গম্ভীর গলায় বাবা বলল, “তোমার জিনিসটা দিয়ে গেছে। খুলে দেখেও নিয়েছি। সব গোটা আছে। তবে-” শুনেই ব্যোমকে গেলাম। অনলাইন শপিং ব্যাপারটা বাবার ভয়ানক অপছন্দের। আরে সব যদি ঐ দিশী-বিলিতি শপিং সাইট থেকে কিনব, তো ছোট-মাঝারি ব্যবসাদাররা খাবে কি? এদের বাপ-ঠাকুর্দাই তো খাইয়ে-পরিয়ে বাঁচিয়ে রেখেছে আমাদের। একই মত বাবার জামাইয়েরও। তবে ব্যাপারখানা হল যে, এতকিছুর পরও ঘুরে ঘুরে বাজার করার মত একজনের সামর্থ্য (শারীরিক) নেই, আর একজনের নেই সময়। অগত্যা এই শর্মা জিন্দাবাদ।
বিশেষ কিছু কিনিনি এ যাত্রা, গুটি কয়েক কাঁচের কাপ। তাও তো গোটাগুটিই ডেলিভারি দিয়েছে অ্যামাজন, তাহলে আবার 'তবে ' কি? ফোনের ওপারে সাময়িক নীরবতা ভঙ্গ করে ভেসে আসে বাবার হতাশ কণ্ঠস্বর, “বাক্স থেকে আরম্ভ করে, মালটা- সবই চীনে মাল।” সর্বনাশ! বৃদ্ধ আবার ভয়ানক স্বদেশী। ঠাকুমা এবং বাবার পিসিরা এককালে বিলিতি কাপড় তথা পণ্যের দোকানে পিকেটিং করত। তাঁরা সকলেই আপাততঃ স্বর্গত, তবে স্বদেশীয়ানার ভূতটা বেশ বিরাজমান আমাদের ব্যাঁটরার চাটুজ্জে বাড়িতে। আমিই দৈত্যকুলে প্রহ্লাদ। তবে মালটা যে চাইনিজ এটা আমিও জানতাম না। অ্যামজন একটা বাবা থুড়ি চীনে ফিল্টার লাগাতে পারে- দমে না গিয়ে জোর গলায় বললাম, “সে আর কি করা যাবে? তোমার দেশ ঐ জিনিস বানাতে পারে না, তাই-”। কথা শেষ করতে দিলে না বৃদ্ধ ফোঁস করে উঠল, “আরো ভালো জিনিস বানায়, তাই”।
বেলা বাড়ছে, বেজার মুখে রান্নাঘরে ঢুকলাম। খুব ভালো না পারলেও, রান্না করতে আমার বেশ ভালোই লাগে। একথা শুনলেই শিকারী বেড়ালের মত ফ্যাঁচ করে ওঠে অন্তরা আর চৈতালী। “কি বললি, রান্না করতে ভালো লাগে?” বাকিটা ওদের বলতে লাগে না, আমিও জানি, রোজ রান্না করতে হয় না বলেই এসব বুলি আসে আমার মুখে। তবে একটা কথা আমার প্রায়ই মনে হয়, রান্না করার থেকে অনেক বেশী জটিল, কি রাঁধব তা ঠিক করা।
“কি রান্না হচ্ছে?” পিছন থেকে গম্ভীর ভাবে জানতে চাইল শৌভিক। সকাল থেকেই অমন ছদ্ম গাম্ভীর্য নিয়ে ঘুরছে। এমন মিঠে আবহাওয়া, এমন কাঁচ কাঁচ রোদ, এমন দিনে ছিল হয়তো অন্য কোন পরিকল্পনা, হয়তো অন্য কোন জনমে। কিন্তু আপাততঃ “ভেস্তে গেল সন্দরী গো সবই কপাল দোষে”।
