Sunday, 11 April 2021

অনির ডাইরি ১০ই এপ্রিল, ২০২১

 


ভালো করে ঘুমই হয়নি কাল রাতে। একাকিনী হোটেলে রাত কাটানো অবশ্যি কালই প্রথম নয়। বিগতপাঁচ তারিখেও তো একাই ছিলাম হোটেলে। সৌজন্য নির্বাচন। নির্বাচনের আগের রাতে কোন সরকারী আস্তানা পাওয়া অসম্ভব, ভাগ্যে এই হোটেলখানা ছিল। ঠিক পাঁচ বছর আগের বিধানসভা নির্বাচনের সময় হুগলী তৎকালীন ওসি ইলেকশনের আপৎকালীন মাথা গোঁজার ঠাঁই ছিল বাসস্ট্যাণ্ডের ধারের এই হোটেলখানা। তিনি আবার সম্পর্কে তুত্তুরীর বাবা, তাঁর পরামর্শেই তড়িঘড়ি রমেশকে পাঠিয়ে বুক করেছিলাম ঘর। বাসস্ট্যান্ডের ধারের ছোট্ট হোটেল,একতলায় মালিকেরই মিষ্টির দোকান, দুই-তিন-চার তলায় থাকার ব্যবস্থা। আহামরি কিছুই না,মোটামুটি কাজ চালানোর মত। 


চারতলার ঘরগুলি তুলনামূলকভাবে এট্টু বড়, একটা ছোট্ট জানলাও আছে,যা দিয়ে দেখা যায় সামনের রাজপথ। বাথরুমে গিজার- হ্যাণ্ড শাওয়ার লাগানো। দেওয়ালে স্পিল্ট এসি, একটা কাঠের আলমারি, এলসিডি টিভিও ছিল। দোতলার ঘরটা তুলনায় বেশ ছোট, গিজার হ্যান্ড শাওয়ার কিছুই নেই। বালতি মগই ভরসা। বাথরুমটাই এত ছোট, নড়ানড়া করা দায়। ঘরে একখান দেওয়ালে লাগানো এসি আছে বটে, তবে তা থেকে নিখাদ হাওয়া বেরোয়। জানলাও আছে একটা, চেপে বন্ধ করে,তারওপরে জাল লাগানো। টিভিও আছে, সেই সাবেকী ছোট্ট পোর্টেবল টিভি। আর আছে একখান কাঁচের গ্লাস,  তারপাশে বড়বড় করে লেখা, ‘এখানে মদ্যপান নিষেধ’।  


ওপরের ঘরের দরজায় দুইখানি ছিটকিনি ছিল, এইঘরে একটি সম্বল। তুত্তুরী জোরে লাথি মারলেই ভেঙে পড়বে ছিটকিনি। কি আর করা। মালিক প্রভূত ক্ষমা চেয়েছেন, এইঘরটি দিয়েছেন বলে, কিন্তু উনি নিরুপায়। জেলা স্বাস্থ্য আধিকারিকের দলবল অনেক আগে থেকেই বুক করিয়ে রেখেছিল ভালো ঘরগুলি।  অবশ্য ওপরের ঘরে দুইটি ছিটকিনি থাকলেও লাগত কেবল একটি। বহু চেষ্টাচরিত্র করেও লাগাতে পারিনি তলার ছিটকিনিটা। ভেবেছিলাম গ্লাসটপ টেবিলটাকে ঠেলে দরজা আটকে শোব, তাঁকে সামান্য হিলাতেই তিনি যা ক্যাঁচোরম্যাচোর জুড়লেন, অগত্যা একখান নকল বেতের মোড়া ছিল, সেটাকেই দরজায় ঠেস দিয়ে, তার ওপর আমার পিট্টু ব্যাগটা চাপিয়ে ঘুমিয়েছিলাম সেরাতে। 


রাতই বা কোথায়? কয়েকটা তো ঘন্টা। স্নানাদি সেরে,তৈরিটৈরি হয়ে ব্যাগব্যাগেজ গুছিয়ে পাঁচটার মধ্যে ঢুকতে হয় কন্ট্রোল রুম। তার আগে ফোন করে ঘুম ভাঙাতে হয় ড্রাইভারের। তিনি দেরী করলেই মারা পড়ব যে। এমনিতেই একা শুতে বেশ গাছমছম করে,রোজই তাই টিউব জ্বালিয়ে শুই আমি, গতরাতে আবার তারই মধ্যে দরজায় ঠকঠক্। রাত এগারোটার সময় কে আবার দরজা পিটোয়। আবার দরজায় কোন পিপ হোলও নেই যে দেখব। অবশ্যি আমি চিরদিনই ডাকাবুকো, আর এরা সবাই ভালোমতই চেনে আমায়। তাই দিলাম দরজা খুলে। দরজার ওপারে সংকুচিত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে হোটেলের কর্মচারী, তাকে ঘিরে গোটা পাঁচেক কেন্দ্রীয় পুলিশের অস্ত্রধারী। উল্টোদিকের ঘরের অতিথির সাথে বাক্যালাপ রত। লোকটি হাত কচলে জানাল,পুলিশের রেড পড়েছে, ওণারা কিছু প্রশ্ন করেই চলে যাবেন, তারপর আর কেউ জ্বালাবে না আমায়। উর্দিধারীদের মাথা যদিও টুপি খুলে,সবিনয়ে ‘কোই নেহি জী। আপ শো যাইয়ে’ বলে আশ্বস্ত করে গেলেন, ঘুম আর এল না। 

