Thursday, 22 April 2021

অনির ডাইরি ২২শে এপ্রিল, ২০২১

 

বেশ চিন্তিত ছিলেন শ্রীমতী তুত্তুরী। মা যেসব রাতে না ফিরতে পারে, মাসি অন্তত থাকে। কিন্তু এবারে যে মা আর মাসির নির্বাচন একই নির্ঘন্টে। কার কাছে থাকবে তুত্তুরী? এমনিতে মা আর মাসির সাথে যত খুনসুটি, বাবার সাথে ততোটাই সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক শ্রীমতী তুত্তুরীর। তাই বলে বাবা নামক ব্যক্তির সাথে একাকী দিনযাপন অসম্ভব। লোকটা কেমন যেন কলিযুগের হিটলার টাইপ। সবকিছু তার চলে নিখাদ নিয়ম মেনে। মাকে কাবু করতে না পারলেও, তু্ত্তুরীকে কেবলই নিয়মের বেড়াজালে বাঁধতে চায় বাবা। ‘দিনে তিন দান দাবা খেলবি, মিষ্টি খাবি না, দুঘন্টা গল্পের বই পড়বি আর আমার সাথে দেড় ঘন্টা ব্যায়াম করবি’- তুত্তুরীর জন্য এই হল বাবার ফরমান। সবথেকে বড় কথা- ‘অপ্রয়োজনে বেশী বকবক করবি না।’ হ্যাঁ বাবার সেবা করলে থুড়ি বাবাকে আমেজ করে দিলে যেমন ধরুন চুল ঘেঁটে দিলে, কান মুলে দিলে, হাতের বা পায়ের আঙুলগুলিকে টেনে লম্বা করে দিলে অবশ্য আনলিমিটেড বকবকানির অনুমতি মেলে, তবে তা ততক্ষণই স্থায়ী হয়, যতক্ষণ চলে আমেজ। 


এত ঝঞ্ঝাটের পর কেবল আধঘন্টা মোবাইল দেখার অনুমতি মেলে শ্রীমতী তুত্তুরীর। ভাগ্যে মাসির মোবাইলটা সারাদিন গড়াগড়ি যায় হেথায়-হোথায়। মাঝেমধ্যে মুখ বন্ধ রাখার শর্তে অবশ্য মোবাইল দেয় মাও। 


যাই হোক এখন প্রশ্ন হচ্ছে, মা এবং মাসির অনুপস্থিতিতে শ্রীমতী তুত্তুরী থাকবে কুথায়? নির্বাচনী নির্ঘণ্ট জারি হওয়ার সাথে সাথেই হাওড়া থেকে দাদু বলেছিল বটে, ‘ওকে এখানে রেখে যা’। কিন্তু নিজের দোষেই সেই সুযোগ হারাল তুত্তুরী। ভর সন্ধ্যে বেলা এমন হাঁউমাউ জুড়ল মাসি, ‘সোনা মা এটা কি?’ তুত্তুরী যতই বোঝায় ও কিছু নয়, নিছক  গুগল অ্যাসিস্টান্ট। তুত্তুরীকে সহায়তা করতে চায়, মাসি তো ভয়েই সারা। মোবাইল খুললেই কেবল অনামুখো গুগল বলে, ‘হ্যালো পুরোযা ভট্টাচার্য, আজ কি গান শুনবে? একটু অরিজিৎ সিং শুনে দেখবে নাকি? বা হাড্ডিগুডুম গাড্ডিগুডুম।’ যা না মা পড়তে পারে, না মাসি। উচ্চারণ করতে গিয়ে দাঁত কটকটিয়ে ওঠে। 


যাই হোক কথাটা মায়ের থেকে গিয়ে পৌঁছাল বাবার কানে। গম্ভীর মুখে মাসির মোবাইলটায় চোখ বুলিয়ে বজ্রগম্ভীর কণ্ঠে ফয়সালা শুনিয়ে দিল বাবা, ‘হাওড়া যাওয়া ক্যান্সেল। ’ একটা দুটো রাতেরই তো ব্যাপার, তুত্তুরী দিনের বেলা থাকবে ঠাম্মা-দাদুর বাড়ি, রাতে আপিস ফেরতা ফেরৎ আনবে বাবা। 


