Tuesday, 20 October 2020

অনির পুজোর ডাইরি, অক্টোবর, ২০২০

 অনির পুজোর ডাইরি, ১৮ই অক্টোবর, ২০২০

কবে যেন বেরিয়েছিলেন বাবা। সঙ্গী ছিলেন শাশুড়ী মাতাও। ঐ আর কি টুকটাক গৃহস্থালির সরঞ্জাম কিনতে, ফেরার পথে কিনে এনেছিলেন তিনটি শাড়ি। একটি ওণার প্রিয়তমা সহধর্মিনীর জন্য, আর বাকি দুটি, দুই আদুরে পুত্রবধূর জন্য। সাথে আবার উমার আর আমার জন্য ম্যাচ করে পাথর সেটিং ঝুটো দুলও আনতে ভোলেননি। 


দুই পুত্র তো জানতে পেরে রাগে অগ্নিশর্মা। বৃদ্ধকে নিয়ে বড়ই আতঙ্কে থাকি আমরা। একে তো দুই দফা কর্কট রোগাক্রান্ত  হয়েছিলেন, তারওপর প্রায় তিন দশক ধরে ফুসফুসের ব্যাধিতে জেরবার। বুকের ডাক্তার বছর খানেক আগে বলেই রেখেছেন,“জিতেন  বাবু যদি প্রাণে বাঁচতে চান, তো বাড়িতেই থাকুন। রাস্তার ধুলো ধোঁয়া নিতে পারবে না আপনার ফুসফুস। ” বৃদ্ধ এমনিতে বেশ বাধ্য, তারওপর  আগত অতিমারি তো রীতিমত লক্ষ্মণরেখা টেনে দিয়েছে ওণার দুয়ারে। 


টুকটাক দোকানবাজার ফোনে বলে দিলেই দিয়ে যায়। তারপর দুই পুত্র আর অনলাইন তো আছেই, তবুও উনি বেরিয়েছিলেন।  বলতে গেলে স্বপক্ষে যুক্তি দেন নিজে না পছন্দ করলে হয়? তারপর কিঞ্চিৎ  লজ্জিত হয়ে জানান, শুধু যে বেরিয়েছিলেন তাই নয়, বেরোবার তাড়ায় ভুলে গিয়েছিলেন মাস্ক পরতে।  


বাবার ভুলে যাওয়া অবশ্য প্রবাদপ্রতিম। সারা দিন ধরে কত কি,যে  ভুলে যান উনি। ওণাকে মনে করিয়ে দেওয়াটাই আজকাল শাশুড়ীমাতার মূখ্য তথা প্রধান করণীয়। তিনি যদিও মাস্ক পরেছিলেন, কিন্তু যেকোন কারণেই হোক না কেন, বাবা যে মাস্ক পরতে ভুলে গেছেন, এটা আর খেয়াল করতে পারেননি। 


তারপর? এই প্রশ্ন করলে কাঁধ ঝাঁকিয়ে জবাব দেন বাবা, “দোকানে ঢুকতে যেতেই আটকাল, বলল মাস্ক কোথায়?” তখন কি করলেন? এবার একটু চওড়া করে হাসেন বাবা, “পকেটে রুমাল ছিল। বড় রুমালটা বেশ করে বেঁধে নিলাম নাক আর মুখ ঢেকে। ব্যাস্” বাপরেঃ কি ডানপিটে বুড়ো। 

প্রসঙ্গতঃ শাড়িগুলো ছিল নববর্ষ উপলক্ষে পাওয়া।  তারপর তো কত জল বয়ে গেল গঙ্গা দিয়ে, ঘটে গেল কত্ত কিছু। দুগ্গা এল ঘরে,সময় ঘনিয়ে এল, সকন্যা এবার আমিও পাড়ি দেবো পিত্রালয়ে। যাবার আগের সান্ধ্য আড্ডায় যখন বাবার সনির্বাচিত শাড়ি পরে বাবার পাশে বসলাম, দেখলাম  বাবা যথারীতি ভুলে গেছেন এই শাড়ি আসলে ওণারই উপহার। বলেছিলাম না, বাবার ভুলে যাওয়া- প্রবাদপ্রতিম।

অনির পুজোর ডাইরি, ১৯শে অক্টোবর, ২০২০


ভোর ভোর রওণা দেব আমরা। আকাশে তখনও থাকবে শেষ অক্টোবরের মায়াবী পশমী কুয়াশা। D কদাচিৎ ফাঁক ফোকর দিয়ে উঁকি মারবে কুসুম কুসুম কমলা রঙা সূর্য। 


