Thursday 24 September 2020

অনির ডাইরি,১৪ই সেপ্টেম্বর, ২০২০

 অনির ডাইরি,১৪ই সেপ্টেম্বর, ২০২০


বিমানবন্দরের সীমানা ছাড়িয়ে বেলঘরিয়া এক্সপ্রেসওয়ে ধরে বালি ব্রীজ, একদিনে তিনজনে ঘর ছেড়ে হয়েছি বার- ।  অন্যান্য দিনে অসভ্যের মত ট্রাফিক জ্যাম হয় এই পথে, আজ রবিবার, সদ্য বিগত হয়েছে মধ্যাহ্ন, তাই বোধহয় যানজট কিছুটা ভদ্রোচিত। জানলার বাইরে টলটলে নীলাকাশে ঘন মেঘের ঘনঘটা, কাঁচ নামালেই অল্পস্বল্প জোলো বাতাস । “একপশলা বৃষ্টি হলে মন্দ হয় না” বলল শৌভিক। বিবেকানন্দ সেতুতে উঠে, দক্ষিণেশ্বর মন্দিরের চূড়া লক্ষ্য করে প্রণতি জানাতে না জানাতেই, অাবছায়া জানলার কাঁচ। 

ধূলাগড় টোলে, একপিঠের মূল্য ১০৫টাকা। ফিরব তো এই পথেই, তবুও দুপিঠের টোল কাটে না ওরা। টোল প্লাজার হাল্কা যানজট কাটতেই,ফাঁকা রাজপথ। গাড়ি দৌড়য় একশ কিলোমিটার গতিতে। উল্টোদিকে ছুটে যেতে থাকে, বাউরিয়া, চেঙ্গাইল, ফুলেশ্বর। উলুবেড়িয়ায় সামান্য দেরী হয় জট কাটতে, তারপর আসে বীরশিবপুর, বাগনান। দেউল্টি আসার সাথে সাথেই রাজপথ ছেড়ে বাঁদিকে নেমে যাই আমরা। তারপর ডানদিকে বাঁকলেই, রবিবার দুপুরের মরা বাজার। বাজারের সীমানায় মস্ত সাইনবোর্ড, সামতাবেড় শরৎবাবুর কুঠী ঐ পথেই। 


বাজার থেকে বেশ কিছুটা দূরে, পথের ওপরেই ওণার দ্বিতল কুঠী বাড়ি। চতুর্দিক টালির চাল দেওয়া বারন্দা দিয়ে ঘেরা। নিকানো তকতকে আঞিনা। আঙিনা ঘিরে যতনচর্চিত বাগিচা। আছে ওণার স্বহস্তে রোপিত পেয়ারা গাছ, ঝড়ে উপড়ে গেছে গোড়া, সংরক্ষিত শুধু শুষ্ক কাণ্ডখানি। ১৯২৬থেকে ১৯৩৮, দীর্ঘ একযুগ কাটিয়েছেন এই গৃহে। তখন নাকি সীমান্ত পাঁচিল স্পর্শ করে খলবলিয়ে বয়ে যেত রূপনারায়ণ নদ। এখন সরে গেছে বেশ কিছুটা দূরে।   তিনি তখন হাওড়া জেলা কংগ্রেসের বড় নেতা। কত তাবড় তাবড় বিপ্লবীর পদধূলিধন্য এই গৃহ। রাতের বেলা এসে মিটিং করে গেছেন খোদ নেতাজী। সবুজ শিকলাগানো দরজায় ঝুলছে তালা, সাড়ে তিনটের আগে খুলবে না। দরজার উল্টোদিকেই এক শান বাঁধানো পুকুর। এই পুকুরেই কার্তিক-গণেশের বাস ছিল বলে জনশ্রুতি। 

ঘড়িতে সোয়া তিন, এরই মধ্যে ভিড় জমেছে ভালোই। অনেক মানুষ আসে দেখতে। লকডাউন তথা করোণার আতঙ্কে জনজোয়ারে কিঞ্চিৎ ভাঁটা পড়লেও মন্দ কিছু নয়। রাস্তায় না দাঁড়িয়ে থেকে সীমান্ত প্রাচীরের গা বরাবর চললেই সামনে শ্যামল ধানক্ষেত, ক্ষেতের ওপারে চিকচিক করছে নদ। ক্ষেতের পাশ দিয়ে নদের ধারে যাবার রাস্তা ঢালাই হয়েছে পঞ্চায়েতের সৌজন্যে। পথের ধারে লাল ক্রোটন আর চায়না টগর গাছের সমারোহ। ফুটে আছে গুড়ি গুড়ি সাদা ফুল। বড় বড় নোটিশ টাঙানো, আবর্জনা ফেলবেন না। ভ্যাট ব্যবহার করুন। পচনশীল আর অপচনশীল আবর্জনার জন্য আলাদা রঙের ভ্যাটও রাখা আছে। তবুও পড়ে আছে শিখর জাতীয় গুটকার প্যাকেট। নদের পাড় বরাবর আছে অনেকগুলি বাঁধানো বসার জায়গা। মোটামুটি পরিচ্ছন্ন। পার বরাবর কাশ ফুটেছে। ওপাড়ে কোলাঘাট থার্মাল থেকে ভুসভুস করে বের হচ্ছে সাদা ধোঁয়া। আয়নার মত নীলাকাশে পেঁজা তুলোর মেঘের দল, মুখ দেখতে নামছে নদের বুকে। গুটি কয়েক আগন্তুকের ক্ষণিক উচ্ছাস ছাড়া এপাড়ে বিরাজমান  অখণ্ড নীরবতা। 

