অনির ডাইরি, ৩রা অক্টোবর, ২০২০
এক ঝলক দেখে মনে হবে আটচালা হিন্দু মন্দির বুঝি। চুনকামের ফাঁকফোকর গলে এখনও বেরিয়ে আসে টুকটাক পোড়া মাটির ভাস্কর্য। নাম- হেনরী মার্টিনের প্যাগোডা।
শ্রীরামপুরে গঙ্গার ধারে, বড় বড় মহীরুহ আর সদ্য বর্ষার বেয়াড়া ঝোপজঙ্গলের মাঝে নিরালা নিঃসঙ্গ চুনকাম করা এক প্যাগোডা, আর কয়েকশ বছরের নীরব ইতিহাস। অন্তর্জাল ঘাঁটলে শোনা যায় নানা কিস্যা। শোনা যায় জনৈক রুদ্ররামের আখ্যান। সে অনেককাল আগের কথা, ষোড়শ শতক। দিল্লীর দখল নিয়ে তখনও লড়াই করেই চলেছেন বাদশা হুমায়ুন। বাংলায় তখন নড়বড়ে সুলতানী শাসন। ঘাড়ের উপর নিঃশ্বাস ফেলছেন এক দোর্দণ্ডপ্রতাপ পাঠান, নাম, শের শাহ সুরী। এই জটিল রাজনৈতিক দাবাখেলা থেকে বহুদূর তৎকালীন শ্রীরামপুরের চাটরা অঞ্চলে মাতুলালয়ে বড় হয়ে উঠছিলেন বাবু রুদ্ররাম। সাংসারিক জটিলতা থেকে বহুদূর, পবিত্র গঙ্গা কিণারে, গভীর জঙ্গলের হৃদপিণ্ডে, নির্জনে ধ্যানে বসেছিলেন বাবু রুদ্ররাম। ধ্যানমগ্ন অবস্থাতেই দর্শন পেলেন, তাঁর। কৃষ্ণবর্ণ, অনুপম রূপবান বংশীধারী অনুরোধ করলেন একটি মন্দির স্থাপনের জন্য। কিন্তু কোথায় গড়ে উঠবে এই মন্দির? কেন, যেখানে ধ্যানে বসেছেন রুদ্ররাম। কালে কালে ঐ অঞ্চলই তো খ্যাত হবে বল্লভপুর নামে। শুধু মন্দির স্থাপন করলে হবে না, নির্দেশ এল, মন্দিরের অধিষ্ঠাতা দেবতার মূর্তি তৈরী করতে হবে, এক বিশেষ কষ্টিপাথর দিয়ে। আর সেই কষ্টিপাথর আনতে হবে,সুদূর গৌড় নগরী হতে। জনৈক যবন শাসকের অট্টালিকার সিংহদুয়ারের মাথা থেকে খুলে। গৌড় তখন সুলতানী বাংলার রাজধানী, এতো রীতিমত বাঘের গলায় ঘন্টা বাঁধার কাজ-
তবুও রওণা দিলেন রুদ্ররাম, সম্বল বলতে শ্রীধরের প্রতি অকৃত্রিম বিশ্বাস আর অগাধ প্রেম। গৌড় নগরী পৌঁছে অবিশ্বাস্য ভাবে আলাপ হল, ঐ শাসকের প্রধান অমাত্যের সাথে। যিনি আবার ধর্মে ছিলেন হিন্দু। রাধামাধবের নির্দেশ অমান্য করার ক্ষমতা তাঁরও ছিল না। বাকি গল্পের ওপর পড়েছে ইতিহাসের ধুলো। কিভাবে যে কয়েকমণ ওজনের কষ্টি পাথর খোলা হল, সিংহদুয়ার থেকে, আর কিভাবে যে তা এসে পৌঁছাল সুদূর দক্ষিণবঙ্গের এক অনামা ঘাটে তা সম্পূর্ণ রহস্যাবৃত। শোনা যায় গঙ্গা নদী স্বয়ং ভাসিয়ে আনেন প্রস্তরখণ্ড খানি। বল্লভপুর ঘাটে এসে আটকে যায় পাথর। অতঃপর ঐ পাথর থেকে তৈরী করা হয় রাধাবল্লভের মূর্তি। গড়ে ওঠে আটচালা মন্দির।
অতঃপর কেটে যায় আরো এক শতক। হিন্দুস্তানে এসে পৌঁছয় শ্বেতাঙ্গ বণিকের দল। প্রথমে দক্ষিণ, পরে পশ্চিম হয়ে, পূব উপকুলেও এসে পৌঁছয় পালতোলা জাহাজের সারি। গঙ্গার খাত বরাবর কেউ আস্তানা গড়ে তোলে কলিকাতায়, কেউ বা চন্দননগরে, কেউ আবার চুঁচুড়া বা শ্রীরামপুরে। গড়ে ওঠে বিভিন্ন দেশীয় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী। মৃত্যুর অব্যবহিত পূর্বে, ড্যানিশ ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানিকে বাংলায় বাণিজ্য করার অনুমোদন তথা ফরমান দিয়ে যান নবাব আলিবর্দী খাঁ। সন ১৭৫৫। অচীরেই শ্রীরামপুরে গড়ে ওঠে ড্যানিশ উপনিবেশ। আসে ক্রিশ্চান মিশনারির দল।
