ইতি তোমার মা- ৫ই এপ্রিল, ২০২১
প্রিয় বুকু,
কি করছ? আজ ভীষণ ইচ্ছে করছে তোমায় একটা চিঠি লিখি। আমরা যত মেসেজে দড় হচ্ছি, ততোই ভূলে যাচ্ছি চিঠি লিখতে। আমরা কথা বলছি, সারাদিন কথা বলছি, তবুও ঠিক সম্পূর্ণ হচ্ছে না ভাবের আদানপ্রদান। অনেকদিন অভ্যেস নেই তো, জানি না কেমন লিখব, ভূলত্রুটি হলে মার্জনা করো।
আজ তোমার জন্য একটু বেশীই মন খারাপ করছে কি না, তাই ভাবলাম তোমায় একটা চিঠিই লিখি। যেমন লিখে,সেঁটে রেখে যেতাম ফ্রিজের গায়ে। তুমি তখন আরও অনেক অনেকটা ছোট। সকালের স্কুলে পড়ো। ভোর ভোর তোমায় ঘুম থেকে তুলে, একরাশ মনোবেদনা সহ ছেড়ে আসতাম স্কুলের গেটে। ভারি ব্যাগটা পিঠে নিয়ে প্রবল অনিচ্ছা আর অপরিসীম ক্লান্তি নিয়ে এগিয়ে যেতে যেতে একবার পিছন ফিরে তাকাতে তুমি, আমি হাত নেড়ে ইশারায় বলতাম এগিয়ে যাও। মাথা নীচু করে, মাটিতে পা ঘষতে, ঘষতে এগিয়ে যেতে তুমি। এরপর তোমার সাথে দেখা হতে-হতে সন্ধ্যা ঢলে পড়ত রাতের পথে।
অধিকাংশ রাতেই তোমাতে পড়তে বসানো নিয়ে বাঁধত অশান্তি। দুচার ঘা উত্তমমধ্যম খেয়েই যেতে তুমি। সকাল হলে তোমায় স্কুলের গেটে ছেড়ে আসার সাথে-সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়তে থাকত মনস্তাপ। প্রতিটি সকালে আমি নতুন নতুন করে উপলব্ধি করতাম,কতটা, ঠিক কতটা বদলে দিয়েছ তুমি আমায়। বদলে দিয়েছ জীবন তথা সম্পর্কের যাবতীয় সংজ্ঞা। বেশি শক্ত হয়ে গেল বুঝি, সহজ করে বলতে গেলে, বুঝতে পারতাম আমার জীবনের কতটা জুড়ে একচ্ছত্র রাজত্ব করো তুমি। অথচ রাতে ফিরে তোমায় পড়াতে বসালেই কিভাবে যেন কর্পূরের মত উবে যেত সারাদিন ধরে লালন করা যাবতীয় সুকুমার অনুভূতিগুলো। তাই আঁধার নামার আগেই লিখে রাখতাম চিঠিগুলো।
মনে মনে ভাবতাম অনেককিছুই, লিখতে পারতাম থোড়াই। আর লিখে ফেললেই বা কি হত? না তুমি ভালো করে পড়তে পারতে বাংলা, না ইংরেজি। মনে আছে, বাবা তোমাকে ক্ষেপাতে বলত, ‘তুই অশিক্ষিত, তাই তোর আধারকার্ড হবে না। ’ একেবারে অশিক্ষিত না হলেও সদ্যস্বাক্ষর তো ছিলেই তুমি। তাই দুচারখানা মনের কথা লিখেই আঁকতে বসতাম ছবি। পড়তে না পারলেও ছবির ভাষা তুমি দিব্যি বুঝতে। হয়তো সব শিশুই বোঝে। ভালো তো আঁকতে পারি না,তবুও একটা যে কোন পশুর ছবি এঁকে, তার চোখ থেকে টপটপ করে ঝরে পড়া জলকণার ছবি আঁকলেই তুমি বুঝতে পারতে মায়ের মনে ঘনিয়েছে ঘোর কৃষ্ণ মেঘের ঘনঘটা। আপিস থেকে ফিরে হতভম্ব হয়ে দেখতাম, পাশে কচি কচি হাতে আঁকা ঐ পশুটিরই একটি শাবক। তারও মনে জমেছে মেঘ, তারও উছলে উঠেছে ছলোছলো আঁখি। মমির মন খারাপ, তাই বেবিটারও মন খারাপ বোঝাতে চাইতে তুমি।
কখনও বা একটা বড় ফুল/পাখি বা বিড়ালের পাশে আরেকটা ছোট্ট ফুল/পাখি/বিড়াল এঁকে উভয়ের মাঝে একটা পুঁচকে পানপাতা এঁকে রেখে যেতাম। তুমি উভয়ের আসেপাশে এঁকে রাখতে আরো অনেক অনেক পানপাতা। বেবিটাও যে মাকে ভীষণ ভালোবাসে। কখনও কখনও তুমি খাতার পাতার কোণা ছিঁড়ে এঁকে রাখতে তিনটে বিভিন্ন মাপের পুঁচকে হাসিখুশি মুখ। তারপর উপহার দিতে আমাদের। উপহার পছন্দ হয়েছে কিনা জানার জন্য লোভাতুর দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে আমাদের মুখের পানে।
জানিনা তোমার মনে আছে কিনা, কিন্তু এমন প্রতিটা চিরকূট, প্রতিটি চিঠি যত্ন করে গুছিয়ে রাখতে বলতাম আমি। কারণ এই সমস্ত চিঠির আঁকিবুকি, সমস্ত ছবির বাঁকে লুকিয়ে আছে তোমার অমূল্য শৈশব। পুতগন্ধময় e-জগতের বাইরে তোমার একেবারে নিজস্ব মোমরঙের দুনিয়া।
এই দেখো লিখতে বসেছিলাম আমার কথা, আমার বর্তমান পরিস্থিতি, আমার ভালো লাগা না লাগার কথা, অথচ লিখে চলেছি তোমার,শুধু তোমার কথা। মা হবার এটাই সবথেকে বড় যাতনা। জীবনটাই যে আবর্তিত হয় তোমাকে ঘিরে। তুমি হলে আমার সূর্য, আর আমি তোমার বুড়ো পৃথিবী।
ইতি
তোমার মা।
No comments:
Post a Comment