এর আগেও চাকরী ছেড়েছিল ছেলেটা। রাত সাড়ে আটটায় ফোন করে বলেছিল, মালিকের সাথে প্রচণ্ড ঝগড়া করে ফেরৎ দিয়ে এসেছে গাড়ি। কাল থেকে ও আর নেই। তখন সদ্য শুরু হয়েছে আনলক ডাউন, ৭৫শতাংশ স্টাফ নিয়ে গমগমিয়ে চলছে আপিস। পটাপট চাকরী হারাচ্ছে সাধারণ শ্রমিকের দল। আপিসে ডাকা গুচ্ছ গুচ্ছ মিটিং। সরকারী ফরমান একখান আছে বটে গুগল মিটে মেটাও সব মিটিং। গুগল মিটওয়ালা ফোনটার যে বড় অভাব আমার শ্রমিকদের মধ্যে। এদিকে বন্ধ লোকাল ট্রেন এবং নৈহাটি-চুঁচুড়া ফেরি। মাথায় আকাশ ভেঙে পড়েছিল সেদিন। কাল যাব কি করে অফিস?
শেষ পর্যন্ত অবশ্য সমস্যা হয়নি। আমাদের ইন্সপেক্টর কৌশিকের তাড়নায় গাড়ির মালিক অন্য ড্রাইভার জোগাড় করে সময়মতো পাঠিয়ে ছিলেন গাড়ি। দিনদুয়েক পরে আবার ফোন করেছিল ছেলেটি। ইনিয়েবিনিয়ে বলেছিল, খেপ খাটা ছাড়া তোমন কিছু পায়নি। বাজার খুব খারাপ ইত্যাদি। খোদ শ্রমদপ্তরে একজনের চাকরী যাবে ঐ আকালে, তাই দুপক্ষকে বসিয়ে আলোচনা করিয়ে মিটিয়ে দেওয়া হয় সেবার। নারাজ মালিক বলে যান, “আপনি বলছেন বলে শুধু ফেরৎ নিচ্ছি ওকে। ”
দিনদুয়েক আগে আবার সেই ফোন। এই মাসটা ডিউটি করে চাকরী ছেড়ে দেবে সে। চালাবে অন্য আধিকারিকের গাড়ি। বয়ান অনুসারে সেই মালিক নাকি দেবতুল্য। অনুরোধ করে, ঐ আধিকারিক যদি ফোন করেন আমি যেন দুচারটে ভালো কথা বলি ওর সম্বন্ধে। এ আর এমন কি কথা? যেখানে ভালো বেতন পাবে, পাগলেও সেখানে যাবে। আগাম নোটিশ দিয়ে কাজ ছাড়ায় কোন সমস্যা তো নেই।
গতকাল এমনিতেই খারাপ ছিল মনটা। কন্যার লালচে নাকের ডগা, ছলছল আঁখি আর ধরা গলা দেখে বেরোতে হয়েছে। শারদাকে পত্র লিখেছিল তুত্তুরী, লুকিয়ে। লিখেছিল অবুঝ নয় সে। আগত অতিমারি সম্পর্কে অতিসচেতন। তাই তো বেশী নয়, মাত্র দুটি ঠাকুর দেখতে চায় সে। প্রথমা বাগবাজারের বিশালাক্ষি আর দ্বিতীয়া হাওড়া সেবাসঙ্গের একচালা সাবেকী প্রতিমা। তুত্তুরী ডাকে মোটু দুর্গা বলে। আজও আসেনি সেই পত্রের জবাব। শোকাহত কন্যা, দেওয়াল-ফ্রীজ-আয়না ইত্যাদি জনে জনে প্রশ্ন করে বেড়াচ্ছে,“আমি কি ভুল লিখলাম? মা দুর্গা কি আমার চিঠি পড়তে পারেনি?খুব বানানভুল হল কি?”
