“দাদু একটা গল্প বলো না।” “রোজ রোজ কি আর গল্প বানাব বলো তো? আচ্ছা আজ তোমাকে শম্ভু দার গল্প শোনাই। শম্ভু মিত্তির।”
“শম্ভু মিত্র? যিনি নাটক -”।
না না এ অন্য শম্ভু মিত্তির। তাহলে গোড়া থেকে বলি শোন। শম্ভুদার বাবা ছিলেন বৃটিশ আমলে পুলিশের বেশ বড় অফিসার। শম্ভুদারা তিন ভাই। বড় দুভাই পড়াশোনা শিখে বড় চাকরী পেলেও, শম্ভুদার আর লেখাপড়া করা হয়ে উঠল না। শম্ভুদার মাথায় ঢুকল বিপ্লব-”। “চ্যাটার্জী?” “ধ্যাৎ। এমন ফাজলামি মারলে কিন্তু আর গল্প বলব না। বিপ্লব মানে বিপ্লব। রেভোল্যুশন। দেশ সমাজ বদলে দেবার স্বপ্ন।”
“অ। তারপর?” “ তারপর আর কি? তারপর ঘোষিত হল নির্বাচন। পার্টি দাঁড়িয়ে গেল ভোটে-। বিপ্লব আর হল না। মাঝখান থেকে শম্ভুদাই পড়ে রইল অর্ধশিক্ষিত বেকার ভবঘুরে হয়ে। তখন শম্ভুদার দাদারা করল কি, একে তাকে ধরে, শম্ভুদাকে হোম-পলিটিক্যাল দপ্তরে একটা ড্রাইভারের চাকরী জুটিয়ে দিল। দিনে ড্রাইভারী করত- যাকেই দেখত, বাঁ হাত মুঠো করে বলত লাল সেলাম। আর ডিউটি শেষ হলে এক পেট মদ গিলে বাড়ি ফিরত। "
“মদ খেত? এ বাবা। ” “হ্যাঁ। তারপর শোনোই না। আমাদের সাথে যখন শম্ভুদার প্রথম দেখা, তখন আমরা ইছাপুরে একটা নাইটস্কুল চালাতাম। কোথা থেকে যেন শম্ভুদা জেনেছিল, আমার রাজনৈতিক পরিচয়-”
“রাজনৈতিক পরিচয় মানে কি, দাদু?” “মানে আমি কোন মন্ত্রে দীক্ষিত-”। “ তোমার দীক্ষা হয়েছিল নাকি? তোমার গুরু কে দাদু?”
“আমার কি আর একটা গুরু তুত্তুরী। আমার পাঁচ পাঁচখানা গুরু। তাদের নাম শুনতে চাও- মহান লেনিন,---”। “নাঃ থাক। পরে শুনব। গল্পটা বল।”
“ মোদ্দা কথা আমায় ভীষণ স্নেহ করত শম্ভুদা। শম্ভুদার ছেলের নাম ছিল করালী। তাকে আমাদের নাইট স্কুলে ভর্তি করিয়ে দিয়েছিল শম্ভুদা। স্কুল শেষে আমরা যখন বড়কর্তার চায়ের দোকানে আড্ডা জমাতাম, টলতে টলতে বাড়ি ফিরত শম্ভুদা। এক পেট মদ খেয়েও বসে পড়ত,আমাদের সাথে এক ভাঁড় চা খাবে বলে। এই চাটা আমাকেই খাওয়াতে হত, এটাই ছিল শম্ভুদার আব্দার। যেদিন শম্ভুদা এসে শুনত, যে করালী ক্লাশ করতে আসেনি, সেদিন কিন্তু আর চা খেত না। টলতে টলতে চলে যেত সোজা বাড়ি। শম্ভুদার খুব দুঃখ ছিল, লেখাপড়াটা করেনি বলে, প্রায়ই বলত, 'আমার ছেলেটাকে একটু লেখাপড়া শিখিয়ে মানুষ বানিয়ে দিও তোমরা", করালী নাইট ইস্কুলে আসেনি শুনলেই,তাই বাড়ি গিয়ে কি করত জান? সমস্ত জামাকাপড় খুলে ফেলে, খাটের তলা থেকে একটা মস্ত কাতান বার করে তাড়া করত ছেলেটাকে- আর চিৎকার করত, ‘কালীর বাচ্ছাটাকে আজ কেটেই ফেলব। ’ শম্ভুদার মায়ের হাউমাউ চিৎকারে কতবার আমরা দৌড়ে গেছি করালীকে বাঁচাতে তার ইয়ত্তা নেই। ”