উচ্ছে খাওয়া মুখে এখন বসেছি করলা কাটতে। বস্তুটির প্রতি তুত্তুরী বা আমার ছিটেফোঁটাও প্রীতি নেই, বরং তীব্র অসূয়া আছে। বাজাড়ু গৃহকর্তা অবশ্যি বেশ ভালোবাসেন। সিদ্ধ উচ্ছে/করলা বেশী, আলু কম, অপরিমিত ঝাঁজালো সর্ষের তেলে মাখো মাখো। খেয়ে মুখ পচে গেছে মাইরি। আজও কি রাঁধতাম নাকি? নেহাৎ পুজো শেষে হাওড়া থেকে ফিরে ফ্রীজ সাফ করতে গিয়ে গুটি কয়েক প্রায় হিমায়িত করলা আবিষ্কার হয়েছে-
ঘাড় না ফিরিয়েই জবাব দিলাম, “কুড়কুড়ি করলা।” ভ্যাবাচাকা খাওয়া বিড়বিড়ে অথচ কিঞ্চিৎ অভিমানী স্বর ভেসে এল,চৌকাঠের ওপার থেকে “ ভাতের সাথে আমি কুড়কুড়ি খাই না রে বাবা। ” সত্যি বলতে কি, কুড়কুড়ি করলা আমিও বাপের জন্মে খাইনি। কোন স্মরণাতীত কালে কুড়কুড়ি ভিণ্ডি রাঁধতে শিখিয়েছিল রিমি। ভাড়ার বাসে করে মহানগরে আপিস করতে যেতাম তখন। বাসের নাম ছিল স্নেহা। দরজা দিয়ে উঠেই ডান দিকের তিন নম্বর সিটটি বরাদ্দ ছিল আমাদের দুজনের জন্য। বড়ই সুখের ছিল সেই সব দিন।
অনেক দিন কেটে গেছে, ভুলেই গেছি অর্ধেক রেসিপি। স্মৃতি হাতড়ে ফালি ফালি করে করলা কেটে,বীজ ছাড়িয়ে, জল ঝরিয়ে হলুদ, জোয়ান, সামান্য লঙ্কা গুঁড়ো আর বেসন দিয়ে চটকে মাখি। কর্ন ফ্লাওয়ার দিতে বলেছিল বোধহয় রিমি। ওদের বাড়িতে বেসনের ব্যবহার প্রায় ব্রাত্য। সব ভাজাভুজিই ভুট্টার আটায় করেন ওণারা।অনেক বেশী মুচমুচে হয়। কর্নফ্লাওয়ার ফুরিয়েছে খেয়াল করিনি। যাক গে বেসনই সই। এখনই নুন মাখাতে নিষেধ করেছিল রিমি, তাহলে জল বেরিয়ে,মুচমুচে ভাজা আর হবে না। গরম গরম ভেজে চাটমশলা ছড়াতে হবে। সেটাও বোধহয় ফুরিয়েছে, তাহলে বিট লবণ।
গুটি চারেক হিমায়িত পটলও বেরিয়েছে। দইপটল খেতে খুব ভালোবাসে তুত্তুরী। গোটা গোটা পটল অল্প খোসা তুলে, সামান্য চিরে নিয়ে নুন হলুদ মাখিয়ে তেলে ভেজে তুলে রাখলাম। এবার অল্প পাঁচফোড়ন আর শুকনো লঙ্কা ফোড়ন দিয়ে ভালো করে ফেটানো টক দই, সামান্য সর্ষে,জিরে,লঙ্কা গুঁড়ো, নুন আর একটু বেশী মিষ্টি মিশিয়ে কষে জল ঢেলে দিলেই তুত্তুরীর প্রিয় দই পটল তৈরী। ফ্রেশ ক্রীম মেশালে স্বাদ আরও বাড়ে বটে, তবে আপাততঃ তাও বাড়ন্ত।