উত্তেজনায় প্রায় বিনিদ্র যাপিত হয় রজনী। পূব আকাশে একমুঠো লালচে-কমলা রঙ ছড়িয়ে পড়ার সাথে সাথেই কান ধরে ঘুম ভাঙায় মুঠো ফোনের বেয়াড়া অ্যালার্ম। জানলার বাইরে মনখারাপ করা ঝিমঝিমে সকাল। কাঞ্চন গাছের শাখাপ্রশাখায়R তখনও লুকিয়ে টুকরোটাকরা কুয়াশা।


দীর্ঘ সাত মাস পর, ফিরব প্রিয় শহরে। এর আগে কচিৎ ঝাঁকিদর্শন হয়েছে বটে,তবে সে তো নিছক কর্তব্য। জীবনের প্রথম তিনদশক কাটিয়েছি যে বাড়িতে, যার পলেস্তারা খসা দেওয়াল, জানলার খড়খড়ি আর লোহাচুর ঝরে পড়া কড়িবরগা জানে আমার সব গোপন কথা, ফিরে যাব তার কাছে। আবেগে সুখে টইটুম্বর হৃদয়ে তবুও বাজে বিষাদী বেহালা। বয়স মাত্রই কটা  বছর, তবুও বড় মায়াবীk আমার সংসার। আমার সোনালী ঝুমকো লতা, আমার নীল অপরাজিতার থোকা, আমার বেলফুল গাছে ধরা মরশুমের শেষ কলি, আমার ছোট্ট জলাধারে তুত্তুরী পরম আদরে লালিত দুই মারকুটে মাছ, ঘর ভর্তি পেঁজা তুলোর মত উড়ে বেড়ানো আমার ভালোবাসার ওম - থাকবে তো এমনি? অপেক্ষা করবে তো আমার তরে? বড় বেইমান এই মন- 


গড়িয়ে যায় গাড়ির চাকা, পিছনে ফেলে বড় বেশী অভ্যস্ত, চেনা পরিমণ্ডল। তখনও ভালো করে ঘুম ভাঙেনি মহানগরের। যত বেলা বাড়বে, পথে পথে নামবে জনপ্লাবন। কিঞ্চিৎ আতঙ্কিত তুত্তুরী। ভিড় যে আপাততঃ বিষবৎ পরিত্যাজ্য। বিগত রাতে মুঠোফোনের পর্দা কাঁপানো মণ্ডপগুলিতে এখন শুধু গুটিকয় নিদ্রালু স্বেচ্ছাসেবক আর বেওয়ারিশ সারমেয়দের ভিড়। অধিকাংশ মণ্ডপে এখনও হয়নি উদ্বোধন। ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে আছে তার, কাপড় আর প্লাস্টিক।  বাগবাজারের বিশালাক্ষীর পরনে শুধুই অন্তর্বাস। লজ্জায় খবরের কাগজের আবডালে মুখ ডেকেছেন সবৎসা জননী। বাইরে প্রতীক্ষারত তুত্তুরী, একটিবার-শুধু একটি বার দাও দর্শন। বুড়ো ঝাড়ুদার ঝাঁটা ফেলে ছুটে আসে সান্ত্বনা দিতে, “কাল এসো। কালই তো উদ্বোধন। কত লোক আসবে। মা তখন কত সোন্দর করে সাজবে। ” ছলছল চোখে তাকায় তুত্তুরী। তবে কি এবছরের মত আর দেখা হবে না মা?


কমলা সূর্যের আলোয় লাগে কাঁচা সোনা রঙ। অবাধ্য ছিঁচকাঁদুনে সন্তানের ডাকে সাড়া দেন বিশালাক্ষী। একে একে মুখ খোলে লক্ষ্মী-সরস্বতী-কার্তিক। “গণু দাদা প্লিইজ-”। আর্তি জানায় তুত্তুরী। গণেশের মুখ থেকেও সরে যায় আবরণ। অর্ধ উলঙ্গ জননী দর্শনে পরম পুলকিত হয়ে ওঠে মেয়ে আমার। 


