অনির ডাইরি ১লা মে, ২০২১
তখন অনেক রাত। দেওয়াল ঘড়ির বড় আর ছোট কাঁটা এক হয়েও পুনরায় বিচ্ছিন্ন। পাশের ঘরে ফুললতা আঁকা মিটমিটে ল্যাম্পের আলোয় মোৎজার্টের কত নম্বর যেন সুরের মূর্ছনায় মোহিত শৌভিক। আধা ঘুমন্ত তুত্তুরীকে ঠেলে তুলে কানে ফোন চেপে ধরল তুত্তুরীর মা। ‘আঃ এখন কেন? যখন ওরা বিয়ে করেছিল তখন শুভেচ্ছা জানাব। ’ গত বছরেও এসব কথা বলত না মেয়েটা। ইদানিং জ্যাঠাইমার ভাষায় পিপুল পাকছে। সব বিষয়েই সুচিন্তিত মতামত দেয়, না চাইলেও। যার অধিকাংশই বাবার রঙে রঞ্জিত। তা হোক। যত বয়স বাড়বে মায়ের সাথে শত্রুতা ততো বাড়বে আমি জানি। কারণ শাসন করার তিক্ত দায়িত্ব যে শুধু মায়ের। বাবা মানে তো অখণ্ড প্রশ্রয় আর অনাবিল বন্ধুত্ব।
জোর করেই মেয়ের কানে ফোনটা ধরলাম। প্রিয় সম্পর্কের ক্ষেত্রে কখনও পরে বা কাল থাকতে নেই। কে জানে কাল কি হয়। বিরক্ত হয়ে শুভ বিবাহবার্ষিকীর শুভেচ্ছা জানাল তুত্তুরী। মা অবশ্য তাতেই বিগলিত। বাবাও কিছু মনে করল না দেখি, তবুও অর্বাচীন সন্তানের জননী হিসেবে মার্জনা চাইলাম উভয়ের কাছে। বড্ড বদমেজাজী মেয়েটা আমার। অবশ্য ঐ বয়সে আমিও তাই ছিলাম। ভয়ানক অমিশুক এবং উন্নাসিক।
ফোনের ওপার থেকে ভেসে এল বাবার গমগমে গলার ধমক, ‘ নাঃ ও বদমেজাজি নয়। ও ঠিক আমার মতই অভিমানী। তুমি কি জানো আমি ওর বয়সে কি সাংঘাতিক কাণ্ড ঘটিয়েছিলাম?’ এতরাতে বৃদ্ধবৃদ্ধার ঘুম ভাঙিয়ে শুভেচ্ছা জানাচ্ছি জানলে তুলকালাম করবে শৌভিক। এখনও নেভেনি অবশ্য পাশের ঘরের আলো, কি যেন একখান আফ্রিকান গান চালালো শৌভিক। মাঝে মাঝে আমাকেও ডেকে শোনায়। যাই হোক তার মানে শুতে আসতে দেরী আছে আরো কিছুক্ষণ।
বলো না বাবা গল্পটা। বেশী পিড়াপিড়ি করতে হল না, বৃদ্ধ বলবে বলেই উঠে এসে বসল ডাইনিং টেবিলে, ‘দাঁড়াও একটা ধূম খাই। ’ ধূম অর্থাৎ সিগারেট। ধোঁয়া ছেড়ে গল্প শুরু করল বাবা, ‘আমি তখন বছর নয়েক। আমি তখন চতুর্থ শ্রেণী। কি কারণে যেন ভীষণ অভিমান হয়েছিল, সম্ভবতঃ ছোটকাকার কাছে প্যাঁদানি খেয়েছিলাম। তোমাকে তো বলেছি, আড়ালে ছোটকাকাকে আমরা চোরা (মহিষাসুর) বলে ডাকতাম। তেমনি চেহারা ছিল। নিয়মিত মুগুর ভাঁজত। ইয়া বড় বড় ছিল হাতের গুলি। ’ আঃ বাবা, প্রসঙ্গান্তরে যেও না। ‘না। না। তো সুযোগ পেলেই শাসন করত ছোটকাকা। বকা, কানমলা, ঠ্যাঙানি। বাবা-মা কিছুই বলত না। তো সেদিনও তেমন কিছু হয়েছিল বোধহয়। এত অভিমান হল, ভাবলাম গৃহত্যাগ করব। সকাল নটা নাগাদ বেরোলাম স্কুলে যাব বলে। মোড়ের মাথায় গিয়ে দাঁড়িয়ে আছি দেখি একটা ফাঁকা ঘোড়ার গাড়ি। তখনও পঞ্চানন তলা রোড দিয়ে ঘোড়ার গাড়ি চলত।
গাড়ির পিছনে উঠে বসলাম। গাড়োয়ান গুলো করত কি, মাঝে মাঝে পিছন দিকে ছিপটি গুলো ঘোরাত, যাতে কোন দুষ্টু ছেলে যদি উঠে বসে তার গায়ে লাগবে সপাৎ করে। যতবার গাড়ি আস্তে হয় আমি টুক করে নেমে পড়ি, সপাং করে ছিপটি ঘুরিয়ে যেই গাড়ি স্পিড তোলে, আমিও লাফিয়ে উঠি। এইভাবে কতদূর গেলাম জানি না, হঠাৎ গাড়িটা থেমে গেল। গাড়োয়ানটা বোধহয় চা খেতে গেল, আমি নেমে রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে আছি, দেখি একদল লোক এসে বসল গাড়িটায়, গাড়িটাও অমনি তাদের নিয়ে ছেড়ে দিল।