ভাবতে ভাবতেই অর্ধেক রান্না শেষ। ডাল আর পাঁপড় আগেই ভেজে রেখেছি। বেলা বাড়ছে, শুধু ভাত আর মাছটা করে নিলেই হল। আজ পাবদা এনেছে শৌভিক। পাবদা আমার শ্বশুর মশাইয়ের অন্যতম প্রিয়মাছ। আমাদের বাড়ির সব শুভকাজে পাবদা হবেই। আমাদের রেজিস্ট্রিতে এত্ত বড় পাবদা হয়েছিল যে ন্যাজামুড়ো সমেত একপ্লেটে ধরছিল না। পাবদা নাকি আমার দাদাশ্বশুরও খুব ভালোবাসতেন। একবার খেতে বসে সে কথা বলতে বলতে ছলছলিয়ে উঠেছিল শ্বশুরমশাইয়ের দুই চোখ। “ তখন তো আর এত বড় বড় পাবদা পাওয়া যেত না, ছোট ছোট মাছ, তাও কদাচিৎ পাওয়া যেত শালকিয়া বাজারে। তখন তো আর এত প্রাচুর্য ছিল না, বড় পরিবার। আর লোকও আসত কত। বাঙাল বাড়িতে চুলা নিভতই না আমাদের ছোটবেলায়-। ” বলতে বলতে থেমে গিয়েছিলেন শ্বশুরমশাই। আঙুল দিয়ে এঁটো থালায় কি যে আঁকিবুকি কাটলেন খানিকক্ষণ, তারপর ঢোঁক গিলে বললেন,“ হলেও ঐ হয়তো মাথাপিছু একটি করে। তবুও যেদিন পাবদা হত, কি যে পরিতৃপ্তি করে ভাত খেত বাবা-”।
আমি অবশ্য ঘটি বাড়ির মেয়ে। কেন জানি না, ধারণা ছিল,পাবদা শুধু বাঙালরা খায়। খেতে মন্দ নয়, তবে ঐ আর কি, ফিরিঙ্গী ভাষায় একটু ওভারহাইপড্। বলাইবাহুল্য রাঁধতেও জানতাম না। এবাড়িতে অবশ্য কোন মাছ রাঁধতে না জানলেই কোন সমস্যা নেই, এরা গুষ্টিসুদ্ধু কালোজিরে কাঁচালঙ্কার ভক্ত। তবে সুকন্যা বলেছিল পাবদা ভীষণ ফাটে, একহাতে খুন্তি আর একহাতে ঢাল নিয়ে রান্না করতে হয়। তাই হয়তো করতাম, যদি না এক বয়ঃজ্যেষ্ঠ সহকর্মী এক টোটকা না শেখাতেন। বেশ বনেদী রইস আদমি ছিলেন ভদ্রলোক। মানুষকে রেঁধে খাওয়াতে বড় ভালোবাসতেন। ছুঁতোনাতা পেলেই অফিসে চাঁদা তুলে মহাভোজ আয়োজন করতেন। চাঁদা তো উঠত কচু, আমরা কজনই দিতাম বাকি উনি লুকিয়ে গাঁটগচ্ছা দিতেন। জানাজানি হবার পর ভুরিভোজ উঠেই গেল অফিসটা থেকে। কিন্তু উনি যে ন্যাড়া থুড়ি ওণার মাথাভর্তি চকচকে টাক, তাই উনি ঘুরেফিরে ঠিক বেলতলা আবিষ্কার করেই ফেলেছিলেন। বড় টিফিন ক্যারিয়ারে করে রেঁধে আনতেন চব্য-চোষ্য-লেহ্য। হয়তো পেয়ও থাকত,তবে সে ব্যাপারে কেউ আমার সামনে মুখ খুলত না। উনি কোনদিন পনীর রেঁধে আনতেন তো কোনদিন খাসির মাংস। রেসিপি জিজ্ঞাসা করলেই বলতেন, “কি খাবেন বলুন না। করে আনব।”
শুধু যে খাওয়াতেন তাই নয়, রান্নার তরিকাও শেখাতেন। ততোদিনে তুত্তুরী হামা টানছে, কিন্তু ওণার ধারণা ছিল আমি রান্নাবান্না কিছুই পারি না। সবই শেখাতেন, তারপর বলতেন, “খুব সাবধানে কিন্তু। আমার বড় মেয়ে আপনার থেকেও বড়, তার ঐটা রাঁধতে গিয়ে হাত পুড়ে এত্ত বড় ফোস্কা পড়ে গিয়েছে জানেন। ” মাংস রান্নায় কাবাবচিনির ব্যবহার উনিই শিখিয়েছিলেন। আর শিখিয়েছিলেন, কাঁচা পাবদা মাছের গা যদি ছুরি দিয়ে সামান্য চিরে দেওয়া হয়, তাহলে গরম তেলে দিলেও তা আর ফাটে না।