বাড়ির গলিতে পা রাখার সাথে সাথেই যেন অলিখিত উৎসবের বাতাস বয়ে যায় শতাব্দী প্রাচীন বাড়িটার শিরা উপশিরায়। দোতলার বন্ধ জানালা আর বদ্ধ বাতাসে লুকোচুরি খেলা করে শারদীয়া সুর। আর তু্ত্তুরীর চোখে-ঠোঁটে-গালে-হাতে-পায়ে ফুটে ওঠে না জানি কত নাম না জানা রঙ। মেহেন্দি আর আলতার সুবাসে ভরে ওঠে এবাড়ির বাসিন্দাদের হৃদয়।দুগ্গা এল ঘরে- । তাই না পরম আদরে হাতে পায়ে হেনার নকশা কেটে দেয় বড় মামি। সুখের বেলা গড়িয়ে কখন যেন নামে সন্ধ্যা। দপ্তর ফেরৎ বড়মামার সামনে বসে বসে জুড়িয়ে যায় চায়ের কাপ। তুত্তুরীর পায়ে ফুটে ওঠে লালচে আলতার রঙ। মেহেন্দি আর আলতার রূপে রসে সৌরভে ঝলমলিয়ে ওঠে উৎসবী রাত। মণ্ডপে কার্ফু, হৃদয়ে তো নয়।


অনির পুজোর ডাইরি, ২১শে অক্টোবর, ২০২০


দেড়শ বছরের পুরাণ বাড়িটা বছরের অন্য সময় বুড়ো চিলের মত বসে বসে ঝিমোয়। হয়তো তখনও মাথার ওপর বিছিয়ে থাকে এমনই আশমানী নীল চাঁদোয়া । তখনও হয়তো এমনই গলানো সোনা রঙা রোদ লুকোচুরি খেলে বাবার সাধের আম আর কাঁঠাল গাছের পাতায়। ঘন সবুজ আম্রপল্লবে প্রতিফলিত সকালী রোদ হয়তো জানলা গলে এমনই আঁকিবুকি কেটে যায় বৈঠকখানার শ্বেতমর্মর মেঝেতে। খেয়ালই করে না কেউ- প্রভাতী বাতাসে হয়তো তখনও মাথা ঝাঁকিয়ে আড়ামোড়া ভাঙতে ভাঙতে মাকে ডাকে, মায়ের হাতে লাগানো তরুণ পেয়ারা গাছ। উঠোনের সাদা-লাল-গোলাপী কৃষ্ণচূড়া আর নয়নতারার ফাঁকে এমনই গুনগুনিয়ে যায় হলুদ কালো প্রজাপতি থেকে লাল-কালো পিঁপড়ের দল। কেউ আড়ি পেতে শোনে না সেই কলতান। 


                 বর্তমানে অবশ্য সেই নীরবতা ইতিহাস মাত্র। দীর্ঘ সাত মাস ব্যাপৃত আমাদের অনাবাস আর বৃদ্ধ এবং তাঁর বেতো স্ত্রীর অপারগতার সুযোগে এবাড়ির রন্ধ্রে রন্ধ্রে জমেছে পুরু ধুলিকণার আস্তরণ। কোণায় কোণায় আবর্জনার স্তুপ। সেই আবর্জনা দূর করা নিয়েই শুরু হয় দিনটা। অপরিসীম মায়ার বাঁধনে জড়ানো এ বাড়ির সবকিছু। প্রতিটি আবর্জনার জন্য এবাড়িতে আছে একখানা রূপকথা। ওই যে আলমারির কোণায় অবহেলে পড়ে থাকা কালচে রঙের প্যান্টটা- ওটা তো রাণীর উপহার। প্রথম বেতন পেয়ে কেনা। সেদিনের তরুণী রাণী অর্থাৎ ছোট মাসি ইস্টার্ন রেলওয়ে অডিট থেকে অবসর নেবার পরও কেটে গেছে কতগুলি বছর। শুধু বাতিল প্যান্টটাই আর ফেলা হয়ে ওঠেনি। 


                         