আমি তো বেকুবের মত দাঁড়িয়ে আছি। দেখি সেটা একটা রেল স্টেশন। সামনের সরু সুড়ঙ্গ দিয়ে মানুষ ওঠা নামা করছে, আমি নেমে ওপাশে উঠে দেখি শ্রীরামপুর স্টেশনে আছি। একটা ট্রেন দাঁড়িয়েছিল, চুপচাপ উঠে পড়লাম। উঠে বসে আছি, তো বসেই আছি। ট্রেন ছুটছে, আচমকা অণ্ডাল স্টেশনে আমায় চেকার ধরল-’।
অণ্ডাল? সে তো অনেকদূর গো বাবা। তুমি অত দূর চলে গেলে ন- দশ বছর বয়সে? ‘হ্যাঁ। তবে আর বলছি কি। চেকার বলল, টিকিট দেখা। বললাম নেই। সে তো মহা হম্বিতম্বি করে, কান ধরে নামিয়ে স্টেশন মাস্টারের ঘরে নিয়ে গেল। দেখলাম ঘোর কৃষ্ণবর্ণ, অনেকটা তুলসি চক্রবর্তীর মত দেখতে, ধুতি পরা একটা লোক খালি গায়ে বসে বসে কি সব কাজ করছে। চেকার বলল, ‘এই দেখুন মাস্টারমশাই, এ হারামজাদা এই বয়স থেকেই বিনা টিকিটে যাত্রা করছে। ’ মাস্টারমশাই, মাথা তুলে ইশারায় কি বলল, চেকার আমায় দাঁড় করিয়ে রেখে চলে গেল।
আমি বোকার মত দাঁড়িয়ে আছি তো দাঁড়িয়েই আছি। আচমকা লোকটা মুখ তুলে আমার খেঁকিয়ে উঠল, ‘অ্যাই হতভাগা দাঁড়িয়ে আছিস কেন? হাতপাখাটা দেখতে পাচ্ছিস না? বাতাস কর।’ লোকটার মাথার ওপর একটা বোধহয় বৃটিশ আমলের ডিসি পাখা ঘটাং ঘটাং করে ঘুরছিল। তাও দরদর করে ঘামছিল লোকটা। আমি ভয়ে ভয়ে হাতপাখাটা দিয়ে বাতাস করতে লাগলাম।
বেশ অনেকক্ষণ পর, লোকটার হিসেব বোধহয় মিলল, মুখ তুলে আমার দিকে তাকিয়ে জানতে চাইল, ‘তুই কে? বাড়ি কোথায়? পালিয়েছিস?’ আমি ভয়ে ভয়ে সব সত্যি কথাই বললাম, তখন লোকটা আমায় নিয়ে গিয়ে পেট ভরে খাইয়ে পরের ট্রেনে গার্ডের কামরায় তুলে দিল। তুলে দেবার সময় জিজ্ঞাসা করল, ‘তোকে হাওড়ায় নামিয়ে দিলে বাড়ি যেতে পারবি?’ আমি ঘাড় নেড়ে জানালাম পারব। তখন জানতে চাইল ,‘কি ভাবে যাবি?’ আমি বললাম, বেরিয়ে ৫৩নম্বর বাস ধরে চলে যাব। লোকটা আবার প্রশ্ন করল, ‘ভাড়া কত জানিস?’ বললাম এক আনা। লোকটা পকেট থেকে একটা গোটা টাকা আর একটা আনি বার করে আমায় দিয়ে বলল, ‘সাবধানে বাড়ি চলে যাস। আর কোথাও পালাস না বাপ। ’ আর গার্ডকে বলল, ‘এর কাছে টিকিট নেই। হারামজাদাকে হাওড়া স্টেশন থেকে বার করে ৫৩ নম্বর বাসে তুলে দিয়ে কন্ডাক্টরকে একটু বলে দেবেন ক্ষীরেরতলা স্টপে যেন নামিয়ে দেয়। ছোঁড়া মহা বিচ্ছু। ’ গার্ড আমায় এনে ৫৩নম্বর বাসে তুলে দিল, আমি যখন নাচতে নাচতে বাড়ি ঢুকলাম, তখন সন্ধ্যে ছটা বেজে গেছে। আমার পকেটে তখনও ঠংঠং করছে একটা গোটা টাকা-’।
এই দুর্ধর্ষ ভদ্রলোকের সঙ্গে প্রায় অর্ধশতাব্দী যে কি ভাবে ঘর করেছে মা তা বোধহয় কেবল মাই জানে। আজ এঁণাদের বিবাহের পাক্কা ৪৭ বছর পুরো হল। পরিকল্পনা তো ছিল অনেক, থাক না হয় অন্য কখনও হবে। আপাততঃ সুস্থ হয়ে উঠুক পৃথিবী। ততোদিনে আরো গভীর হোক এঁদের প্রেম, আরো মধুর হোক দাম্পত্য। কাটুক মায়ের মনের যাবতীয় মেঘ, সিগারেট ছাড়ুক বাবা, আর পারলে মিষ্টিটাও। বড্ড মিষ্টি খাও মাইরি বাবা তুমি, বললেই অবশ্য গোঁসা হবে তোমার- তা হোক তবুও বলি যেমন আছো তেমনি থাকো তোমরা শুধু সিগারেট আর মিষ্টিটাকে মারো গুলি।
No comments:
Post a Comment