এও ছিল কপালে, রাতবিরেতে হোটেলের ঘরে দরজা ধাক্কাবে পুলিশে। শৌভিকের কাছে সবটুকুই কৌতুকের ব্যাপার। আমার অনুযোগের প্রত্যুত্তরে আমোদে মাখোমাখো সুরে জানাল, ‘ভোটের আগের রাতে অমন হয়। ওখানে অনেক সময় পলিটিক্যাল পার্টির লোকজনও থাকে তো। আমার সময় অমুকের দলবল সারারাত এমন খোল করতাল পিটিয়েছিল যে রাতে ঘুমোতেই পারেনি। ’ 


ভোর চারটের অ্যালার্ম যখন বাজল, শিরায় উপশিরায় অসীম ক্লান্তি। এত সকালে তালা খোলে না হোটেলের সদর দরজার। অন্ধকার সিঁড়ি দিয়ে মালপত্র সহ হাতড়ে নেমে, করিডরে ঘুমিয়ে থাকা কর্মচারীকে ডেকে তুলে খোলাতে হয় দরজা। দরজার সামনেই গাড়ি নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন আমাদের সুবীর বাবু। আমায় নামিয়ে দিয়েই আবার বাড়ি চলে যান উনি। গিয়ে খানিক ঘুমিয়ে নটা নাগাদ আবার আসেন টিফিন তুলতে। আমার টিফিনটা রোজ উনিই পৌঁছিয়ে আসেন কন্ট্রোল রুমে। 


নতুন কালেক্টরেটের তিনতলার গতিধারা হলটাই আপাততঃ জেলা কন্ট্রোল রুম। দেওয়াল জুড়ে লাগানো গোটা বিশেক অতিকায় টিভি। যার মধ্যে আমাদের ভাগ্যে পড়ে নয় থেকে এগারোটা। প্রতিটি বিধানসভা ক্ষেত্রের জন্য বরাদ্দ একটি করে টিভি।  ইলেকশন কমিশনের নির্দেশ মোতাবেক দেড় থেকে দুই হাজার সংবেদনশীল বুথে লাগানো হয়েছে ক্যামেরা। পোল ডের আগের দিন সকাল থেকেই, ক্যামেরা গুলির লাইভ ফিড চলতে থাকে টিভিতে। 


আমাদের ডান পাশের টিভি গুলিতে চলতে থাকে নানা সংবাদ চ্যানেলগুলি। আর বাঁ পাশের টিভিতে পর্যবেক্ষণ করা হয় সেক্টর অফিসারদের গতিবিধি। ক্যামেরা লাগানোর কাজ শেষ হয়েছিল আগেই, গতরাতে অনেকক্ষণ থেকে, দেখে  গেছি আমরা, সব বুথ থেকে লাইভ ফিড আসছে কি না। একসাথে অবশ্য কখনই অনলাইন থাকে না সব ক্যামেরা। তবুও অফলাইনের অনুপাত যত কমানো যায় ততোই মঙ্গল। 


কাক না ডাকা ভোর থেকে বিএলটিপিদের ফোন করতে থাকি আমরা, ‘কি ব্যাপার তোমার অমুক বুথ কেন অফলাইন?’ কখনও বা ফোনে ধরা হয় প্রিসাইডিং অফিসারকে, ‘শুনুন না, আপনাদের ক্যামেরার ওপর থেকে কাপড়টা সরিয়ে দিন। ’ এই সমস্যা কেবল মহিলাবুথগুলির জন্যই নির্দিষ্ট। যেহেতু বুথেই রাত্রিবাস করেন ওণারা, তাই ক্যামেরার ওপর চাপা দিয়ে দেন কোন কাপড়। তাতে কিছু না,শুধু ভোর সাড়ে পাঁচটার মকপোলের আগে সরিয়ে দিলেই হল। সরাতে গিয়ে অনেক সময় বেঁকে যায় ক্যামেরা, উপড়ে যায় দেওয়াল থেকে। আবার ধরতে হয় টেকনিক্যাল পার্সনকে। তাকে না পেলে এজেন্সির সুপারভাইজার।  প্লিজ একটু দেখুন-। এই ফিড দেখতে পায় কলকাতর সিইও অফিস। দেখতে পায় দিল্লীর কমিশন। 


