Tuesday, 20 April 2021

বই পড়ি-

বই পড়ি- ২০শে এপ্রিল, ২০২১


‘২২শে ফেব্রুয়ারি, সন ১৯৪১। কাবুল শহরে তখন বিকেল। আচমকা কাবুলের ইতালীয় দূতাবাসের পিছনের দরজায় কড়া নাড়ল এক স্থানীয় ব্যক্তি। পরিষ্কার করে দাড়িগোঁফ কামানো, ছোট্টখাট্ট চেহারার  আপাতঃ সাধারণ লোকটার মাথায় কারাকুলি আফগান টুপি, পরণে হাঁটু পর্যন্ত লম্বা কুর্তা আর ঢোলা পাজামা। ধূমপানের জন্য পিছনের দরজায় ভিড় জমানো দূতাবাসের আফগান কর্মচারীদের একবারও সন্দেহ হল না, লোকটি স্থানীয় বাসিন্দা নয়। 


সমস্ত রকম যুদ্ধ বিগ্রহ থেকে বহুদূর,আফগানিস্তান তখন নিরপেক্ষ দেশ।  ১৭ মাস আগে শুরু হওয়া মহাশক্তি সংগ্রাম তখনও পরিণত হয়নি মহাযুদ্ধে। ইউরোপে নাৎসীরা ক্রমেই দুর্দম হয়ে উঠছে, একলা বৃটেন কেবল চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে তার সাথে টক্কর দেবার। আপোসে পোল্যাণ্ডকে ভাগাভাগি করে, হিটলার এবং স্ট্যালিন তখনও পরষ্পরের পরম মিত্র। আমেরিকার সাথেও জাপানের সম্পর্ক সৌহার্দ্যপূর্ণ। ‘ আমাদের ছেলেরা কোন তৃতীয় দেশের যুদ্ধে লড়তে যাবে না’ এই মর্মে আমেরিকার মাতা- পিতাদের প্রতিশ্রুতি দিয়ে সদ্য সদ্য তৃতীয়বারের জন্য আমেরিকার রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হয়েছেন ফ্রাঙ্কলিন রুজভেল্ট।

 


লোকটির ইতালীয় রাষ্ট্রদূতের সাথে সাক্ষাৎ করা ভীষণ দরকার। কিন্তু এইভাবে এসে দেখা করতে চাইলেই তো আর দেখা হয় না। লোকটি রক্ষীদের জানাল, সে পেশায় পাচক, তাকে হুজুরের সাথে দেখা করতে বলা হয়েছে। 


রক্ষীর পিছুপিছু উঁচু শিলিংওয়ালা যে ঘরটিতে লোকটা প্রবেশ করল, তার দেওয়ালে টাঙানো ইতালীয় পতাকা আর বড় করে বাঁধানো ইতালীয় স্বৈরাচারী শাসক বেনিতো মুসোলিনির ছবি। মস্ত বড় ডেস্কের উল্টোদিকে বসে থাকা ইতালীয় রাষ্ট্রদূত মোটেই খুশি হলেন না লোকটাকে দেখে। কাবুলের বসবাসকারী অন্যান্য কূটনৈতিকদের মতই তিনিও অনাহূত স্থানীয় আগন্তকদের বেশ ভয় পেতেন। ব্যাটারা হয় সরকারী চর,নয়তো অন্যদেশের গুপ্তচর হয়। এই লোকটাও গুপ্তচর কি না তিনি ঠিক বুঝতে পারলেন না।  এমনকি লোকটি যখন জানাল যে ‘কাবুল সিমেন্সের হের থমাস আপনার কাছে পাঠিয়েছেন। ’ তখনও বিশেষ স্বস্তি বোধ করতে পারলেন না তিনি। 


“কেন পাঠিয়েছে’ খেঁকিয়ে উঠলেন তিনি। লোকটি অত্যন্ত ঋজু ভাবে বলল, ‘তা জানি না।  আমাকে বলা হয়েছে, এসে আপনার সাথে দেখা করতে। ’ লোকটির গলার স্বরে এমন কিছু ছিল, যাতে ইতালীর রাষ্ট্রদূতের বুঝতে বাকি রইল না, এ কোন সাধারণ আফগান হয়। কি মনে করে উনি ফোন করলেন থমাস সাহেবকে।  দুজনের মধ্যে জার্মান ভাষায় বেশ খানিকক্ষণ ফিসফিসিয়ে কথা হল। যার বিন্দুবিসর্গও বুঝলে না আগন্তুক। তবে এটুকু খেয়াল করল যে, বেশী কথা থমাস সাহেব ওপাশ থেকে বলে গেল, আর রাষ্ট্রদূত চুপচাপ শুনে গেল।  


