অনির ডাইরি ২৭শে এপ্রিল, ২০২১
একসাথে দল বেঁধে সাঁতার কাটত হাঁসগুলো। নালার দৈর্ঘ্য বরাবর গাঁয়ের এমুড়ো থেকে ও মুড়ো অবধি সাঁতরে যেত আবার ফিরে আসত। 'ঠিক সন্ধ্যে নামার মুখে, তোমার নাম ধরে কেউ ডাকে', দাওয়া থেকে হাঁক পাড়ত দিদা, ‘ আয়- আয়- আয়- চৈ-চৈ-চৈ’। কি ভাবে বুঝত কে জানে, হাঁক শুনলেই, ঠিক দিদার হাঁসগুলো দলচ্যুত হয়ে উঠে আসত পাড়ে। তারপর পশ্চাদ্দেশ বেমক্কা উঁচু করে, উন্নাসিক সুন্দরীদের মত গিয়ে সেঁদিয়ে যেত আপন বাসায়। শেষ হাঁসটা ঢুকে পড়লেই ঝাঁপ ফেলে দিত দিদা। ঝাঁপের ওপর লেখা ছিল, ‘হাঁসেদের বোটেকখানা’-সৌজন্য সেজদা। প্রসঙ্গতঃ বোটেকখানা হল আপনাদের বৈঠকখানা।
বছরে একবারই যেতাম দিদার বাড়ি। সারা বছর তীর্থের কাকের মত পথের দিকে তাকিয়ে বসে থাকত দিদা। অপেক্ষা করত শেষ বাসের জন্য। যদি কেউ নামে। শেষ বাস চলে গেলে অপেক্ষা করত পোস্টম্যানের জন্য। যদি আসে কারো চিঠি- দাদপুরের স্বর্গীয় শিক্ষক মনোরঞ্জন দাশের কন্যা স্বর্গীয়া সুনীতি রাণী ঘোষের মনের জোর ছিল সাংঘাতিক।
বড় দূরে থাকত দিদা। সেই উত্তরবঙ্গের সীমান্ত ঘেঁষা অজগ্রাম রামনগর। যাবার হ্যাপা কি কম? বেশ কদিনের ছুটি ছাড়া যাওয়া যায় নাকি? কাশ আর শিউলি ফুটলে তবে না যাব দিদার বাড়ি। কাক না ডাকা ভোরে ঘুম থেকে তুলে রেডি করে দিত মা। বোঁচকাবুঁচকি নিয়ে আমরা যখন বেরোতাম তখন রাতপাহারা শেষে ঘুমের তোরজোর করত পাড়ার নেড়িরা।
সৎসঙ্গের সামনে থেকে মিনিট তিনেক হেঁটে গলির মোড়। মোড়ের মাথায় তখনও ঝাঁপ বন্ধ সারি সারি দোকান। বরাবরের দিলখোলা বেহিসেবী বাবা, আর কিঞ্চিৎ বুঝে চলা ঘোর সংসারী মায়ের ছুটকো দাম্পত্য কলহের ফাঁকে চাতক পাখির মত চেয়ে থাকা, হে ভগবান, হে মা দুগ্গা, হে শিবঠাকুর একটা ফাঁকা ট্যাক্সি পাঠিয়ে দাও-
ট্যাক্সির ফালতু খরচ ভাঁজ ফেলত মায়ের প্লাক না করা ভ্রু যুগলে। বাবার মুখের দরাজ হাসি দেখে বেশ বুঝতে পারতাম, ‘আজি প্রাতে সূর্য ওঠা, সফল হল কার ’। নিজের শহরকে ছেড়ে যাবার যাবতীয় বিষাদকে জানলা দিয়ে উড়িয়ে হলদে ট্যাক্সি দৌড়ত হাওড়া ব্রীজের পেট চিরে। মহাত্মা গান্ধী রোড তখন প্রথম আলোয় সদ্যস্নাত। কলেজ স্ট্রিটের মুখে ডাঁই করে রাখা সবুজ ডাবের পাহাড়, মেহবুব ব্যাণ্ডের বন্ধ দোকান ছাড়িয়ে শিয়ালদা। সকাল আটটার লালগোলা প্যাসেঞ্জার। কুলিকে টাকা দিয়ে চলন্ত ট্রেনে সিট রাখত বাবা। জানলার ধারের সিট। রাণাঘাট অবধি ডিজেল ইঞ্জিন, রাণাঘাট থেকে কয়লা। নাকি উল্টোটা? আজ আর মনে আছে থোড়াই। শুধু এটুকু মনে আছে কয়লার ইঞ্জিন হলে হাওয়ার দিকে বসলে চোখে এসে পড়ত কুটো।