কাকিমা থাকলে এই প্রস্তাবে ধেই ধেই করে নাচত তুত্তুরী। কিন্তু কাকিমা যে সেই সুদূর দুর্গাপুরে।  ঠাম্মার সাথে অবশ্য ভালোই জমে, কিন্তু ঠাম্মা সারাদিন বড় ব্যস্ত থাকে। আর বাবার বাবা, এক্কেবারে বাবার মত। তাঁর সাথে চলে না আবোলতাবোল গল্প। মা দুর্গা বা শ্রীকৃষ্ণের গল্প জুড়লেই দাদু খুলে বসে গীতবিতান। নাহলে শোনায় ম্যাকবেথ বা জুলিয়াস সিজারের হত্যা রহস্য। তারপর গছায় একখান বই, ‘এটা পড় তো চেতা। ’ আর বই দেখলেই পিলে চমকায় চেতা ওরফে শ্রীমতী তুত্তুরীর। 


বাবাকে পটানোর দিনরাত চেষ্টা চালায় তুত্তুরী, আমেজ করে দেয় আশ মিটিয়ে, পাঁচন খাওয়া মুখে উপেন্দ্র কিশোরের ছোটদের রামায়ন খুলে বসে, এমনকি বীরাঙ্গনা হয়ে হাওয়াই চটি দিয়ে পটাশ করে বাথরুমে উড়ন্ত আরশোলাও হত্যা করে তুত্তুরী। মরা পেচকে যাওয়া আরশোলা দেখে মা ভির্মি খাবে বলে ফুলঝাড়ু আর বেলচা দিয়ে তুলে ডাস্টবিনেও ফেলে আসে তুত্তুরী। এহেন বীরবত্তায় রীতিমত প্রীত হয়ে বাবাজীবন অনুমতি দেন, হাওড়া যাবার। উপরন্তু অনুমতি দেন নিছক দু-এক দিন নয়, পাক্কা ছয় দিন পাঁচ রাত হাওড়ায় থাকতে পারে তুত্তুরী। শর্ত শুধু একটা, ভুঁড়ি না বাড়ে। রোজ ব্যায়াম করতে হবে, আর মিষ্টি খাওয়া একদম নিষেধ। বাধ্য কন্যার মত ঘাড় নাড়ে তুত্তুরী। সেই মত হাওড়ায় দফায় দফায় ফোন করে বলা হয়ে যায়- ‘দাদু মিষ্টি কোল্ডড্রিংক কিচ্ছু এনো না যেন। না চকলেটও নয়। বাবা বারণ করেছে। ’


আপিস যাবার পথে ৯ তারিখ সকালে ব্যাগব্যাগেজ সমেত কন্যাকে বাপের বাড়ি পৌঁছাতে গিয়ে দেখি, ডাইনিং টেবিলের ওপর ইয়া বড় এক বাক্স দেশবন্ধুর দরবেশ রাখা। পাশে এককেজির লাল ঘণ ক্ষীর দই। কিছু বলতে যাবার আগেই ধমকে ওঠে বাবা, ‘আঃ আমি খাব। কেন আমি খেতে পারি না?’ তা তো পারেই, আশি পেরিয়ে সুগারের ঘোড়া টগবগ করে ছুটছে, প্রবল ধূমপানে ফুসফুস আধা জখম, তিনি মিষ্টি খাবেন না তো, কে খাবে? দীর্ঘশ্বাস ফেলে, ফ্রিজের দরজা খুলে যথারীতি দর্শন পেলাম দুই লিটার থামস্ আপ আর পুঁচকে বোতলে মাজা। মাখন রাখার তাকে গোটা চারেক ডেয়ারি মিল্ক রাখা, ফ্রীজের মাথায় গোটা কয়েক প্যাকেট ওরিও আর অন্যান্য ক্রিম বিস্কুট। একটা ডেয়ারি মিল্ক ব্যাগে ঢোকাতে গিয়ে তড়িদাহত হলাম। খ্যাঁক করে উঠল মা। ঝুলি থেকে বেরোল বেড়াল। তুত্তুরীর জন্য আনা চকলেট আমি ব্যাগে ঢোকাই কোন মুখে! কেমন মা আমি? হ্যাংলা। মধ্যস্থতা করার সুরে বাবা বলল, ‘আচ্ছা নিক। আমি ওবেলা এনে দেবো।’ 


গাড়িতে উঠে শৌভিককে ফোন করলাম, ওগো আমায় তুমি ছাড়া আর কেউ ভালোবাসে না গো।

No comments:

Post a Comment