ইতিমধ্যে ঘটে গেছে অনেককিছু, বিপজ্জনক ভাবে এগিয়ে আসা গঙ্গানদী এবং যবন স্পর্শ বাঁচিয়ে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে রাধাবল্লভকে।
পরিত্যক্ত মন্দির সংলগ্ন অঞ্চল দখল করে গড়ে উঠেছে এক অনুপম বাংলো প্যাটার্নের বাড়ি। যার পোশাকী নাম অলড্রিন(নাকি অলডিন) হাউস। ১৮০৩ সালে কলকাতার ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের প্রোভস্ট রেভারেণ্ড ডেভিড ব্রাউন কিনে কেন মন্দির সংলগ্ন এই বিশাল চত্বর। বছর তিনেক পর, শ্রীরামপুরে এসে উপস্থিত হন, হেনরী মার্টিন নামক জনৈক ধর্মযাজক। তিনি হ্যামলেটের দেশের বাসিন্দা নন। জাতে আগমার্কা বৃটিশ। শ্রীরামপুরে পৌঁছে স্বদেশীয় ব্রাউন সাহেবের কাছে প্রার্থনা করলেন আশ্রয়। বাংলোর নিকটবর্তী পোড়ো মন্দিরে ঠাঁই হল তাঁর। পরিত্যক্ত মন্দিরটিকে প্যাগোডা বলে পরিচয় করানো হয় ওণার সাথে। রাতের অন্ধকারে, নদীর তীরে নির্জন প্যগোডায় থাকতে প্রথম দিকে বেশ ভয়ই পেয়েছিলেন মার্টিন, ওণার ভাষায়, “ My habitation assigned to me by Mr. B, is a pagoda in his grounds, on the edge of the river. Thither i retired at night and really felt something like superstitious dread, at being in a place once inhabited as it were by devils.” ডেভিল অর্থাৎ রাধামাধব। ধীরে ধীরে এই প্যাগোডাতেই গড়ে ওঠে ওণার পাকাপাকি আস্তানা। নিয়ে আসেন অর্গান। জমায়েত হতে থাকেন অন্যান্য মিশনারীরা। লোকশ্রুতি যে ভারতবর্ষের প্রথম ধর্মান্তর এখানেই সংঘটিত হয়। খ্রীষ্ট ধর্মমতে বিবাহও সংঘটিত হয়েছে এই প্যাগোডায়।
তারপর যা হয়, আবার ছড়ি ঘোরায় ইতিহাস। কানপুরের উদ্দেশ্য রওণা দেন হেনরী মার্টিন। ১৮১২ সালে মারা যান ব্রাউন সাহেবও। পুনরায় পরিত্যক্ত হয়ে পড়ে অলডিন হাউস এবং হেনরী মার্টিনের প্যাগোডা। ১৮৪৫সাল নাগাদ এই মন্দির থেকে রূপান্তরিত চার্চটিতে গড়ে ওঠে মদের কারখানা। যার পোশাকী নাম ছিল প্যাগোডা রাম ডিসটিলারি। ১৮৯৩এ আবার ভোল বদল, এবার সমগ্র চত্বর দখল করে হাওড়া ওয়াটার ওয়ার্কস্। গড়ে ওঠে বিশাল বিশাল জলাধার। ভূতের বাড়ি হয়ে পড়ে থাকে অলডিন হাউস আর হেনরী মার্টিনের সাধের প্যাগোডা।
হাওড়া ওয়াটার ওয়ার্কসের জলাধারের পাশ দিয়ে, এবড়োখেবড়ো মেঠো রাস্তা দিয়ে জঙ্গলের ভিতর ঢুকে দর্শন মেলে এই জনহীন প্যাগোডার। বড় মনোরম পরিবেশ। শুধু যদি যান, একটু সচেতন থাকবেন, কিছুদিন আগেই একটি চন্দ্রবোড়া সাপের হদিশ পাওয়া গিয়েছিল এই তল্লাটে। তিনি আপাততঃ বনদপ্তরের অতিথি, তবে তাঁর আত্মীয়স্বজন- পাড়াপ্রতিবেশী তো থাকতেই পারে। ©অনিশৌভিক
একনজরে অলডিন হাউস, শ্রীরামপুর
অলডিন হাউস, ক্লোজ আপ
No comments:
Post a Comment