প্রথম দিকে রান্না করে নিয়ে যেত মা। অ্যালুমিনিয়ামের টিফিন কৌটো ভরে লুচি তরকারী আর সুজি। কেউ ছুঁতাম না আমরা। ট্রেনে উঠে ঘরের খাবার খাব ক্যান। নৈহাটির ঝালমুড়ি দিয়ে শুরু হত মুখচলা। ঠোঙা ভর্তি কুন্দ ফুলের মত মুড়ি, মাখামাখি ঝাঁঝালো সর্ষের তেল, পেঁয়াজ কুচি, মুড়ি মশলা আর লাল বাদামে। সবার ওপর কাস্তের মত একখানি নারকেলের টুকরো। ঝাঁঝালো তেলের স্বাদে গন্ধে নাকের জলে মিশত চোখের জল। উঠত কাঁচের বাক্স ভর্তি মিষ্টি। শালপাতার দোনায় কি ছানার রসালো মিষ্টির সোয়াদ বেড়ে যায়? উঠত মিষ্টি ডালমুট। সুতো দিয়ে কাটা গরম সিদ্ধ ডিম। রাণাঘাটে ইঞ্জিন বদলাত, অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকত গাড়ি। প্লাটফর্মে বিক্রি হওয়া কচুরি, ঝোল ঝোল কুচো আলুর তরকারী আর ছানার জিলিপি কিনে আনত সেজোমাসি।
খেতে খেতে কখন যে এসে পড়ত দেবগ্রাম ইস্টিশন। আর দুটো ইস্টিশন পরেই নামতে হবে আমাদের। মাঝে পড়বে পাগলাচণ্ডী নদী। নাকি নদ? ভিখারির মত হাত পেতে বসে থাকতাম যদি একটা পাঁচ বা দশ পয়সা দেয় বাবা। নিদেনপক্ষে যদি ২ পয়সাই দেয়, ছুঁড়ে ফেলব নীচে নদীর বুকে। ছোট মেসো একবার পঁচিশ পয়সা দিয়েছিল, কি বকেছিল মা সেবার। আর একবার মাকে লুকিয়ে পাক্কা একটি টাকা গছিয়েছিল ছোট মেসো, সেদিনের ফূর্তির কথা ভেবে আজও লিখতে লিখতে হাসির ঢেউ খেলে যাচ্ছে আধবুড়ো ওষ্ঠাধরে। যাই বলুন শৈশব বড় দামাল, বড় বাচাল, বড় বেশী বেহিসেবী। তাই বুঝি শৈশব এমন মূল্যবান। হারিয়েও হারায় না।
শৈশব যে সত্যিই হারায় না, বারবার ফিরে ফিরে আসে, তা আমার বৃদ্ধ বাবা-মা-পিসি-শ্বশুর আর শাশুড়িমাতাকে নিয়ে হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি। বাপস্!পাঁচ-পাঁচটা ধেড়ে খোকাখুকুকে সামলাতে রীতিমত নাকের জলে চোখের জলে তুত্তুরীর বাবা-মা। তাও আমাদের দাবী অতি সামান্য, দয়া করে ভ্যাকসিনটি নিয়ে আমাদের ধন্য করো।
যখনই ভ্যাকসিন নেবার দিন ঠিক হয়, কোথা থেকে যে সমস্যা পেড়ে আনে এরা। ওদিক থেকে বাবা হুঙ্কার ছাড়ে, ‘আমাদের ওপর কিছু চাপিয়ে দেবে না’। তো এদিকে শ্বশুরমশাই বাঁধান জ্বর। তা হ্যাঁ বাবা, যতবার ভ্যাকসিন দিতে নিয়ে যাব বলব, ততোবার জ্বর বাঁধাবেন আপনি। ওঃ থুড়ি, আজকাল আপনি বললে হেব্বি রেগে যাচ্ছে বৃদ্ধ। বারো বছরের অভ্যেস রাতারাতি বদলে আমায় কইতে হবে তুমি। যতই বলি, ওরে বাবা, আমি সাবেকী বাড়ির মেয়ে, ঠাকুমার কাছে মানুষ,স্বভাব চরিত্রে যতই উগ্র নারীবাদী হই না কেন, মানুষটা বেশ সেকেলে। সময় তো দিতে হবে। রাতারাতি কাউকে আপনি থেকে তুমি আর তুমি থেকে তুই বলতে পারি না আমি। উমা তো সেই কবে থেকে ভয় দেখাচ্ছে, 'আমাকে তুই বলবে কি না,বলো।' তাকেই পারি না। এই তুই কই,তো এই তুমি।
