আজকের সকালটা বড় মনোরম। অক্টোবর পড়েই গেছে, ভোরের বাতাসে লেগেছে হাল্কা হিমেল একটা আমেজ। মায়ের আসছেন, আর তো কটা দিন। আকাশে-মেঘে-রোদে সর্বত্র খুশির গন্ধ। শুধু গুটি কয়েক মিটিং সালটে দিতে পারলেই, মাঝারি লম্বা একটা সপ্তাহান্ত।
মিটিংগুলোও বড় ভুলভাল। প্রথম কেসটিতে যাঁকে নিয়ে মিটিং তিনি অ্যাসিস্টান্ট ম্যানেজারের পদে কর্মরত ছিলেন। লাখ বারো টাকা তহবিল তছরুপের অভিযোগে খুইয়েছেন চাকরীখানা। ভালো করে বুঝিয়েছিলাম, ম্যানেজার পদাধিকারীদের পাশে দাঁড়ানোর এক্তিয়ার নেই আমার। শ্রম দপ্তর তথা শ্রম আইন শুধুই শ্রমিকদের জন্য। তহবিল তছরুপ নিয়ে কিছু বলিনি,কারণ নীতি পুলিশগিরিটা আমার কর্তব্যের মধ্যে পড়ে না।
ভদ্রলোক সেই শুনে এমন কান্নাকাটি জুড়লেন কি বলি। মহিলাদের অশ্রু তাও হজম হয়, পূর্ণ বয়সী পুরুষের চোখের জল সহ্য করা বেশ দুষ্কর। ওণার বক্তব্য আমার অপরিচিত নয়, ‘নামেই অমন ম্যানজার ম্যাডাম। বেতন কত দিত শুনবেন?’ ভুল কিছু বলেননি,বেতন যেকোন সিকিউরিটি গার্ডের থেকে ইতরবিশেষ। ওণার পোশাকপরিচ্ছদও সোচ্চারে তাই ঘোষণা করে। তহবিল তছরুপ নিয়েও উনি অনড়, “আমি এট্টা নয়া পয়সাও চুরি করিনি দিদি। ’ এরা যখন কান্নাকাটি জোড়ে, তখন হঠাৎ ম্যাডাম থেকে দিদি হয়ে যাই-এটা আগেও দেখেছি।
কিছু করতে পারব না, হাতপা বাঁধা বললেও যদি কমলি না ছাড়ে, তখন বাধ্য হয়েই মাথা গলাতে হয়। ইনি আবার আত্মঘাতী হবার ভয় দেখালেন। কাগজপত্র ঘাঁটতে গিয়ে দেখলাম, লকডাউনের আগে একটা মোটা অঙ্কের টাকার চেক ওণাকে দেওয়া হয় ব্যাঙ্কে জমা করার জন্য। ব্যাঙ্কে ঐ সময় অসম্ভব ভিড় আর চাপ। উনি চেকটা জমা করে চলে আসেন।
মাসখানেক পর যখন প্রথম আনলক ডাউন হয়, আপিসে গিয়ে দেখেন টাকাটা ওনার ব্যক্তিগত অ্যাকাউন্টে ঢুকে বসে আছে। তৎক্ষণাৎ ব্যাঙ্কে দৌড়ে চিল্লাচিল্লি করে টাকাটা আবার আপিসের অ্যাকাউন্টে ঢোকানোর ব্যবস্থা করেন উনি। দুটি অ্যাকাউন্ট একই ব্যাঙ্ক তথা ব্রাঞ্চে। ফলে অসুবিধা হয়নি। টাকাপয়সা যথাস্থানে পাঠিয়ে যখন উনি