শরৎবাবুর কুঠীতে ঢুকতে কাটতে হয়না কোন টিকিট। যে বয়স্ক কেয়ারটেকার ঘুরিয়ে দেখান, উনি শুধু দাবী করেন, যদি কিছু খুশি হয়ে দিয়ে আসেন। জুতো খুলে উঠতে হয় দাওয়ায়। লাল সিমেন্টের চকচকে মেঝে। বাঁদিকের ঘরে রাখা ওণার আরাম কেদারা। পাশের ঘরে পাতা ফরাশ, রাখা তাকিয়া। ওণার গড়গড়া। লণ্ঠন। বাতিদান আরও কত কি। ঐ লণ্ঠনের অালোয় নাকি কোন এক রাতে রুদ্ধদ্বার কক্ষে মন্ত্রণায় বসেছিলেন কথাশিল্পী আর নেতাজী। কি কথা হয়েছিল, জানে শুধু সময়, আর জানে বোবা লণ্ঠন। ভিতর দিকে আছে শস্যের গোলা। ছিল এক রসুইঘর, যা আটাত্তরের বন্যায় ধূলিসাৎ হয়েছে। শূণ্য ভিত আজও বিদ্যমান। 

কাঠের রেলিং দেওয়া লাল সিমেন্টের সিঁড়ি নিয়ে যায় দোতলা। দোতলায়ও চারদিকে ঘিরে আছে বারন্দা। বারন্দা থেকে রূপার পাতের মত লাগে নদীকে দেখতে। দোতলাতেই ছিল তাঁর শয়নকক্ষ। আছে তাঁর পরিবারের সদস্যদের ছবি। ওণার নাতি জয় বাবু বোধহয় বর্তমান মালিক। বুড়ো কেয়ারটেকার তো তাই শোনাল- 

ওণার কুঠী থেকে অল্পদূরেই আছে সাড়ে  তিনশ বছরের পুরাতন মেল্ল্যকের মদনগোপাল জীউ এর মন্দির। দীর্ঘদিনের অযতনে নষ্ট হতে বসা, আটচালা পোড়া মাটির মন্দিরটি সম্প্রতি সংস্কার করা হয়েছে। সামতাবেড় থেকে গাড়িতে লাগে মিনিট দশ। পদব্রজে আরো একটু  বেশী সময় লাগবে হয়তো, তবে রাস্তাটা পায়েচলার পক্ষেই অধিক সুগম। ইঁটপাতা সরু রাস্তা, রাস্তার একপাশে কোথাও জনবসতি, কোথায় বা শুধুই ঝোপজঙ্গল।  অপরদিকে সবুজ ধানক্ষেত, গোচারণভূমি আর পুকুর। বড়ই মনোরম এই পথ। বাঁধের ধারে গাঁয়ের দুর্গামণ্ডপ, প্রস্তুত দেবীর কাঠামো। তারওপর পড়েছে মাটি। বাঁধের ওপর গাড়ি ছেড়ে বাকিটা পায়ে হেঁটে যেতে হয়। সরু পায়ে চলা পথের ধারে ফলে আছে কয়েৎবেল। ধরেছে বাতাবি লেবু। পুকুরের ধারে চরছে ছাগল ছানা। আর এদের সবাইকে পিছু ফেলে এগিয়ে গেলে হঠাৎ চোখের সামনে ফুটে ওঠে সাড়ে তিনশ বছরের বুড়ো মন্দির। বুড়ো বললাম কি, তার শরীরে এখনও ঢলঢল করছে যৌবন।

ফেরার সময় ঝক্কি অনেক কম। আবার সেই পানা পুকুর, ছাগলছানা, বাতাবি লেবু, তেঁতুল আর কয়েতবেল গাছের তলা দিয়ে এসে উঠতে হয় বটে বাঁধে। এখান থেকে একটা সরু রাস্তা সোজা এসে ওঠে বম্বে রোডে। শুধু যদি মন্দির দেখতে চান, ওই রাস্তা ধরে যাওয়াই বোধহয় সহজ হবে। তবে মনে রাখবেন, ওখানে নেট থাকে না, জিপিএস কোন কাজে আসে না। স্থানীয় মানুষই ভরসা।

                  শরৎবাবুর কুঠী

লাল প্রাকারের এপার থেকে - বার্মিজ স্টাইলে লেখক শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এর কুঠি

বন্ধ খিড়কি দুয়ার থেকে শ্রী শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এর কুঠি

বারান্দা থেকে দূরে রূপনারায়ণ নদ

এই পুকুরেই বাস ছিল কার্তিক আর গনেশ চন্দ্রের, সৌজন্য রামের সুমতি

নিঃসঙ্গ রূপনারায়ণ নদ, দেউল্টি

মদনগোপাল জীউ এর মন্দির মেল্ল্যক

©Anindita&ShouvikBhattacharya


No comments:

Post a Comment