পুরুষ বুথে অবশ্য সে সমস্যা নেই। ঊর্ধাঙ্গ অনাবৃত করে রীতিমত স্ট্যালোন হয়ে ঘোরে লোকজন। ক্যামেরা সামনে দড়ি টাঙিয়ে শুকায় গামছা। পাশাপাশি ঘুমোয় পোলিং পার্সোনেল আর কেন্দ্রীয় বাহিনী। ভোট চলাকালীনও শুকায় গামছা আর লুঙ্গি। আহাঃ একটা দিনের তো ব্যাপার।  


গতিধারা হলের ডিজিট্যাল ঘড়িতে বাজে সকাল সাতটা। স্বস্তির নিঃশ্বাস বয় কন্ট্রোল রুম জুড়ে ভোট শুরু হয়ে গেছে। ক্যামেরার ফিড বলে দরজার বাইরে বিশাল লাইন এই সাতসকালেই। কেজো ফোনের পাশাপাশি ফোন করি আমার বুড়োকে, ‘ভোট দিতে যাবে না বাবা?’ দীর্ঘশ্বাস ফেলে জানায় বাবা, ‘ আর্যবালিকা স্কুল অবধি গিয়ে কি আর হেঁটে ফিরতে পারব? এবার ভাবছি দেবো না। ’ করোনার আবহে ভোট দিতে না যাওয়াই মঙ্গল, তবুও বড় মনখারাপ হয়ে যায়। জানি বৃদ্ধের ভোট দেবার কি তীব্র ইচ্ছে, ভোটের ফলাফল নিয়ে প্রতিনিয়ত কাটাছেঁড়া করে চলেছে যে মানুষটা, সে বয়ঃজনিত শারিরীক  অসমর্থতার কারণে ভোট দিতে পারবে না, ভাবতেই ব্যাথাতুর হয়ে ওঠে মন। 


কাপের ফেনার সাথে দুঃখ গিলে আবার ঘোরাতে হয় ফোন, করতে হয় মাতব্বরী। আপনার বুথে এত লোক ঢুকেছে কেন? লাইনটা প্লিজ বাইরে দেওয়ান। বা আপনার বুথের ইভিএম স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে যে, কম্পার্টমেন্টটা ঘুরিয়ে দিন একটু। বা একি আপনার এভিএমের পিছনের জানলা/দরজাটা খোলা নাকি? বন্ধ করুন শীঘ্র। প্রিসাইডিং অফিসারকে ফোনে না পেলে প্রথম পোলিং অফিসারকে। কখনও ধরেন, কখনও বা বেজে যায় ফোন, কখনও বা ঘুম চোখে ফোন ধরেন তাঁর স্ত্রী, ‘এই ফোনটা তো বাড়িতে রেখে গেছে- । ’ 


একান্তই কাউকে না পাওয়া গেলে তখন ধরতে হয় সেক্টর অফিসারকে। সেক্টর অফিসারদের তালিকা খুব মনযোগ দিয়ে দেখি আমি। আইএমডব্ল্যু দেখলে অদ্ভূত আপনভাবে ভরে ওঠে মন। এই তো আমার নিজের লোক।  ‘শুভঙ্কর ক্যামেরার সামনে গামছা শুকোচ্ছে বাবা। একটু সরিয়ে দিতে বলো প্লিজ।’ বেচারা শুভঙ্কর একবার ছেড়ে তিনবার ফোন করে, ‘সবকটা বুথ থেকেই গামছা সরিয়ে দিয়েছি ম্যাম। এবার দেখুন তো। ’ 


কখনও বা বলা হয়, ও মশাই বুথ ছেড়ে সবাই গেলেন কোথায়? ক্যামেরার সামনে ফোন হাতে এসে দাঁড়ান প্রিসাইডিং অফিসার, ‘আছি ম্যাডাম। আমি আছি। বাকিরা খেতে গেছে। ’ বেলা ঢলে বিকালের দিকে। লোক কমতে থাকে বুথে। অশক্ত বৃদ্ধ বাবা বা মাকে ধরে ধরে ভোট দিতে নিয়ে আসে পুত্র তথা পরিজন বর্গ। আসেন দৃষ্টিহীন ভোটার। এঁণাদের ভোট দেবার আগ্রহ দেখে ভরে ওঠে মন। এই না হলে আমার দেশ, বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্র। এক ফাঁকে মেসেজ করে বাবা, ‘ভোট দিয়ে এলাম।’





No comments:

Post a Comment