দপ্তরকে জানাতে গেলেন তখনই বাঁধল গোল। এতদিন এসব কেউ জানতও না। খোঁজও করেনি। জানার সাথে সাথেই শোকজ এবং পরদিন টার্মিনেশন। তাজ্জব ব্যাপার, এতো ঠাকুমার ভাষায়, ‘কলিযুগে উপকারীকে বাঘে খায়’ কেস। সবথেকে বড় প্রশ্ন যেটা একটা সরকারী ব্যাঙ্ক এমন কেলো করল কি করে? চেক ক্রশ করা ছিল না? কার নাম ছিল চেকে? চেকের ফটোকপিতে লেখা দেখলাম,‘ সেল্ফ’। সই করেছেন প্রেসিডেন্ট এবং সেক্রেটারি। তো সেই চেক আপনার অ্যাকাউন্টে ঢোকাল কেন? শুনলাম ব্যাঙ্ক ম্যানেজার ইতিমধ্যে বদলী হয়ে গেছেন। তবে এর আগেও এইরকম দপ্তরী টাকাপয়সা ভদ্রলোকের অ্যাকাউন্টে ঢুকেছে এবং তা ওণার দপ্তরের অনুমোদন সহ। অনুমোদন পত্রের ফটোকপি দেখালেন, যেখানে লেখা আছে, ইব্যাঙ্কিং ইত্যাদির জন্য ওণার অ্যাকাউন্ট দপ্তরী কাজে ব্যবহার করা যাবে।
গুপি কেস মাইরি। সবকাগজ ঘাঁটলে বোঝাই যায়, টাকা চুরি হয়নি, পাইপয়সা ঢুকেছে যথাস্থানে। সেই টাকা থেকে ওণার দপ্তর খরচাও করছে দেদার, অথচ লোকটাকে চোর অপবাদ দিয়ে বিতাড়ন করে বসে আছে। এমন কেসে তো হস্তক্ষেপ করতেই হয়।
এইসব কেসে সাধারণত চিঠি পাঠিয়ে বিপক্ষের বক্তব্য জেনে তবেই ত্রিপাক্ষিক মিটিং ডাকা হয়। লোকটার আর্থিক তথা মানসিক যাতনা দেখে সোজা ত্রিপাক্ষিক মিটিং ডেকে বসে আছি। পোস্টাফিসের মাধ্যমে চিঠি পাঠালে পাছে দেরীতে পায় বা ঐ অজুহাত দেখায়, আমাদের শান্তনু স্বয়ং গিয়ে দিয়ে এসেছে মিটিং এর শমন।
বাদী এসেছে যথাসময়ে, বিবাদী বলতে এসেছেন এক বয়স্ক ব্যক্তি। শুনলাম তিনিই নাকি প্রেসিডেন্ট। তাঁর পোশাক পরিচ্ছদ হাবভাব সবই অবসর প্রাপ্ত শিক্ষকদের মত। পরিচয় দেবার সাথে সাথে বুঝলাম আমার অনুমান অব্যর্থ। এবার চেপে ধরতে সুবিধে হল। ‘কি মশাই, আপনি সরকারী লোক হয়ে, তুচ্ছ অভিযোগে একটা ছেলের চাকরী খেয়ে নিলেন? তাও আবার চুরির বদনাম দিয়ে? আমি হলে তো সর্বাগ্রে মানহানির মামলা ঠুকতাম। চুরির দায়ে তাড়ালেন, অথচ পুলিশকে জানালেন না? ব্যাঙ্ককে কিছু বললেন না। আর যে পাইপয়সা ফিরিয়ে দিয়ে ব্যাপারটা আপনাদের দৃষ্টিগোচর করল, তাকে দিলেন ভাগিয়ে? বেশ মজা না?’ উনি থতমত খেয়ে জানালেন, ‘আমি জানি ম্যাডাম। চূড়িন্ত অন্যায় হয়েছে ওর সাথে। আমি প্রতিবাদ করেছিলুম। এইভাবে রাতারাতি কাউকে ছাঁটাই করা যায় না। কেউ কর্ণপাত করলে না। আসলে দলাদলি-’।