ফোন নামিয়ে, ব্যক্তিগত আর্দালি এবং অন্যান্য কর্মচারীদের বাইরে যেতে ইশারা করলেন রাষ্ট্রদূত। ঘরের দরজা বন্ধ হতেই তিনি ইশারায় আগন্তুককে আসন গ্রহণ করতে বললেন, তারপর ভাঙা ইংরাজিতে বললেন, ‘আমি পিয়েত্রো কুয়ারোনি। আমি কাবুলে ইতালীয় রাষ্ট্রদূত। ’  


আগন্তুক তার পরিচয় দিল। নাম রহমত খাঁ। আফগান নয়, বরং জন্মসূত্রে ভারতীয়।  নামটা সঠিক না হলেও বাকি তথ্যে কোন ভ্রান্তি ছিল না। আগন্তুক জানাল পেশোয়ার থেকে কাবুল এই দীর্ঘ ২০০ মাইল দুর্গম পথ সে পদব্রজে পার হয়ে এসেছে দুর্ধর্ষ তথা দুর্দম উপজাতি অধ্যুষিত এলাকার মধ্যে দিয়ে যারা বৃটিশ ভারত এবং আফগানিস্তানের মধ্যে রচনা করে সীমানা। 


গত ২৭শে জানুয়ারী সে কাবুলে এসে পৌঁচেছে। তবে একা আসেনি, সঙ্গে করে নিয়ে এসেছে ভারতীয় বিপ্লবী সুভাষ চন্দ্র বোসকেও। সুভাষের পথপ্রদর্শক  তথা দেহরক্ষী হিসেবেই খাঁয়ের কাবুলে আগমন। খাঁ আরো জানাল যে আপাততঃ কাবুলেই আত্মগোপন  করে আছে সুভাষ, কাবুল থেকে সীমান্ত টপকে রাশিয়া হয়ে বার্লিন যেতে চান সুভাষ, ভারতকে পরাধীনতার শিকল থেকে মুক্ত করার জন্য জার্মান সহায়তা চাইতে।  


কাবুলে এসেই তাঁরা জার্মান দূতাবাসের সাথে যোগাযোগ করেন, বেশ কয়েকবার মিটিং হয়, কিন্তু ফলপ্রসূ হয় না কিছুই।  এদিকে সম্পূর্ণ বেআইনি ভাবে কাবুলে এসেছেন সুভাষ আর রহমত খাঁ।  না আছে তাদের পাশপোর্ট বা অন্যান্য দরকারী কাগজপত্র, কোনমতে এক আফগান পুলিশ আপিসারকে ঘুষ দিয়ে গ্রেপ্তার এড়িয়ে আত্মগোপন করে আছেন তাঁরা।  যত দিন কাটছে, ততোই বাড়ছে তাদের বিপদ। এই ভাবে বেশীদিন গ্রেপ্তারী এড়ানো অসম্ভব।  আর আফগান পুলিশ একবার ধরতে পারলেই, সোজা তুলে দেবে বৃটিশ সরকারের হাতে। এমতবস্থায় কুয়ারনিই তাদের একমাত্র ভরসা।  


জার্মানদের মত ঝুলিয়ে রাখল না কুয়ারনি। পরবর্তী তিনটি সপ্তাহ আর কয়েকটি মিটিং এর পরই ইতালীয় কূটনৈতিক পাশপোর্ট সমেত সুভাষকে নিরাপদে পার করিয়ে দেওয়া হল আফগান সীমান্ত। তুলে দেওয়া হল মস্কোগামী ট্রেনে। তারপর বোসের কি হল, অথবা হল না আমরা সবাই জানি অথবা জানি না। কিন্তু যে সঙ্গীকে তিনি ছেড়ে গেলেন কাবুলে তাঁর গপ্পও বোসের থেকে কিছু কম চিত্তাকর্ষক নয়। ”

