অনির ডাইরি ৭ই অক্টোবর ২০১৯
গন্তব্য- হিন্দুস্তানের হৃদয়
পুজোর মাঝে বাক্সপ্যাঁটরা গুছিয়ে, লটবহর বগলে কোথাও যাওয়া যে কি ঝঞ্ঝাট, তা কেবল বোঝে বাড়ির গিন্নীরা। পুজোয় খোলা টোটো কোম্পানীর দাপটে খুলে আসতে চাওয়া হাঁটু আর নুইয়ে পড়া কোমরকে পূর্ণোদ্যমে খাড়া করে, আলমারির পাল্লা খুললেই ঝাঁপিয়ে কোলে উঠে আসতে চাওয়া জামাকাপড়ের প্লাবনকে “একটু লক্ষ্মী হয়ে থাক বাপ, ফিরে এসেই তোদের ব্যবস্থা করছি” বলে ঠেলে ঠুলে ঢোকানো, কাজের মাসির হাতেপায়ে ধরে, স্বহস্তে রঙ করা টবের আদুরে গাছপালা গুলোয় জল দেবার ব্যবস্থা করা, ফ্রিজে জমে থাকা আনিজপাতি আর দুধের দায়িত্ব শাশুড়ীর হাতে তুলে দিয়েও দেখা গেল হাফ লিটার দুধ আর আধ প্যাকেট পাঁউরুটি আর গোটা পাঁচেক ডিমের দায়িত্ব কেউই বহন করতে রাজি নন।
ফ্লাইট তো সেই দুপুর দুটো পঞ্চাশ, যাব ইন্দোর। সাধারণতঃ এত বেলায় আমরা কখনও যাত্রা শুরু করি না, কিন্তু এ যাত্রা নিরুপায়। কলকাতা থেকে ইন্দোর ওয়ান স্টপ ফ্লাইট ঐ একটিই। ঘোষিত সময় লাগবে একঘন্টা পঞ্চাশ মিনিট। অর্থাৎ দেবী অহল্যা বাই হোলকার বিমানবন্দরে অবতরনের ঘোষিত সময় বিকাল পাঁচটা। তারপর গাড়িতে আরও ঘন্টা দুই আড়াইয়ের যাত্রা। ভালো করে খেয়েদেয়ে বের হওয়াই মঙ্গল।
সকালে দুধ পাঁউরুটি আর দুপুরে তুত্তুরীর পার্টি লাঞ্চ( আদতে প্রেশারকুকারে এক সাথে সিদ্ধ করা চাল, মুসুর ডাল আর তুলতুলে আলুর ওপর অপরিমিত ঘি, অনুসঙ্গে সদ্যোদিত সূর্যের ন্যায় মাখন দিয়ে ভাজা একটি ডিমের পোচ) করে আমরা যখন বের হলাম, ঘড়িতে তখন বেলা একটা বেজে দশ। ইন্ডিগো সকাল সকালই মেসেজ পাঠিয়ে রেখেছে,“ বিমানবন্দরে বড্ড ভিড়। জলদি এস। অন্তত ঘন্টা দুয়েক আগে অবশ্যই ঢুকো কিন্তু। ” এসব মেসেজে আমরা তেমন ডরাই না। আরেঃ ঘরের পাশেই তো বিমানবন্দর। তবে ওলা উব্রের যা গাড়ির আকাল সেটা নিয়েই যা কিঞ্চিৎ দুশ্চিন্তা।
তখন কি আর জানি, যে ইন্দোরের আকাশে ঘনিয়েছে ঘন বাদল। যত্র তত্র গজিয়েছে বিশ্রী এয়ারপকেট, মাঝেমাঝেই এমন ঝাঁকুনি দিচ্ছে কেঁপে উঠছি আমরা। প্লেনটা নামতেই পারল না নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে, অগত্যা দু বার পাক খেয়ে গেল ইন্দোরের মাথার ওপর দিয়ে।
পরিশেষে অবতরণান্তে, লটবহর জুটিয়ে বাইরে এসে যখন গাড়িতে চাপলাম ঘড়ির কাঁটা বলছে সময় পাঁচটা বেজে চল্লিশ। ড্রাইভার তথা গাড়ি দুই মধ্যপ্রদেশ ট্যুরিজমের। আজ রাতের জন্য গন্তব্য ওঁঙ্কারেশ্বর। পুরো ট্যুরটাই আমার বড় সাহেবের প্ল্যান করে দেওয়া। উনিই বলেছিলেন, “মধ্যপ্রদেশ আমার সবথেকে প্রিয় অঙ্গরাজ্য। বহুবার গেছি। পারলে ঘুরে এসো।” হিন্দুস্তানের হৃদয় বলে কথা, ছত্রিশগড়কে আলাদা করে দেবার পরও কমপক্ষে সাত থেকে আটটা সার্কিট হয়। বেসরকারী হোটেল থাকলেও, মধ্যপ্রদেশ ট্যুরিজমের হোটেলগুলিই সবথেকে ভালো এবং নির্ভরযোগ্য।এদের পেশাদারীত্ব অতুলনীয়। চাইলে গাড়িও ওণারাই দিয়ে দেন। বিমানবন্দর থেকে তুলে আবার বিমানবন্দরে নামিয়ে দেবার গাড়ি-।