অ্যাঁ? দল? তুমি কোন দল করো ভাই? গ্রামের দিকে দলাদলি এসে গেলেই তো কেস জণ্ডিস। উভয়েই আশ্বস্ত করলেন না, তেমন কোন ব্যাপার নয়। সবাই একই দল,তবে ঐ গোষ্ঠিবাজি একটু আধটু আর কি। বললাম, তাহলে লিখে দিন, ওর ছাঁটাই অনৈতিক। আপনি চান ও চাকরী ফিরে পাক। বৃদ্ধ দেখলাম সটান পেন বার করে প্রস্তুত। আহাঃ প্রথম মিটিংটাই নির্বিঘ্নে মিটে গেল- যেই ভেবেছি, ম্যানেজারের চিঠি। তিনি সবিস্তারে লিখেছেন, যে পুরাতন বোর্ড আপাততঃ মুলতুবি। ফলে ঐ বোর্ডের নেওয়া সিদ্ধান্ত সম্পর্কে তাঁরা কিছু জানেন না। এব্যাপারে যদি কিছু করতেই হয়, তাহলে সংশ্লিষ্ট সরকারী অাধিকারির সঙ্গে যেন যোগাযোগ করা হয়।
আধিকারিক বসেন বিডিও আপিসে। তাঁর সাথে ফোনে যোগাযোগ করা হলে, তিনিও মানলেন যে অন্যায় হয়েছে। তাঁর রিপোর্টেও তিনি নাকি এটা লিখেছেন। সর্বোপরি, বাদীকে আমার কাছে পাঠানোর পিছনেও তিনিই আসল কলকাঠি নেড়েছেন। সে তো হল, এবার এর কি হবে? এর উত্তর আধিকারিকের কাছে নেই। তিনি জানালেন, জেলাস্তরীয় আধিকারিককে বলে যদি আমি কিছু করতে পারি। তিনি আবার পাশের বিল্ডিং এ বসেন।
বেশ তাই হোক তাহলে। সুকন্যার সাথে শলা করে, যুৎ করে চিঠি লিখলাম, সঙ্গে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র দিয়ে। গোটা গোটা করে লিখলাম, এই ভাবে পুশিলকে না জানিয়ে, একদিনের নোটিশে, কাউকে ছাঁটাই করা শুধু শ্রম আইনই নয়, বাদীর মৌলিক অধিকারেরও পরিপন্থী। অবিলম্বে যথোপযুক্ত ব্যবস্থা নিয়ে বাধিত করুন।
ধীমান চিঠি নিয়ে রওণা দেবার পর, ভদ্রলোককে বললাম, আমার দৌড় এখানেই শেষ। এবার আমার সমমর্যাদার অন্য দপ্তরীয় আধিকারিকের পালা। আশা করি তিনি আপনাকে নিরাশ করবেন না। যদি হয়, নির্ঘাত হবে, অবশ্যই আমাকে জানিয়ে যাবেন,কেমন?