যে নীলাম্বর আর কাঁচা সোনা রোদ অন্যান্য বছর জাগায় বাঁধনহীন পুলক, তারাই কেমন যেন হাতচাবুক চালাচ্ছে শপাশপ। তারই মাঝে বলল ছেলেটা, আজই শেষ, আমায় বাড়ি পৌঁছিয়ে গাড়ি মালিককে ফেরৎ দিয়ে আসবে ছেলেটি। মানে? কালই যে বললে, এই মাসটা শেষ হলে। রোদে ভেজা রাজপথ থেকে ভেসে আসে উত্তর, নতুন গাড়িটা নিয়ে একটু অভ্যস্ত তো হতে হবে।
পুজোর মুখে নতুন বিশ্বস্ত ড্রাইভার জোটানো অসম্ভব। রীতিমত বিপদে পড়ব আমরা। বিশেষতঃ আমি। রাত বাড়লে হাইরোডের জ্যাম সুপ্রসিদ্ধ। লরিতে লরিতে পলকে ছয়লাপ হয়ে যায়। বেশ কয়েকবার হয়েছে, জাস্ট ঘুমিয়ে পড়েছে গাড়ি। দুএক মিনিটের জন্য নয়, ঝাড়া আধ বা একঘন্টা। প্রগাঢ় আঁধার রাজপথে মৃতপ্রায় যানবনের সারির মাঝে ডিভাইডারে দাঁড়িয়ে হাওয়া খায় ড্রাইভার, আর নেটফ্লিক্স দেখি আমি। আর হয় টায়ার পাংচার। এই তো বিগত শুক্রবারেই, শেওড়াফুলির বিশাল পানিফলের ঝিলের ধারে, ঝপ করে দাঁড়িয়ে গেল গাড়ি। শাড়ি সামলে এক হাঁটু ধুলোয় নেমে মোবাইলের টর্চ জ্বালিয়ে ধরলাম, চাকা পাল্টালো ছেলেটা। নতুন কারো সাথে এই নির্ভরতার সম্পর্ক গড়ে উঠতেও তো লাগবে বেশ কিছুদিন। কবে যে চলবে লোকাল ট্রেন-। বেশ মনখারাপ হয়ে গেল, আইন আদালত সম্পর্কিত নানা সমস্যায় জেরবার ছিল ছেলেটি, গোটা চুঁচুড়া আপিস তখন দাঁড়িয়েছিল ওদের পাশে। বড় ভালোবেসে ফেলি আমরা মানুষকে। নাঃ ঠাকুমা ঠিকই বলত, কলিযুগে উপকারীকে বাঘে ধরে-।
মনখারাপী সুরের মাত্রা চড়েই আপিসে ঢুকলাম। উপহার হিসেবে পেলাম টেবিল আলো করা জনৈক উকিলবাবুর চিঠি। বেশ কিছুদিন আগে মিথ্যা তহবিল তছরুপের অভিযোগে চাকরী হারানো ব্যক্তির চাকরী ফিরে পাওয়া উচিৎ বলে চিঠি করেছিলাম অন্যদপ্তরে। যে ক্ষুদ্র প্রতিষ্ঠানে কাজ করত লোকটি, তাদের ম্যানেজারের উকিলবাবু রীতিমত ভয় দেখিয়ে চারপাতা চিঠি পাঠিয়েছেন। শেষের চারলাইনে খোলাখুলি হুমকি, ভবিষ্যতে যদি কেসে আমি নাকগলাই, তাহলে আমি শূর্পনখা হব এবং উনি লছমন। নাঃ কলিযুগে উপকারীকে সত্যিই দেখি-
মুস্কিল হচ্ছে ভয়টয় কাউকেই খুব একটা পাই না। হাইকোর্ট থেকে ইনফরমেশন কমিশন সবেতেই হাজিরা হয়ে গেছে,তবে রাগ তো হয়ই। এমন অভব্য ভাষার চিঠি পড়ে কি করা উচিৎ? যেটা করতে প্রচণ্ড ইচ্ছে করছে,সেটা বোধহয় বেআইনি হবে। আসন্ন পুজো উপলক্ষে বোনাস সংক্রান্ত ঝামেলা নিয়ে ব্যস্ত সবাই। কার সময় আছে কোন অবরবর্গীয় অফিসারের তুচ্ছ অভিযোগ(পড়তেই পারেন ঘ্যানঘ্যান) শোনার?
সম্বল বলতে তো সুকন্যা। দুজনে মিলে বেশ খানিকক্ষণ সমবেত গালিগালাজ করার পর খেয়াল হল, দুজন দুই ভিন্ন ব্যক্তিকে গাল পাড়ছি। সু ভেবেছে ঐ দপ্তরের আধিকারিক আমায় নাক গলাতে নিষেধ করেছেন বুঝি। তিনি তো আমার চিঠিকে বেদতুল্য জ্ঞান করে,বেশ খানিকটা কপিপেস্ট করে পাঠিয়েছেন লোকটিকে কাজে পুনর্বহাল করার জন্য। “ধ্যাৎ তাহলে পাত্তা দিচ্ছ কেন?” বলে ফোন কেটে দিল সুকন্যা।
বিকালে প্রৌঢ় মালিক এসে হাজির। গাড়ির মালিক। কৌশিক এসে বলল, “উনি এসেছেন একবার দেখা করে নিন ম্যাডাম। ” কোন মুখে দেখা করি, আমি বলাতে ঐ ছেলেটিকে পুনর্বহাল করেছিলেন উনি। বলেছিলাম আমি জামিন রইলাম, ভবিষ্যতে ছেলেটি হুট করে অমন বিপদে আর ফেলবে না। মুখ রাখল কোথায় এবার? হে ভগবান। একদিনে কটা বাঘের সাথে কোস্তাকুস্তি করতে হবে?