                           সেবার  কোথা থেকে যেন বেশ কিছু টাকা পেয়েছিল বাবা, মাকে না জানিয়েই কিনে এনেছিল তিনটে সাউথ কটন শাড়ি। মধ্যবিত্ত সংসারে এই খামখেয়ালি অবিমৃষ্যকারিতা বেশ কিছুদিন দাম্পত্যকলহে ঘৃতাহূতির কাজ করেছিল। সে অনেককাল আগের কথা। নব্বইয়ের দশকের সূত্রপাত সবে, মায়ের ক্রমাগত অনুযোগ তথা শাড়িগুলির অনুপম নক্সায় বিমুগ্ধ হয়ে জনৈক শাড়ি বিক্রেতা মাসি কিনে নিতে চেয়েছিলেন শাড়িগুলি ন্যায্য মূল্যে। বিক্রি করেনি মা। বেশ কয়েক বছর পর একবার পরতে চেয়েছিলাম, তখন বোধহয় কলেজে পড়ি, অন্য একডজন শাড়ি বার করে দিয়েছিল মা। ঐ তিনটি শাড়ি দেয়নি প্রাণে ধরে- এখন সবই বিবর্ণ, পাটে পাটে ধরেছে ফাটল,  তবুও ফেলতে চাইলে আঁতকে ওঠে মা। আর ঐযে মুসৌরির ম্যাল থেকে কেনা লাল ব্যাগী পুলওভারটা- উননব্বই সালে যার দাম ছিল মাত্র কুড়ি টাকা! আমার কন্যারও ছোট হয় আজকাল। দুই প্রজন্মের অত্যাচারে খুলে এসেছে উলের বাঁধুনী। তবুও ফেলা নিষেধ। হয়তো আরেক প্রজন্মের জন্য জমিয়ে রাখতে চায় মা। ছাতের সিঁড়িতে পুঁটলি করে রাখা তুত্তুরীর পুরানো শৈশবের জামার দিস্তাকে স্পর্শ করাও নিষেধ। এটা পরে  প্রথম ভাত খায় দাদুর সোনার তুত্তুরী, প্রথম জন্মদিনে ঐ জামাটা উপহার দেন শ্বশুরমশাই- দ্বিতীয় জন্মদিনে কিনে দেওয়া তেচাকা সাইকেল, একহাতে দুধের বোতল  মুখে ধরে সাইকেল চালাত তুত্তুরী। হোক না আজ ধুলোপড়া ন্যাতাকানি, তবুও প্রতিটি ছত্রে ছত্রে মাখামাখি জীবনের অমূল্য সব স্মৃতি। 


                             শুধু যে আবর্জনা আর রদ্দি নিয়েই সমস্যা হয় তা নয়, দ্বন্দ্ব বাঁধে বিদ্যুতের অপব্যবহার নিয়েও। সারাদিন ধরে আলো জ্বলে আর পাখা ঘোরে এ বাড়িতে। মায়ের জন্য সোহাগ করে গুচ্ছ খানেক বৈদ্যুতিক পাখা লাগানো সারা বাড়ি জুড়ে। বাতানুকূল যন্ত্র থাকা সত্ত্বেও প্রতিটি শোবার ঘরে দুটি করে পাখা ঘোরে এবাড়িতে। একটি খাটের ওপর আর অপরটি ঘরের বাকি অংশের জন্য। দালান তথা বসার ঘরে,শৌচাগারে এমনি রান্নাঘরেও লাগানো একটি পাখা। পাখা চালিয়ে আনাজ কাটে মা। খাবার টেবিলে বসে শব্দজব্দ করে বাবা। বুড়ো পাখার ঘর্ঘর শব্দে রচিত হয় দুর্বোধ্য প্রেমের কবিতা। উঠে গেলেও পাখা নেভানোর কথা মনে থাকে না কারো। অনুযোগ করতে গেলে ওষ্ঠ ফুলে ওঠে বৃদ্ধের। অভিমানী কণ্ঠে মনে করিয়ে দেয়, কোন এককালে যখন একটি মাত্র ডিসি পাখাই ছিল সম্বল,হতো ভয়ানক লোডশেডিং, সারা রাত হাতপাখা চালাত বাবা আর মা ভাগাভাগি করে। হাতপাখার বাতাস থামলেই নাকি ককিয়ে উঠত ওদের শিশুকন্যা। আর আজ যদি মা একটি দুটি পাখা নেভাতে  ভুলেই যায়--


                                গুচ্ছখানেক বুড়ো শিলিং ফ্যান ছাড়াও আছে একটি মান্ধাতা আমলের টেবিল ফ্যান। বয়স বোধহয় বছর কুড়ি। মায়ের সাধের ককটেল বার্ড, যার পোশাকী নাম টুঁইটুঁই, তিনি স্নান করে এলে ঐ পাখাটা চালিয়ে শুকানো হয় তার পালক। মায়ের মতই পাখার হাওয়া ছাড়া থাকতে পারে না টুঁইটুঁই। আমি বা তুত্তুরী যদি ভুলেও বন্ধ করি পাখা, অমনি “মা-মা-মা” করে সোচ্চারে নালিশ জানায় টুঁইটুঁই। স্পেশাল সূর্যমুখীর বীজ এনেছিল বাবা টুঁইটুঁই এর জন্য, খেলে নাকি বাড়বে জৌলুস। দুদিন ঠুকরে আর মুখ ঠেকায়নি টুঁইটুঁই। মায়ের মতই টুঁইটুঁইয়ের প্রিয় খাদ্য মুড়ি। আর হাতে গড়া রুটির নরম ফুলকো। সে রুটি বানাতে হবে স্বয়ং মাকে। রান্নার দিদির বানানো রুটি ছুঁয়েও দেখে না টুঁইটুঁই। উল্টে গলা ফাটিয়ে নালিশ করে “মা-মা-মা”। বাবা এবং তুত্তুরীর ধারণা এত খাদ্যবিলাসী হওয়ার জন্য দিনদিন মোটু হয়ে যাচ্ছে টুঁইটুঁই। নাদু হচ্ছে রীতিমত। সে অবশ্য কেবল তুত্তুরী আর তুত্তুরীর দাদু ছাড়া কেউই দেখতে পায় না। 