তবে সে গল্প আবার কাল, অথবা পরশু বা কখনই নয়। কে জানে- 


পুনশ্চঃ সবটুকুই মিহির বোসের দা ইন্ডিয়ান স্পাই থেকে।  পাতা- ১৩-১৫।


বই পড়ি- ২৩শে এপ্রিল, ২০২১


“সুভাষ বোস ইউরোপ রওণা দেবার অল্পদিনের মধ্যেই,  রহমত খাঁয়ের পদোন্নতি  ঘটল, নিছক দেহরক্ষী থেকে গুপ্তচর। কাবুলের ইতালীয় রাষ্ট্রদূত পিয়েত্র কুয়ারোনি বহুদিন থেকেই এমনি এক অস্ত্রের সন্ধানে ছিলেন, যার মাধ্যমে  ভারতে বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদী শক্তির ওপর সরাসরি আঘাত হানা যায়। কুয়ারোনির বদ্ধমূল ধারণা ছিল, বৃটিশ সাম্রাজ্য নামক শিকলের সবথেকে দুর্বল, সবথেকে নড়বড়ে আংটা হল ভারত।  এখানে ঠিকঠাক আঘাত করলে শিকল ছিঁড়তে বাধ্য।  


যাবার সময়, বোস যখন ইতালীয়দের সাথে সহযোগীতা করার জন্য খাঁকে তাঁর এজেন্ট নিয়োগ করে গেলেন, কুয়ারোনি এই সুযোগ ছাড়লেন না। কয়েক মাসের মধ্যেই আরেক অক্ষশক্তি জার্মানিও খাঁকে তাদের চর হিসেবে নিযুক্ত করল। ইতালী এবং জার্মানি দুই ফ্যাসিস্ট দেশের হয়ে কাজ করলে বা পারিশ্রমিক নিলেও খাঁ কিন্তু আদতে ছিল গোঁড়া কম্যুনিস্ট। ফলে প্রথম থেকেই খাঁ দুই দেশকে ভুলভাল তথ্য সরবরাহ করে আসত। 


এই ভুল তথ্য পরিবেশন প্রথমদিকে স্বতঃপ্রণোদিত হলেও, ‘অপারেশন বার্বারোসা’র পর অর্থাৎ হিটলারের রাশিয়া আক্রমণের পর, খাঁ হাত মেলায় রাশিয়ার সাথে এবং রাশিয়ানদের সরবরাহ করা তথ্য নাৎসি বাহিনীর কাছে পৌঁছে তাদের ভুল পথে পরিচালনা করতে থাকে।  


দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষের দিকে  খাঁ ইংরেজদের হয়েও কাজ করতে থাকে। বৃটিশরাই তাঁর নাম দেয়, ‘সিলভার’। যাঁকে ব্যঙ্গ করে রহমত খাঁর নাম রাখা হয়েছিল সিলভার, সেই আসল মিঃ সিলভার ছিলেন এক ওপরতলার বৃটিশ অফিসার, যিনি ইংলণ্ডে বসে সমগ্র ভারতে যাবতীয় আণ্ডার কভার অপারেশনের তদারকি করতেন। 


জার্মানরা কোনদিন ঘুণাক্ষরেও বুঝতে পারেনি যে সিলভার তাদের ইচ্ছাকৃত ভাবে ভুল তথ্য পরিবেশন করছে। তারা সিলভারকে এতটাই বিশ্বাস করত এবং তার কাজে এতটাই সন্তুষ্ট ছিল, যে সিলভারকে তৎকালীন জার্মানির সবথেকে বড় মিলিটারি পুরষ্কার, ‘ দা আয়রণ ক্রস’ প্রদান করা হয়। জার্মানরা সিলভারকে একটি ট্রান্সমিটারও দিয়েছিল,যার মাধ্যমে সিলভার সরাসরি বার্লিনে হিটলারের স্পেশাল সিক্রেট সার্ভিস, Abwehr এর সদর দপ্তরের সাথে কথা বলতে পারত। জার্মানরা এক মুহূর্তের জন্য সন্দেহ করেনি যে সিলভারের প্রদত্ত যাবতীয় মিলিটারি তথ্য আসলে বৃটিশ সিক্রেট সার্ভিসের বানানো গপ্প। যা ফাঁদা হত খোদ দিল্লীতে ভাইসরয়ের প্রাসাদে বসে। 


যুদ্ধ শেষের আগে সিলভার কিছুদিন জাপানের হয়েও গুপ্তচরবৃত্তি করেন। একসাথে পাঁচ পাঁচটা দেশের হয়ে গুপ্তচরবৃত্তির এহেন নজির দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ইতিহাসে আর খুঁজে পাওয়া যায় না।” 

- Pg-16, The Indian Spy, The True Story of the Most Remarkable Secret Agent of World War II by Mihir Bose.