শেষ পর্যন্ত অবশ্যি শ্বশুরমশাইকে ছাড়াই বাকিদের ছুঁচ ফুটিয়ে আনলাম আমরা। যথারীতি ভ্যাকসিন নেবার দিন সকাল থেকে জ্বরে শালিকপাখির মত চিচি করছিলেন শ্বশুরমশাই। দীনু খুড়োও বলল, ‘জিতেন দাকে তোরা এবার ছাড়। দেখ না মাস তিনেক পর,পাড়ার দোকানে বিক্রি হবে ভ্যাকসিন। তখন শঙ্কর এসে দিয়ে যাবে খন। ’ দা গ্রেট দীনু খুড়োর নির্দেশ শিরোধার্য। লোকটাকে যে বেজায় ভালোবাসি মাইরি-
চার চারটে নড়বড়ে মানুষকে ভ্যাকসিন ফুটিয়ে গাড়িতে তুলে যার যার কুলায় ফিরিয়ে দিতে দিতে আর দ্বিতীয় ডোজটা নেওয়া হয়নি আমার। গোটা রাস্তা শাশুড়ী মা দুঃখ করতে করতে এলেন, ‘আমাদের সামলাতে গিয়ে তোমারই আর নেওয়া হল না। ’ বোঝাতে পারলাম না, বাবা মা হলে তো এমনিই হয়। তোমরাই তো শিখিয়েছ।
আর যেটা ওণাকে বলতে পারিনি তা হল,আমার পরিবার যে আসলে বিরাট বড়। শুধু কি রক্ত আর বৈবাহিক সম্পর্কে আমি জননী? দপ্তরী সম্পর্কে নই? তাহলে আপিস মাস্টার মানে কি? নিছক প্রভু? কেবল প্রভুত্ব করব? ভালোবাসব না?
প্রায় কান ধরে নিয়ে গিয়েছিলাম গোটা টিমকে ভ্যাকসিন দিতে। চুঁচুড়ার ইমামবাড়া হাসপাতালের এসিটেন্ট সুপারের কাছে আমাদের কৃতজ্ঞতার অন্ত নেই। নাঃ কোন ভিআইপি ট্রিটমেন্ট দেননি উনি আমাদের এযাত্রা। প্রথম ডোজের সময় দিতে পারলেও, এ যাত্রা দিতে অপারগ তা প্রথমেই জানাতে কসুর করেননি। আমরাও চাইনি, সকাল থেকে লাইন দিয়ে দাঁড়ানো অশীতিপর মানুষদের নাকের ডগা দিয়ে গটগট করে ভ্যাকসিন নিতে। তাই কতজন ভ্যাকসিন নেবো জানিয়ে, সুপার সাহেবের বেঁধে দেওয়া সময়ে দলবেঁধে হাজির হয়েছিলাম আমরা। তারপরও হয়তো বেশ খানিকক্ষণ বসতে হয়েছে, দাঁড়াতে হয়েছে। আমাদের সঞ্চিতা আর সায়নী টেনশন করেছে,যদি ভ্যাকসিন ফুরিয়ে যায়। আমাদের ধীমান টেনশন করেছে যদি লোক বেশি বলে ওকে ফিরিয়ে দেয় ওরা। কৌশিক টেনশন করেছে যদি ভ্যাকসিন নেবার পরও করোণা হয়? বাদল, সোমনাথ আর আমি টেনশন করেছি যদি আবার খুব লাগে?
সব টেনশন মিটিয়ে প্রায় সন্ধে ছটা নাগাদ ভ্যাকসিন নেওয়া আমরা। ফিরিঙ্গী ভাষায় আমার ফুল অফিস ভ্যাকসিনেটেড, ফুললি ভ্যাকসিনেটেড। এই ভাবেই চলুক না জীবন, কিছুটা শৈশব আর কিছুটা অভিভাবক হয়ে।
No comments:
Post a Comment