গাড়িতে উঠে, শৌভিক আলগা ভাবে জানতে চাইল,“রাত আটটার মধ্যে ঢুকতে পারব কি?” মিনমিনে সুরে জবাব এল, “থোড়া জায়দা টাইম লাগেগা সাব। রাস্তা খারাব হ্যায়। ”
খারাপ মানে খারাপ? বাপরে যত্রতত্র গাড্ডা আর গর্ত। সদ্য বর্ষার পানি জমে সে গুলির কয়েকটা রীতিমত ডোবার রূপ নিয়েছে। ড্রাইভার সাহেব বেশ কয়েকবার বললেন, “তিন মাহিনা পয়লে ভি আচ্ছি সড়ক থি সাব। বারিশ কি পানিনে সব ধো ঢালা”।রাস্তা তো রাস্তা আমাদেরও ধো ঢালা বাপ্।
তেমনি ট্রাকের উৎপাত। কলকাতা থেকে বেশ খানিকটা পশ্চিমে বলেই হয়তো ছটা অবধি দিব্যি আলো ছিল। ইন্দোর বেশ সবুজ শহর। শুনলাম সম্প্রতি মধ্যপ্রদেশের পরিচ্ছন্নতম শহরের মর্যাদা পেয়েছে। প্রচুর গাছপালা। বেশ পরিষ্কারও। অবশ্য আমরা মূল শহরে ঢুকেছি কি না জানি না। তবে গুচ্ছ গুচ্ছ মল, নামী তথা দামী হোটেলের উপস্থিতি কোথাও না কোথাও বুঝিয়ে দেয়, ইন্দোরবাসীদের আর্থিক স্বাস্থ্য বেশ ভালোই।
সাড়ে বারোটায় খাওয়া পার্টি লাঞ্চ কখন হজম হয়ে গেছে পর্যায়ক্রমে বিমান আর গাড়ির ঝাঁকুনিতে। নেমেই বলা হয়েছিল একটা দুকান থেকে দাঁড় করাতে, “চায়েনাস্তা” করব। রাস্তার দুধারে অগুনতি ধাবা। ধাবা ভর্তি শুধু চাট। সামোসা চাট। কচৌরি চাট। আর ছাচ, মানে লস্যি বোধহয়। শুধু চা’টাই যা দুর্লভ। এই পথে এত ধাবা, এত ট্রাক, কিন্তু কেউ তেমন চা খায় না নাকি? কে জানে।
সাতটা নাগাদ সৌভাগ্য হল।হাইওয়ের ধারে টিমটিমে আলো জ্বলা ধাবা। কড়াইয়ে টগবগ করে ফুটছে মোষের দুধ। বললেই চা পাতা আর চিনি দিয়ে ফুটিয়ে দেবে। নাস্তা বলতে অবশ্য সেই সামোসা আর কচৌরি। তাও ভেজে রাখা। তাই সই। এই মোটা ছাতুর পুর দেওয়া ঠাণ্ডা কচৌরির ওপর লাল চাটনি আর ঝুরি ভাজা ছড়ানো আর জিভ পোড়ানো মোষের দুধের মিষ্টি চা। দুটিই অম্বলের আহ্বায়ক। দুটিই স্বাদে অনবদ্য।
ক্রমে গাড়ি গাঁয়ের রাস্তা ধরল। কিছুটা দূরে দূরেই হিন্দিতে সাইন বোর্ড দেওয়া- “ধীমে চালাইয়ে। আগে গাঁও হ্যায়। ” ধীরে ধীরে ঘাট শুরু হল। আসলে বিন্ধ্যাচলের ক্ষয়ে যাওয়া অংশ। এরা বলে ঘাট। ঘাটের নাম কি? জানতে চাইলে ড্রাইভার আকাশ থেকে পড়ে, “গাঁও কা নাম সেই হোগা সাব।”
দুপাশে জঙ্গল। আকাশে ক্ষয়া কিন্তু নবমীর টলটলে চাঁদ আর অগুনতি তারাদের দঙ্গল।দূষণ,ধোঁয়া কম বলে সবকিছু অতি স্বচ্ছ। চতুর্দিক নিঃঝুম। মাঝেমাঝে শুধু উল্টো দিক থেকে আসা গাড়ির আলো বাদে সে এক অপার্থিব পরিবেশ। মনে হচ্ছিল বাতানুকূল গাড়ির কাঁচ ভেদ করে ছড়িয়ে পড়ছে মাতাল ঝিমঝিমে জোছনা।
No comments:
Post a Comment