উনি যথারীতি অনুযোগ দিয়ে শুরু করলেন, “দেখেছেন ম্যাডাম, আপনারাই মাথায় তোলেন এদের। আপনারা বললেন বলেই। আমি জানি তো, ও তখন থেকেই ঐ মালিকের সাথে যোগাযোগ করছে তলে তলে। আগের ড্রাইভারটা নড়ছিল না বলে এ যেতে পারছিল না। এখন ওদের কোর্টের ঝামেলাটাও মিটে গেছে। আপনাদের আর দরকার নেই ওর।” কি জবাব দি? মানুষের দুর্দশা শুনলে, সীমিত সামর্থ্য নিয়েও ঝাঁপিয়ে পড়ার অভ্যাসটা মায়ের থেকে পাওয়া। প্রায় মজ্জাগত। মালিক বলেই চলেছেন,“কোথায় বিশ্বস্ত ড্রাইভার পাই এখন?পুজোর সময়।” শুকনো মুখে ঘাড় নাড়ছি কৌশিক আর আমি।
শেষ বিকালের নালিশের মাঝেই বেজে ওঠে দূরভাষ। ওপারে সেই আধিকারিক,যার গাড়ি চালানোর জন্য,আমাদের পথে বসানোর বন্দোবস্ত প্রায় পাকা। “এই আপনার ড্রাইভারটা আমার গাড়ি চালাতে চাইছে। আপনি আগে বলুন তাতে আপনার কোন অসুবিধে হবে না তো? আপনার অসুবিধে করে ড্রাইভার চাই না আমার। যদি সুবিধা হয় ছাড়বেন,নাহলে আমাদের মালিক অন্য ড্রাইভার দেখবে।বুঝেছেন। ”
চেম্বারে ফোনের টাওয়ার থাকে না। কথা বলতে লাগে খোলা বারন্দা। ফোন সেরে ফিরে দেখি দীর্ঘ নালিশের পর কিঞ্চিৎ শান্ত প্রৌঢ়। উঠে পড়েছেন, যাবার আগে বলে গেলেন, “চিন্তা করবেন না। দেখছি। আর ওকেও বলেছি, অফিসটাকে ডুবিয়ে যদি তোর ইচ্ছে মত কেটে পড়িস, তাহলে পাওনাগণ্ডা নিয়েও আমি আমার ইচ্ছে মত বসব। আর যদি তা না করিস, তাহলে ষষ্ঠীর আগেই চুকিয়ে দেব সব হিসেব। পুজো কাটলে একটা ব্যবস্থা হয়েই যাবে। ”
ফেরার পথে দেখলাম ড্রাইভার সুমিষ্ঠ স্বরে জানতে চাইল, পরের দিন কটায় বেরোব। ফেরার পথেই উচ্চ ন্যায়ালয় নিয়ে গুচ্ছ গুচ্ছ ফাইল ঘাঁটা জনৈক সুহৃদ, দূরভাষে আশ্বস্ত করল “ওরে ওগুলো হুমকি নয়। প্রেমপত্র। আমি তো কলকাতায় থাকাকালীন রোজ পেতাম। অস্বীকার করব না, প্রথম দিকে আমিও হাইপার হয়ে পড়তাম। তারপর যা হয় আর কি পড়তামও না। যা করেছিস, বেশ করেছিস। ছাড় তো। বাড়ি যা।” ঘরের মুর্গির সোয়াদ যদিও ডালের মত, তবে এই কথাগুলোই বোধহয় বলেছিল গৃহকর্তাও।
অন্ধকার রাজপথের বুকের ওপর ঘরে ফেরা যানবাহনের দমচাপা ভিড়। আকাশে মুখ লুকিয়েছে চাঁদ। আর দিনদুয়েক পরেই বোধহয় অমাবস্যা। তারপরই বিশুদ্ধ সিদ্ধান্ত মতে প্রতিপদ। পুতিগন্ধময় ধরার মা আসছেন। প্রায় সিদ্ধান্ত নিয়েই ফেলেছিলাম, বদলে ফেলব অনেককিছুই, এখন এই অন্ধকারে খোলা জানালা দিয়ে ছুটে আসা হুহু হাওয়া কেন জানি না বলে যাচ্ছে, কি দরকার? এই তো বেশ ভালোই আছি। জীবন যদি লেবু দেয়,লেমনেডও বানিয়ে দেবে খন।
No comments:
Post a Comment