এবার দ্বিতীয় মিটিং এর পালা। সূর্য মধ্যগগন ছেড়ে পশ্চিমাভিমুখী। এটা বোনাসের মিটিং। দুপক্ষই পূর্বপরিচিত। এর আগেও বিভিন্ন ইস্যুতে বেশ কয়েকবার মিটিং হয়েছে। শ্রমিকদের মুখপাত্র যিনি, ট্রেড ইউনিয়নের এক বয়ঃজেষ্ঠ্য সর্বজনশ্রদ্ধেয় নেতা, শুনলাম তিনি অসুস্থ। উনি থাকলে আমায় বিশেষ আর মুখ খুলতে হয় না। ভদ্রলোক রীতিমত সব্যসাচী। দুহাতে ব্যাট চালান। কখনও মালিককে ধমকান তো কখনও শ্রমিকদের। আজ তিনি নেই,মানে কপালে দুঃখ আছে।
আসতে বললাম, দুই পক্ষকে। একদল অচেনা লোক ঢুকে এল হুড়মুড় করে। আপনারা কারা মশাই? ট্রেড ইউনিয়নে কি নেতৃত্ব বদল হয়েছে? আমার সামনের চেয়ারে ধপ করে বসা স্থূলাঙ্গ ব্যক্তি নিজের পরিচয় দিতে বুঝলাম, এরা ঐ মিটিং এর সঙ্গে সম্পর্ক বহির্ভূত। ইনি স্থানীয় বড় রাজনৈতিক নেতা। আর সঙ্গের লোকগুলি প্যাণ্ডেল তথা ডেকরেশনের কাজ করে। অন্যান্য বছর এইসময় ঐ গ্রামগুলি পুরুষ বিবর্জিত থাকে। সবাই ছড়িয়ে পড়ে দূরদূরান্তে পুজোর কাজ করতে। এবারে কোন কাজ নেই। সংসার চলছে না। সপরিবারে আত্মঘাতী হবে সবাই, তাই আমাকে জানাতে এসেছে।
কি যন্ত্রণা। সবাই আত্মঘাতী হবার হুমকি এই অধমকেই দেয় কেন? কি চাই বাবাসকল? আমার প্যাণ্ডেল বাঁধানোর কোন ক্ষমতা নেই। টাকাপয়সা, চাল বা অনুদান দেবার মতও কোন সাধ্য নেই। একেবারেই অকর্মণ্য অধম আমি। ওণারা দেখলাম আমার এই অসহায় স্বীকারোক্তিতে বেশ সন্তুষ্ট হলেন। নেতা মশাই বললেন,‘ আপনি অন্তত আমাদের কথা তো শুনলেন। অমুক সাহেবের কাছে গেলুম, তিনি তো দেখাই করলেন না। জানেন?’ বেচারা অমুক সাহেব। তাঁর যে কত যন্ত্রণা, আমি তো বুঝি। আরো খানিক অনুযোগ শুনে, দুই বড় সাহেবের সরকারী নম্বর আর ইমেল আইডি দিয়ে তাঁদের রওণা করলাম। ওপরমহলে পৌঁছাক ওদের আর্তি। জানি আগামী দিনে এরকম আরো অনেক আবেদন আর্তি ভেসে আসবে। পুজো হলে রাজ্যটা কেরালা হয়ে যাবে, আর না হলে, মানুষ অভুক্ত হয়ে মরবে। এযেন ক্ষুরস্য ধারা।
এবার বোনাসের মিটিং এর পালা। দরাদরিটা আমার মোটেই আসে না, তবে তাই করতে হবে এখন। কত দেবেন? কত চাও? বারবার ঘুরিয়ে ফিরিয়ে এই প্রশ্ন করে যেতে হবে। যতক্ষণ না উভয়পক্ষ আসে একে অপরের কাছাকাছি। তখন দিতে হবে মোক্ষম চাপ। যা হবে আজকেই মিটিয়ে নিন আপনারা। ষষ্ঠীর দিন বিকালে এসে বোনাসের মিটিং যদি আমায় করতে হয়, তাহলে কারো রক্ষা নেই। অার যত তাড়াতাড়ি দেবেন বা পাবেন ততো জলদি যাবেন দোকানে। ভিড় জমে ওঠার আগেই কিনতে পারবেন বাচ্ছার জামা। বা বউয়ের শাড়ি। তারাও তো বসে আছে এই মিটিংএর দিকে তাকিয়ে। মিটিয়ে ফেলুন না মশাই, কেন ঝঞ্ঝাট পাকান আপনারা।
পুনশ্চ-ছবিতে মিটিং শেষে সকলে। ১৮ শতাংশ বোনাস পাবে শ্রমিকরা। উপকৃত হবে শতাধিক পরিবার। পুজো ইস্পেশাল খুশি বলতে তো এইটুকুই।তাই বা কম কি? নামধাম না হয় উহ্যই থাকুক।
No comments:
Post a Comment