  বই পড়ি- ৩, ২৫শে এপ্রিল, ২০২১


"১৫ কোটি পাউণ্ড, ১১লক্ষ লোকলস্কর সহ প্রথম বিশ্বযুদ্ধে সর্বাত্মকভাবে বৃটেনের পাশে দাঁড়িয়েছিল ভারত। যার মধ্যে ১লক্ষ ৩৮ হাজার সেপাই লড়েছিল শুধু ইউরোপেরই নানা রণাঙ্গনে। মূলতঃ ভারতীয়দের জন্যই বৃটিশ সাম্রাজ্য প্রসারিত হয়েছিল রাশিয়ার দক্ষিণে ট্রান্স ক্যাস্পিয়ান আর ককেশিয়া এবং পারস্য ছাড়িয়ে সুদূর মেসোপটেমিয়া। ভারতীয়দের জন্যই ইরাক দখল করে বৃটেন, পরিস্থিতি এমন দাঁড়ায় যে বেশ কিছুদিনের জন্য ভারতীয় টাকাই ছিল ইরাকের জাতীয় মুদ্রা।  এমনকি যে সৈন্যসামন্ত নিয়ে প্যালেস্টাইনের যুদ্ধে অ্যালেনবি তুরস্ককে পরাস্ত করেছিল তার পদাতিক বাহিনীর দুই তৃতীয়াংশ আর অশ্বারোহী সেনাদলের এক তৃতীয়াংশই ছিল ভারতীয়। যুদ্ধে বৃটেনের পাশে দাঁড়াতে ভারতীয়দের অনুপ্ররণা দেবার জন্য গান্ধীজী কাইজার- এ-হিন্দ এর শিরোপাও পান।  


 অগণিত লস্কর, নাবিক, জাহাজী ছাড়াও ষাট হাজারের বেশী ভারতীয় সৈন্য নিহত হয় এই যুদ্ধে। যুদ্ধ শেষে যে ইনফ্লুয়েঞ্জা অতিমারিতে(* স্প্যানিশ ফ্লু) আক্রান্ত হয় বিশ্ব, ভারতে তা তেমন ভাবে দেখা না গেলেও প্রায় বিনা চিকিৎসায় মারা যান ১কোটি ৭০ লক্ষ মানুষ, যা ছিল তৎকালীন মোট জনসংখ্যা ৫শতাংশ। এত চড়া হারে মৃত্যুর একটাই কারণ ছিল, দেশের অধিকাংশ ডাক্তার আর নার্সকে খেয়ে বসেছিল প্রথম বিশ্বযুদ্ধ। 


এতকিছুর পর, নূন্যতম ধন্যবাদের বদলে ভারতের কপালে জুটল বেত্রাঘাত। গান্ধীজী সমেত গোটা ভারতবর্ষই ভেবে বসেছিল, মহাযুদ্ধে এমন সর্বাত্মক সহায়তার পর, নিশ্চয় হোমরুলের দাবী মেনে নেবে বৃটেন। অন্যান্য সাদা উপনিবেশ গুলি যথা অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যাণ্ড, কানাডা বা সাউথ আফ্রিকা যেমন বহু আগে থেকে ভোগ করে আসছে স্বায়ত্তশাসন। এমনকি দীর্ঘ সশস্ত্র বিপ্লবের মধ্যে দিয়ে আয়ার্ল্যাণ্ডও স্বাধীনতা পেল, শিকে ছিঁড়ল না কেবল ভারতের ভাগ্যে।  


