Thursday 8 October 2020

অনির ডাইরি ৮ই অক্টোবর, ২০২০


কত মত। কত পথ। কত জ্ঞান- পাল্টা জ্ঞান। সমালোচনা। বাদ-বিবাদ। ছিছিক্কার। এইসব কিছু থেকে অনেক অনেক দূরে বাস করে মানু। জানেন মানু কিন্তু বাঙালী নয়,মারাঠি মুল্গি। যদিও বললে মানু হেসে গড়াগড়ি যেত। বলত, "আমি মুল্গি নই গো ম্যাডাম দিদি। মুল্গি হল কচি। ডবকা মেয়ে। আমার বয়স কত জানো? দুই কুড়ি পাঁচ। ” তারপরই বলত, "কিছু নেবে নাকি? নাও না। আসল সোনার বাউটি আছে, বালা আছে, চুড়ি আছে, পলা আছে। ” এই বলেই চিৎকার করত মানু। আসল ল্যাকমে কোম্পানির  গয়না বেচত বলে মানুর মাটিতে পা পড়ত না। আরেঃ এ ল্যাকমে ঐ দামী কসমেটিক ব্রাণ্ড নয়, যার মুখপাত্র তৈমুরের মা। এ হল লোকাল ট্রেনের লোকাল ব্রাণ্ড। তো যা বলছিলাম, এক বাঙালী ছেলের সাথে পালিয়ে বঙ্গদেশে পা দিয়েছিল মানু। এইসব গল্পে যা হয় আরকি। দেশে এসে দেখে ঘরে জাজ্বল্যমান সতীন। মানুর গর্ভে তখন তিলে তিলে বাড়ছে লক্ষ্মী। এই নামই দিয়েছে মানু তার মেয়ের। মেয়ে নিয়ে আলাদাই থাকে মানু। শিয়ালদা মেন লাইনের ট্রেনে হকারী করে চলে যায় দুটো প্রাণ। থুড়ি চলে যেত। পুজো আসার মাস দুয়েক আগে থেকে হুহু করে বিক্রি বেড়ে যেত মানুর। অনেক অনেক টাকার গয়নাগাটি মুখ দেখে দিয়ে দিত মানু। পয়সা পরে বা কিস্তিতে দিলেও চলত। একবার এই করতে গিয়ে এক মহিলা ৫০০টাকার জিনিস নিয়ে আর পয়সা না দিয়েই কেটে পড়েছিল। সেই দুঃখের গল্প শুনে খুব ধমকেছিলাম গত বছর। আবার অনেক সময় অনেক মহিলা যাত্রী এমনিই দু-পাঁচশ টাকা দিয়ে দিত মানুর হাতে। “মিষ্টি খাস মানু।” অথবা “পুজোয় অন্তত একটা নতুন শাড়ি কিনিস মানু।” এবছর কি করে সংসার চলছে মানুর কে জানে? কি খাচ্ছে মা-মেয়েতে? 

সুদেব গুড়বাদাম বিক্রি করত ট্রেনে। লেডিজেই বেশী ছিল খরিদ্দার। জন্মান্ধ সুদেব হকারী করতে গিয়ে ট্রেন থেকে পড়ে কব্জি থেকে হারিয়েছে বাঁ হাত। তবুও ছাড়েনি হকারী। বিগত সাড়ে তিনবছর ধরে, দেখে আসছি, আজ অবধি নিজের অবস্থার কথা বলে কোন সহানুভূতি চায় না সুদেব। আমার দেখা সবথেকে পজিটিভ মানুষ। কতই বা বয়স? বছর চল্লিশ অথবা আরো কম। দীর্ঘ ক্ষয়াটে চেহারা। একদিন ফাঁকা ট্রেনের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে বলেছিল, ‘যতদিন গতর চলবে, খেটে খাব দিদি। অন্ধ বলেই কি হাত পাততে হবে বলুন?’ জীবনিশক্তির এমন জলচ্ছবি কেমন আছে কে জানে? আছে কিনা তাই বা কে জানে।লকডাউন আর কোভিড আতঙ্কের মধ্যেই দক্ষিণ এশিয়া আর আফ্রিকার প্রায় তিন কোটি মানুষ অর্ধাহার বা অনাহার জনিত কারণে অপুষ্টি-আক্রান্ত। এটাও মাস খানেক আগেকার তথ্য। এখন হয়তো আরো বেড়েছে। প্রসঙ্গতঃ খাদ্যের কিন্তু অভাব নেই। অভাব সুষ্ঠ বিলিবন্টনের। সৌজন্য- অবশ্যই কোভিড। শ্রীলেদার্সের ভিড় নিয়ে জম্পেশ একটা পোস্ট দিয়েছেন তো? 


