যে আসে জামাইষষ্ঠী। ভাদ্রে চাপড়া ষষ্ঠী। দুর্গা ষষ্ঠীর ঠিক একমাস আগে। কি দারুণ মিষ্টি মিষ্টি মুগডালের বড়া বানাত ঠাকুমা, চাপড়া ষষ্ঠী এলেই। মিষ্টি দই মাখিয়ে সেই বড়ার আস্বাদ আজও কোথাও জেগে আছে স্বাদকোরকের কোন গহীন অংশে। রান্নাঘরের মস্ত শিলনোড়াখানি এই সময় রাতারাতি হয়ে যেত মা ষষ্ঠী। গোটা ফল দিয়ে পুজো হত তাঁর। কোলের বাছাদের স্নান করতে নিষেধ করত ঠাকুমা। সন্ধ্যা ঢললে, যখন পশ্চিমের নিম গাছের ফাঁক দিয়ে উঁকি মারত বুড়ি চাঁদ, উঠোনের লাগোয়া দখিন খোলা রোয়াকে আঁচল বিছিয়ে শুয়ে, চাপড়া ষষ্ঠীর গল্প শোনাত ঠাকুমা। কোলের কাছে বিড়ালছানার মত ঘেঁষে থাকতাম আমরা তিন খুড়তুতো জেঠতুতো ভাইবোন। সব কি আর মনে আছে, স্মৃতিপটে জমেছে বিস্তর ধূলিকণা। এই দিনে নাকি গঙ্গাস্নান করতে গিয়ে সন্তান হারায় কোন এয়োস্ত্রী। আচমকা আসা বান খালি করে যায় কোল। সন্তানহারা জননীর করুণ আর্তিতে আবির্ভূত হন ষষ্ঠীদেবী স্বয়ং। তারপর জানা যায়, আপন পাপেই সন্তান হারিয়েছে নারী। বাছার দুধের বাটিতে ঠোঁট ডোবানো বিড়ালছানাকে চ্যালাকাঠ পিটিয়ে হত্যা করারই মাসুল গুণছে রমণী। পরিত্রাণের উপায় আছে বটে, তবে তা ভয়ানক। ঘাটেই পড়ে থাকা আধপচা, পোকা কিলবিল করা মরা বেড়ালছানার দেহে মিষ্টি দই ঢেলে চাটতে হবে তাঁকে। ঠিক যেমন সোহাগ করে চেটে দিত ছানাটার মা বেড়াল। পুত্রশোকে মূহ্যমান নারী অক্ষরে অক্ষরে পালন করেন মা ষষ্ঠীর নিদান। পরিণতি, আবার আসে বান, মায়ের আঁচল ধরে ভেসে ওঠে ডুবে যাওয়া শিশু। 


আশ্বিনে দুর্গা ষষ্ঠী। মাঘে আসে শীতল বা শেতল ষষ্ঠী। সরস্বতী পুজোর ঠিক পরের দিন। এই একটিই ষষ্ঠী যেদিন ভাত খায় মায়েরা। গরম ভাত নয় অবশ্য, আগের রাতে করে রাখা, জল ঢালা ভাত, অথবা সকালে করেও জলে ভিজানো ভাত। সাথে আর যাই থাকুক না কেন গোটাসিদ্ধ আর মিষ্টি দই থাকবেই। 


পরপর দুটো ষষ্ঠী আসে চৈত্রে। বাসন্তী পুজোর ষষ্ঠী বা অশোক ষষ্ঠী। আগে থেকে তুলে রাখা, শুকনো ছখানি অশোকফুল, কাঁঠালি কলার খণ্ডিতাংশে চটকিয়ে কপ্ করে গিলে খেতে হয় সকালে। জল দিয়ে গিললে হবে না, আবার না গিলতে পেরে ওয়াক তুললেও হবে না।  সদ্য সদ্য মা হবার পর, প্রথম অশোক ষষ্ঠী পড়েছিল যখন, তখন আমি বিডিওর ঘরণী। খড়্গপুরের উপান্তে এক ছোট্ট গাঁয়ে মোদের ঘরসংসার। সারা গাঁ ঘুরে কোথাও জুটল না অশোকফুল। কি করি? পিসি নিদেন দিল, ছটা কাঁচা মুগকড়াই কলায় চটকে গিলে খেতে। তারপর থেকে অবশ্য কখনও সমস্যা হয়নি। আমাদের আবাসনেই আছে ঝাঁকড়া অশোকগাছ। ইস্কুল ফেরৎ রিক্সামামাকে দিয়ে পাড়িয়ে আনে তুত্তুরী।  