বদলে ভারতবাসী দেখল, আরো কঠোর, আরো নির্মম হয়ে উঠেছে বৃটিশ শাসন। যুদ্ধ শেষ হতে না হতেই, ডিফেন্স অব ইণ্ডিয়া অ্যাক্টের প্রতিক্রিয়াশীল ধারাগুলি আরো কঠোর ভাবে বলবৎ করল বৃটিশ সরকার। হৃত হল সংবাদপত্রের স্বাধীনতা, মিটিং মিছিলের ওপর চেপে বসল নিষেধাজ্ঞা, চালু হল পরোয়ানা ছাড়াই গ্রেপ্তার, বিনা বিচারে একবছর অবধি হাজতবাস। যার মেয়াদ বাড়ানো একেবারেই কতৃপক্ষের ইচ্ছাধীন। এমনকি কারো কাছে দেশদ্রোহ মূলক কোন ইস্তেহার পাওয়া গেলে গ্রেপ্তার হবার পর স্বপক্ষে উকিল নিয়োগ করারও অধিকার কেড়ে নিল বৃটিশ সরকার।  লোকে বলত, ‘না দলিল, না ভকিল, না আপিল।’ বৃটিশদের প্রতি আনুগত্য ঝেড়ে ফেলে রাতারাতি বিদ্রোহী হয়ে উঠলেন গান্ধীজী।  ডাক দিলেন দেশ জোড়া গণ আন্দোলনের।  


আর এই গণবিক্ষোভকে কেন্দ্র করেই ১৩ই এপ্রিল ১৯১৯, সিলভারের গ্রাম গল্লা ঢেড় থেকে মাত্র ২৫০ মাইল দূরে অমৃতসর শহরে ঘটে গেল এক পাশবিক হত্যাকাণ্ড। বৃটিশদের প্রায় দুশো বছরের ঔপনিবেশিক শাসনে এত নৃশংস, এত ন্যক্কারজনক ঘটনা কখনও প্রত্যক্ষ করেনি এই উপমহাদেশবাসী।


নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও গণবিক্ষোভ চলছিলই, এমতবস্থায় পরিস্থিতি আয়ত্তে আনতে অমৃতসর শহরের আইনশৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্ব  তুলে দেওয়া হল আর্মির হাতে। জ্যুলাণ্ডার ব্রিগেডের কম্যাণ্ডার, ব্রিগেডিয়ার  জেনারেল রেজিন্যিল্ড ডায়ার অমৃৎসর শহরের দায়িত্ব নেবার সাথে সাথেই জারি করলেন মার্শাল ল। এমন সময়ে তাঁর কাছে খবর এল, তাঁর নির্দেশ অগ্রাহ্য করে জালিয়ানওয়ালা বাগে সমবেত হয়েছে এক বিশাল জনতা। জালিয়ানওয়ালা বাগ ছিল এক অতিকায় মুক্তাঙ্গন, কিন্তু প্রবেশ বা প্রস্থানের পথ কেবল একটি।  তাও অত্যন্ত সরু এক গলি বরাবর। খবর পাওয়া মাত্রই ডায়ার লোকলস্কর নিয়ে হাজির হলেন এই সরু রাস্তার মুখে। 


প্রায় হাজার বিশেক নিরস্ত্র শান্তিপূর্ণ জনতা জমায়েত হয়ে শুনছিল নেতাদের বক্তব্য। দিনটি ছিল বৈশাখী, সমগ্র উত্তরভারত জুড়েই ঐ দিনটি উৎসব হিসেবে পালিত হয়, তাই জমা হওয়া জনতার মধ্যে কতজন ঠিক রাজনৈতিক কারণে জমা হয়েছিল বলা দুষ্কর। ছিলেন শিশু সন্তান কোলে অগণিত মহিলা। সবথেকে বড় কথা, প্রত্যেকেই ছিল নিরস্ত্র। তাতে অবশ্য জেনারেল ডায়ারের কিছু যায় আসেনি।  


ডায়ার যখন দেখলেন এত সরু রাস্তায় তার সাজোয়া গাড়ি ঢুকবে না, তখন তিনি গাড়িগুলি রাস্তার মুখে দাঁড় করিয়ে, গুর্খা সেপাইদের নির্দেশ দিলেন রাস্তা আটকে, গুলি চালাতে।  কোন সচেতনবাণী ছাড়াই।