পাবদা মাছ রাঁধতে গেলেই প্রতিবার ওণার কথা মনে পড়ে যায়। ছুরি দিয়ে পাবদার পেট ফাঁসাচ্ছি, হঠাৎ দেখি মুঠোফোনে ওণারই নাম ফুটে উঠেছে। একি রে বাবা! দীর্ঘদিন ওণার সাথে যোগাযোগ নেই। আমি থাকতে থাকতেই উনি অবসর নিয়েছিলেন, তারপরও বছর খানেক যোগাযোগ ছিল। প্রায়ই হুমকি দিতেন আমার ডায়েট নষ্ট করতে আসছেন- তারপর আর কোন যোগাযোগ নেই। দৃষ্টির আড়াল,মনের আড়ালের অজুহাতে হয়তো যোগাযোগের চেষ্টাও করিনি আমি। ভেবেছি নম্বর বদলে গেছে হয়তো। ফোন পেয়েও বিশ্বাস হচ্ছিল না, ভয়ে ভয়ে হ্যালো বলতেই, ওপার থেকে ওণার দরাজ গলা- “শুভবিজয়া”। গ্যাস অফ করে, পাবদায় চাপা দিয়ে, অভিমানী বরের গায়ে হেলান দিয়ে অনেক গল্প হল। অনেককিছুই জানতাম না। জানতাম না ওণার দুলালী দৌহিত্রী, আক্রান্ত হয়েছিল মারণ ব্যাধিতে। বছর দুয়েক আগে মারা গেছে মেয়েটি। সেই শোককে কবর দিয়ে উনি ব্যস্ত নিজকন্যার শোক দূরীকরণে। বছর পঞ্চাশ বয়স হয়েছে মেয়েটির। আর সন্তানধারণের কোন সম্ভবনা নেই। একমাত্র সন্তানের মৃত্যুতে পাথরের মত হয়ে গেছে সে। বৃদ্ধ চেষ্টা করছেন, যদি দত্তক নিয়েও কোন শিশুকে তুলে দেওয়া যায় সন্তানহারা মায়ের ক্রোড়ে। কিন্তু সেখানেও বারবার ব্যর্থ মনোরথ হচ্ছেন ওণারা।
কয়েক পর্দা নেমে গিয়েছিল ওণার কণ্ঠস্বর, আবার চনমনিয়ে উঠল, “একবার আসুন। কর্তামশাই, মেয়েকে নিয়ে। অমুক-অমুককেও ডাকব। যে চলে গেছে তার জন্য আর মনখারাপ করে কি করব বলুন? বড় ভালো ছিল মেয়েটা। জানেন তো, আর কেউ না চিনলেও আমি চিনতে পেরেছিলাম, ও আসলে আমার স্ত্রী ছিল। ঐ ফিরে এসেছিল জন্মান্তরে। নইলে আমায় এতো কেন ভালোবাসবে বলুন তো? আর এভাবেই বা কেন শেষবয়সে ফেলে চলে যাবে? শাস্তি দিতে এসেছিল,বুঝলেন কিনা। ” ওণার শেষ কথা গুলো ফোন রেখে দেবার পরও অনেকক্ষণ বাতাসে ঘুরছিল। অফিসে কানাঘুষো শুনেছিলাম বটে, যৌবনে জনৈকা মহিলা সহকর্মীর সাথে ওণার বিবাহ বহির্ভূত প্রণয় এবং তদজনিত ওণার স্ত্রীর মনোবেদনার দাস্তান। মানসিক অবসাদে ভুগে ভুগেই নাকি একদিন টুপ করে ঝরে গিয়েছিলেন প্রৌঢ়া। তবে এই শাস্তি বোধহয় তিনিও কামনা করেননি।
No comments:
Post a Comment