কোজাগরী রাত। চরাচর ব্যাপী মধুজোছনা ছড়িয়ে, শ্যাওলা ধরা দীঘির জলে স্নান করতে নামে রূপার থালার মত পূর্ণযৌবনবতী চাঁদ।
কিছুক্ষণ,মাত্র কিছুক্ষণে জন্য ঝুরঝুর করে ভেঙে পড়ে চারশ বছরের পুরাতন গাঁথুনি।
খসে পড়ে মরচে ধরা শিকলির দল।
আড়ামোড়া ভেঙে চৌকাঠ ডিঙোন সুন্দরী।
দীঘির পাড়ে অধীর প্রতীক্ষায় অস্থির সম্রাট।
গ্রাহ্য করেন না সুন্দরী। সর্পিল কুঞ্চিত কেশদাম আঙুলে পেঁচিয়ে ভেঙে পড়া, ফাটল ধরা ঘাটের সিঁড়িতে এসে বসেন পদ্মাক্ষী।
দীঘির জলে তখন দুইখানা চাঁদ। কাঁপন ধরায় বৃদ্ধ সম্রাটের শতাব্দী প্রাচীন হৃদয়ে।
এগিয়ে যান পায়ে পায়ে। মরচে ধরা হাঁটু নিয়েও নতজানু হয়ে বসেন-
ঈষৎ বিভঙ্গে তাকান সুন্দরী। পলকে স্তব্ধ হয়ে যায় চরাচর। শ্বাসরোধ করে উৎকীর্ণ হয়ে ওঠে হিমেল হৈমন্তী বাতাস, স্নান থামিয়ে মাথা তোলে শশধর।
না বলা কথাগুলি ফুলে ফেঁপে ফুঁসতে থাকে দুটি হৃদয়, বিদ্রোহ করে। বড় বেইমান রসনা।
সুন্দরীর কোমল রক্তাভ পদযুগল তুলে নেন, ক্রোড়ে।
মুগ্ধ দৃষ্টিতে রচিত হয় প্রসাধন।
অকপটে স্বীকার করেন বৃদ্ধ সম্রাট, “ওহে সুন্দরী, বড় ভালোবাসি তোমায়। বড়, বড় বেশী ভালোবাসি। ”
বিশ্বাস করে কি সুন্দরী? বড় রহস্যময়ী তিনি। মান-অভিমানের পালা রচনায় বড় পটীয়সী।
কথায় কথায় রাত ঢলে। ম্লান মুখে স্নান সেরে আকাশে ফিরে যায় বিগতযৌবনা চাঁদ।
কখন যেন পূব আকাশে টুক করে উঁকি মারে ঢুলঢুলে শুকতারা।
শিকল হাতে হাজির হয় কন্ধকাটা প্রহরীর দল, শিকলে জড়ান সুন্দরী। নতুন করে গাঁথা হয় চারশ বছরের পুরাতন কুঠুরীর দুয়ার।
অন্তিম পাথরটি গাঁথার সময় শেষবারের মত হয় শুভদৃষ্টি। ছলছলিয়ে ওঠে কন্যার দুই চোখ-
নতুন করে ফাটল ধরে চারশ বছরের বুড়ো সুলতানের বুকে।
চারশ বছর তো হল, আর কতদিন? আরো কতদিন?
জবাব চান সুলতান।
নীরব রাত। নীরব চাঁদ। জবাব দেয় না কেউ। বদ্ধ কুঠুরির দেওয়ালে মাথা রেখে প্রতিবার একটাই কথা বলেন, বুড়ো সুলতান,“ আবার দেখা হবে আসছে কোজাগরীতে। যখন নাইতে নামবে চাঁদ।”
No comments:
Post a Comment