এম্যুনিশন শেষ না হওয়া পর্যন্ত থামেনি গুলিবর্ষণ। শুধু সরকারী হিসেবেই মারা গিয়েছিলেন ৩৩৭ জন পুরুষ, ৪১ জন মহিলা এবং একটি ৭ সপ্তাহের দুধের শিশু। আহত ১৫০০।  কংগ্রেসের মতে মৃতের সংখ্যা  ছিল হাজারের অনেক বেশী।


ডায়ারের কৃতকর্মের তালিকা বেশ লম্বা। নানা অজুহাতে এদেশীয়দের চাবুকপেটা করা ছাড়াও তিনি কুখ্যাত ছিলেন, ‘ক্রলিং অর্ডার’ এর জন্য। জনৈকা শ্বেতাঙ্গ রমণী আক্রান্ত হয়েছিলেন একদল এদেশীয়দের দ্বারা, যেখানে এই ঘটনাটি ঘটেছিল, ডায়ার নির্দেশ দেন, সেই পথে যাতায়াত করতে হলে ভারতীয় পুরুষদের যেতে হবে বুকে হেঁটে। অন্যথা হলেই জুটবে বেধড়ক মার এমনকি বেয়নেটের খোঁচাও। বৃটিশ লাইব্রেরিতে রাখা একটি ছবিতে দেখা যায়, এইভাবে সরীসৃপের মত বুকে হেঁটে চলা ভারতীয়দের বেয়নেটের খোঁচা মারছে ২৫ তম রেজিমেন্টের গোরা সেপাইরা। জনৈক প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণ থেকে জানা যায়, ‘রাস্তাটা অনেকটাই লম্বা, এইভাবে উপুড় হয়ে শুয়ে, হাত আর কাঁধে ভর দিয়ে বুক ঘষটে সরীসৃপের মত চলতে থাকা বেশ দুরূহ এবং ভীষণ কষ্টকর। কারো পাছা মাটি থেকে সামান্য উঁচুতে উঠলেই লাথি মারছিল টহলদার গোরা সেপাইরা। ’ 


এতকিছুর পরেও ভারতবাসীর কাছে যেটা সবথেকে বেদনাদায়ক ছিল তা হল, যদিও ডায়ারকে আর্মি ছাড়তে হয়, কিন্তু তাছাড়া তার বিরুদ্ধে কোন শাস্তিমূূলক ব্যবস্থা নেওয়া হল না। তাকে সসম্মানে অবসর গ্রহণের সুযোগ দেওয়া হল, এমনকি অবসর নেবার পর তার পেনশন ইত্যাদিও চালু করা হল। 


যেটুকু সামান্য শাস্তি দেওয়া হয়েছিল তার জন্যও বৃটিশ পার্লামেন্টে ঝড় ওঠে। জালিয়ানওয়ালা বাগ নিয়ে আলেচনার প্রস্তাব বিপুল ভোটে খারিজ হয়ে যায় হাউস অব কমনস্ এমনকি হাউস অব লর্ডসেও। এই নিয়ে আলোচনার প্রস্তাব দেবার জন্য তীব্র সমালোচনার মুখে পড়ে সেদেশের সরকার। আসলে এদেশে বা ইংলণ্ডে বসবাসকারী গোরাদের চোখে ডায়ার ছিল নায়ক। তিনি যা করেছিলেন তা বৃটিশ রাজের মঙ্গলের জন্যই করেছিলেন এই মতবাদ আজও  খোলাখুলি ভাবে অনেক বৃটিশ লেখক পোষণ করে থাকেন। 


ডায়ারের মৃত্যুর পর রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় তাঁর শেষকৃত্য সম্পন্ন হয়। তাঁর জন্য একটি বিশেষ তহবিল খোলা হয় যাতে বহু গণ্যমান্য ব্যক্তি অর্থপ্রদান করেন। যাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন লেখক রুডিয়ার্ড কিপলিং। কারণ শতিনেক নিরস্ত্র ভারতীয়কে হত্যা করার পিছনে তাঁরা কোন অনৈতিকতা, কোন অন্যায় খুঁজে পাননি। “ 


 Pg- 35-37, The Indian Spy, The True Story of the Most Remarkable Secret Agent of World War-II by Mihir Bose.

No comments:

Post a Comment