অশান্তির আরো একটা কারণ হল বাবার মিষ্টি প্রিয়তা। অতিমারি বড় বেশী থাবা বসিয়েছে এই মহল্লায়। প্রায়ই আসেপাশের বাড়ি থেকে ভেসে আসে বাসি মৃত্যুর বাস। নিরাপত্তার কারণে বাবা-মা-পিসির গতিবিধির ওপর নিয়ন্ত্রিত কড়া বিধিনিষেধ। আগে পাঁচটা মনিহারি দ্রব্য কিনতে পাঁচবার বাজার যেত বাবা। পেডোমিটার চালিয়ে বারেবারে বাজার যাওয়াটাই ছিল বাবার প্রিয় শরীরচর্চা। পথে এবাড়ির বারন্দা, ওবাড়ির রক, সে বাড়ির জানলা থেকে চলত কুশল বিনিময়। টুকটাক রাজ্য-রাজনীতির গল্প। বিগত সাত মাসে সবই বন্ধ প্রায়। গল্প করার মানুষগুলোর অনেকেরই উইকেট পটাপট ফেলে দিয়েছে করোণা। বাকিরাও কেমন যেন জবুথবু হয়তো বা শোকাহতও। মাঝে মাঝে বাবা বেরোয় বটে, চালায় পেডোমিটারও, তবে মোড়ের মাথায় পৌঁছাতে পৌঁছাতেই হাঁফিয়ে পড়ে আজকাল। ভালো মিষ্টি পাওয়া যায় না এপাড়ার দোকানে, কিনতে হলে যেতে হবে অদূরের কদমতলা বাজারে। উচ্চ ন্যায়ালয় যতই প্রতিবন্ধকতার দেওয়াল তুলুক না কেন, বাজার সবসময়েই সরগরম। পুজোর মুখে থিকথিকে ভিড় বাজারে। তারই মধ্যে যেতে চায় বাবা, মিষ্টি কিনতে। নিজের জন্য নয়, তুত্তুরী আর বুল্লু বাবুর জন্য। উৎসবের দিন, ঘুরতে ফিরতে টপাটপ গালে চালান করবে মিষ্টি, তবে না বাঙালী বাড়ির পুজো। 


কলহ থামলে, জমে থাকা বাজারের ফর্দ নিয়ে বেরোই টুকিটাকি নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রী কিনতে। প্রিয় শহরের বুকে তখন নামে সন্ধ্যা। আলোকমালা প্রসাধনে অপরূপা হয়ে ওঠে পাঁচশ বছরের বুড়ি শহর। সজ্জিত মণ্ডপ থেকে ভেসে আসে মাইক্রোফোনের নানা সুর।  মণ্ডপে একাকী প্রতিমাকে সাক্ষী রেখে “ডাকের তালে- কোমর দোলে”। উদ্দাম নাচ জোড়ে গুটিকয় কচিকাঁচার দল- যাদের মধ্যে ধেড়েটার বয়স বোধহয় বছর ছয়েক।  কিংকর্তব্যবিমূঢ়, মাঝারি মাপের ভিড় জমে পথেঘাটে, দোকানপাটে। সাধ থাকলেও সাহস নেই মার্কা হতাশা মেখে শেষ হয়ে আসে উৎসব মুখর আরেকটা সাবধানী দিন। ব্যাগ ভর্তি ঘিয়ে ভাজা দরবেশ আর লাল দই কিনে চটজলদি পা চালাই দেড়শো বছরের বুড়ো বাড়ির দিকে, হাঁটতে হাঁটতে ভাবতে থাকি, গরম চায়ের পেয়ালার সাথে কি ভাবে জমিয়ে তুলব সান্ধ্যকালীন মুচমুচে কলহ-বিবাদ। ঝিমিয়ে পড়া বাড়িটা আর তার বাসিন্দাদের চাঙ্গা করতে কলহ যে বড় অব্যর্থ। ঝগড়া করুন- ভালো থাকুন। মণ্ডপে কার্ফু- মনে তো নয়।




No comments:

Post a Comment