তনিমা একজন আধাসরকারী কর্মচারী। অন্তত তনি তাই মনে করে। চুপি বলি, আসলে তনি পাতি এজেন্ট। যেমন যেমন কাজ করে বদলে কমিশন পায়। তনির একটা পুঁচকে ছানা আছে। লকডাউনের মধ্যেই হারিয়ে গেছে তার অনেকগুলো ভ্যাকসিনের ডেট। তনি পারেনি ছানাটাকে ইঞ্জেকশন দেওয়াতে। লকডাউনে বন্ধ ছিল ওর বরের কারখানা।বন্ধ ছিল তনির আপিসও। মাঝে এমন একটা দিন এল, যখন গোটা বাড়ি খুঁজেও একটা টাকা বার করতে পারেনি কর্তাগিন্নীতে। এখন হাঁড়ি চড়ছে কোনমতে। ওসব ভ্যাকসিন-ট্যাকসিনের কথা চিন্তাও করতে পারছে না ওরা। শুধু ওরা নয়, আফ্রিকা আর দক্ষিণ এশিয়ায় প্রায় দেড় কোটি বাচ্ছা পায়নি কোন ইম্যুনাইজেশন। এই বাচ্ছাগুলো পরে বড় হয়ে কোন ব্যাধিতে আক্রান্ত হবে কে জানে? আপাততঃ ওদের বাবা-মাও হয়তো তনিদের মতোই ভাবছে,  দেখা হলেই যেমন প্রশ্ন করে তনি, “আবার লকডাউন হবে না তো ম্যাডাম? না খেয়ে মরে যাব এবার।” 


আর আমার সেই বান্ধবী, যার বাড়িতে ঘটে গেছে এক মর্মান্তিক দুর্ঘটনা। তীব্র শোকের মধ্যেও  হেসে উঠেছিল সে, “অনি রে যখন পুলিশ এল,কি ভিড় প্রতিবেশীদের। সবাই ভিড় করে কেচ্ছা দেখতে এসেছে বুঝলি। আর মেজোবাবু যখন বললেন, “কেউ একটু আসুন। বডিটা নামাতে হবে”। তখন কেউ এল না জানিস। কেউ না। এত করোণার ভয় মানুষের অনি?  আমার বৃদ্ধ অসহায় বাবা, যে কিনা সক্কাল সক্কাল আবিষ্কার করেছে তার মৃত পুত্রের দেহ, আমার নার্ভাস হয়ে বসে পড়া বর আর আমি ছাড়া কেউ ছিল না অনি। আমি। আমি। আমি নামালাম জানিস। তারপর থেকে আর চোখ বোজাতে পারছি না। চোখ বুজলেই, চোখে ভেসে উঠছে ঐ দৃশ্য। ” মাত্র চারজনের কথা লিখলাম। শ্রমদপ্তরে চাকরী করি, সপরিবারে জয় করেছি কোভিডকে এরকম আরো চল্লিশজনের উদাহরণ দিতে পারি, যাদের জীবন তছনছ করে দিয়েছে এই ব্যাধি। নাঃ এরা কেউ আক্রান্ত হয়নি। আক্রান্ত হয়েছে এই সমাজ। ভয় যদি পান, বাড়িতে বসে থাকুন। আপনি ভাগ্যবান, বাড়িতে বসে সোশাল মিডিয়ায় বিপ্লব করছেন। কিন্তু সবাই এত ভাগ্যবান নয়। আর এদের গরিষ্ঠাংশেরই কোন সোশাল মিডিয়া অ্যাকাউন্ট নেই, যে বিরুদ্ধ মতটাও আপনার গোচরে আনবে। আপনি বেঁচে থাকুন। আমাদের মত খেটেখাওয়া মানুষগুলোকেও একটু বাঁচতে দিন। করোনায় না মরলেও অর্ধাহারে অনাহারে মরেই যাবে হয়তো।

No comments:

Post a Comment