“ হা-হা-হো- হো। কি বললে দাদু, নেন্টু হয়ে কাতান নিয়ে তাড়া করত-। আচ্ছা কালীর বাচ্ছা বলত কেন? ওটা তো শম্ভুর বাচ্ছা-”।
“সেই খানেই তো মজা। তাহলে তোমাকে শম্ভুদার বিয়ের গল্প শোনাতে হয়। তখন আমাদের এই নতুনরাস্তা- ইছাপুর-সৌম্যচণ্ডীতলা এই সব জায়গা ধুধু করছে ফাঁকা জলাভূমি। এই জলাভূমির মাঝেই ছিল ভটকার জঙ্গল। প্রায় ৭৫বিঘে ঘন জঙ্গল। রাত নামলে তো কথাই নেই, দিনের বেলাও লোকে ঐ জঙ্গলটা এড়িয়ে যেত। লোকে বলত ঐ জঙ্গলে পেত্নী থাকে। শম্ভুদা একপেট মদ খেয়ে রাতের বেলা ঐ জঙ্গলে ঘুরে বেড়াত। কেউ জিগ্যেস করলে বলত, ‘পেত্নী খুঁজছি। বে করব। পেত্নী ছাড়া আমায় আর কে বিয়ে করবে?’
একদিন হয়েছে কি, একটি মেয়ে মনের দুঃখে ঐ জঙ্গলে এসেছে গলায় দড়ি দেবে বলে। প্রগাঢ় আঁধারে, হঠাৎ বাবলা গাছের তলায় দুজনের দেখা। মাতাল শম্ভু ভাবল এই তো এট্টা পেত্নী পেয়েছি। সোজা মেয়েটাকে কাঁধে ফেলে দৌড়। পরদিন সকালে মায়ের বেনারসী পরিয়ে পাঠশালার মোড়ের মন্দিরে গিয়ে বিয়ে- বিয়ের পর বৌদির একটা ভালো নাম দেয় শম্ভুদা, তবে বিয়ের আগের নাম ছিল কালী। মদ খেলেই শম্ভুদা বৌকে কালী বলে সম্বোধন করত- আর চিৎকার করত, কালীর বাচ্ছাটাকে আজ কেটেই ফেলব”।
“কি বাজে লোক।” আরে না না মোটেই বাজে লোক নয়। খুব রঙীন লোক। শম্ভুদার যে এমন কত মজার মজার গল্প আছে-” ।
“দাদু জানো তো মদ খাওয়া মোটেই ভালো নয়। প্রথম প্রথম খেতে ভালোই লাগে। তারপর একদিন লিভারে পচন ধরে। তারপর একদিন মানুষ চোখ খুলে দেখে সে হাওয়ায় ভাসছে আর পিছনে একটা ভয়ানক দর্শন যমদূত দাঁড়িয়ে আছে। তার হাতে একটা ইয়া বড় ত্রিশূল। পক করে পিছনে খোঁচা মারে আর বলে, ‘এই মদ খাবি?’ লোকটা তো লোভে লোভে বলে, ‘হ্যাঁ হ্যাঁ। খাব। খাব’ অমনি কাঁটা চামচ দিয়ে চিলি ফিশ গাঁথার মত ত্রিশূল দিয়ে লোকটাকে গেঁথে ফুটন্ত তেলের কড়ায় চোবায় আর বলে,‘ খা। খা। আরো খাবি? আরো খাবি?’ আবার কখনও কখনও বলে, ‘এই পেন্টুল খোল’ লোকগুলো তখন ভয়ে ভয়ে বলে, ‘কেন যমদূত জী?’ আর যমদূত বলে, “জ্বলন্ত উনুনের ওপর বসতে হবে না?’ মরার পর তো আর কেউ মরতে পারে না দাদু।”
No comments:
Post a Comment