চৈত্র মাসে দ্বিতীয় তথা বছরের শেষ ষষ্ঠী আজ। শ্বশুরমশাই প্রত্যেকবার মাথা চুলকান, “তিথি গত ভাবে আজ তো ষষ্ঠী নয়। চৈত্রসংক্রান্তির আগের দিন নীল তথা শিবের উপাসনা হয় বটে, তাকে খামোখা তোমরা ষষ্ঠী বানাও কেন?” এ প্রশ্নের সদুত্তর কি ছাই আমার কাছে আছে? আমাদের মধ্যহাওড়ায় নীলের সাথে সাথে ষষ্ঠীরও উপাসনা যে হয় আজকের দিনে। পঞ্চানন তলার লালবর্ণ বুড়ো পঞ্চাননের পাশে ছেলে কোলে বসে থাকেন তন্বী ষষ্ঠীদেবী। 


আগে নিয়ম অনেক কঠোর ছিল, মধ্যাহ্ন অবধি জলগ্রহণ পর্যন্ত করতেন না জেনানাকুল। বেলা বারোটা বাজলে তবে শিবের মাথায় কাঁচাদুধ মেশানো গঙ্গাজল ঢেলে, ধুঁতরো ফুল, আকন্দ ফুলের মালা, সিদ্ধি পাতা, পাঁচরকম ফল আর পৈতে দিয়ে বুড়ো শিবের উপাসনা করে, চরণামৃত সহযোগে উপবাস ভঙ্গ করতেন তাঁরা। উপাচার একই আছে, তবে বেলা বারোটা অবধি অপেক্ষা করার নিয়ম বর্তমানে অনেক শিথিল। 


বরাবর নীলের দোসর আমার পিসি। পুজোর যাবতীয়  যোগাড় করে রাখে পিসি। আমার করণীয় বলতে শুধু ধরাচূড়া পড়ে নীলের সকালে পিসির হাত ধরে পিতলের কমণ্ডুল ভর্তি দুধ গঙ্গাজল আর সাদা রুমাল ঢাকা ফুলফলের টুকরি নিয়ে বুড়ো শিবের দুয়ারে হাজির হওয়া। এবারে অবশ্য হাওড়া যাওয়া বা মন্দিরে গিয়ে পুজো দেওয়ার বিলাসিতা আর হয়ে ওঠেনি। ঘরেই নমঃ নমঃ করে পুজো সারা। ধুতরো ফল, সিদ্ধি পাতা বা আকন্দ ফুলের মালা আনতে বলে আর বিব্রত করিনি নিজের বরকে। 


 পুজো শেষে বানাতে বসেছিলাম বেলের শরবৎ , নীল আর বেলের শরবৎ বা পানা কেমন যেন একে অপরের সম্পূরক।  বাড়ির গাছের বেল সন্তর্পনে ফাটিয়ে হাতে করে জলে গুলে, পরিষ্কার সাদা কাপড়ে ছেঁকে, পরিমাণ মত মিষ্টি, সামান্য নুন আর কয়েকফোঁটা লেবুর রস মিশিয়ে যে অমৃত তৈরী করত ঠাকুমা, অবিকল তেমন না হলেও কাছাকাছি তো এসেইছে ব্যাপারটা। সমস্যা একটাই, ব্যাপারখানা বেলের পানা না হয়ে, কেমনি যেন বেলের স্মুদি হয়ে গেছে। তা হোক, প্রতি চুমুকে না হয়, আরেকটু ঘন হয়ে আসুক হারিয়ে ফেলা শৈশব, আর হারিয়ে যাওয়া মানুষগুলো।

No comments:

Post a Comment