এবছরও নববর্ষের দিন প্রশ্ন করেছিল জ্যাঠাইমা, খুব সাদামাটা প্রশ্ন, জামাইষষ্ঠীতে আসছি কি না। প্রতিবছর মোটামুটি এই সময় থেকেই শুরু হয়ে যায় টুকটাক প্রস্তুতি। প্রথম ধাপে, মা-জ্যাঠাইমা আর পিসির শাড়ি কেনা। ধপধপে শাদা শাড়ি ছাড়া পরে না জ্যাঠাইমা। তাও মোটা বা ভারি না, পাতলা ফিনফিনে। যতদিন জেঠু জীবিত ছিলেন, সাদার মধ্যেই লাল-কমলা আর গোলাপী পাড় খুঁজতাম। বিগত কয়েক বছর, সর্বাগ্রে সরিয়ে রাখি ঐঐ রঙগুলি। পিসিরও চাই হাল্কা শাড়ি, কটন বা লিনেন। তবে রঙ নিয়ে কোন বায়নাক্কা নেই, ক্যাটক্যাটে লাল বা হলুদ রঙের শাড়ি দিলেও পিসি পরমানন্দে গ্রহণ করবে এবং পরবে। সমস্যা হয় মাকে নিয়ে, ঠিক কি যে পছন্দ হয় মায়ের-
নাঃ জ্যাঠাইমা যতই আব্দার করুক এ বছর আর যাইনি। লকডাউন তো ছিলই তদোপরি মনমেজাজও বিশেষ ভালো ছিল না। প্রিয়তম দখিন বঙ্গ আমফানের আক্রমণে পর্যুদস্ত, পশ্চিমভারতে পঙ্গোপালের ঝঁক, উত্তরাঞ্চলে দাবানল, উত্তরপূর্বে সোয়াইন ফ্লু, সর্বোপরি অভূক্ত অর্ধমৃত পরিযায়ী শ্রমিকদের দল। বাড়িতেই ছাপোষা ষষ্ঠীপালন। অভিমানী কন্যার মানভঞ্জনের জন্য, যৎসামান্য উপাচারই সাধ্যমত সাজিয়ে গুছিয়ে পরিবেশন, গৃহকর্তার উপর্যুপরি সাবধান বাণী সত্ত্বেও,নিখাদ সৌন্দর্যায়নের জন্য অতিরিক্ত বাসনের ব্যবহার এবং বর্তনমর্জনের সময় স্বনির্বুদ্ধিতার জন্য কপালে করাঘাত।
সায়াহ্নে গুছিয়ে বসে ফেবু খুলতে গিয়ে রীতিমত তড়িদাহত হলাম, টাইমলাইন জুড়ে শুধুই সুখাদ্যের ছবি। কোথাও শাশুড়ীমাতারা রন্ধন করেছেন জামাতাদের জন্য, কোথাও বা বৌমাষষ্ঠীর নামে সালাঙ্করা পুত্রবধূর সামনে সাজিয়ে রাখা চৌষট্টি ব্যঞ্জন, কোথাও বা নিছক ঘরণীই হয়ে উঠেছেন শাশুড়ী মাতা। জনৈকা মহানগরবাসিনী আমফানের পরদিন প্রভাতে কিছু সুখাদ্যের ছবি পোস্ট করে লিখেছিলেন, “আমি গলিতে থাকি। ঝড়টা ঠিক বুঝতে পারিনি। রান্না করতে ব্যস্ত ছিলাম। কেমন হয়েছে ফ্যান্ডস্?” কি বাছা বাছা গালাগালি দিয়েছিল মহানগরবাসীরা সেদিন, ঘন্টাখানেকের মধ্যে রেকর্ড সংখ্যক গালি খেয়ে পোস্টটা মুছে যায়- জামাইষষ্ঠীর দিন দেখলাম তিনি আবার পোস্টেছেন- কয়েকদিন আগের খিস্তিবাজরা আজ অঢেল প্রশংসায় ভরিয়ে দিয়েছে তাকে। কয়েকজন রূপসী পরপর পোস্ট করেছেন, মোদ্দা কথা মায়ের অবর্তমানে (বালাই ষাট, লকডাউন জনিত) তাঁরাই ষষ্ঠী করেছেন গৃহকর্তার জন্য, আসন পেতে পিতলের থালাবাটিতে সাজানো হয়েছে গুপিবাঘার ব্যঞ্জন- কি নেই তাতে? সাদা ভাত, পোলাও, মাটন, চিংড়ি,কুমড়ো পাতা মোড়া ভেটকি, দই, পাঁচ রকম মিষ্টি, হরেক রকম ফল- সাথে ডাল, পাঁচরকম ভাজা, শুক্তো, অম্বল। বরের জন্য ষষ্ঠী? ভাগ্যিস ঠাকুমা বেঁচে নেই। যাই হোক এইসব রন্ধনপটিয়সীদের শতকোটি প্রণাম, জৈষ্ঠের এই দাবদাহে এতগুলি পদ রান্না এবং পরিপাটি সাজিয়ে দেওয়া চাট্টিখানি কথা নয়। খাবারের ছবি দেখতে বরাবরই ভালো লাগে, এই লকডাউনে মানসিক অবসাদ কাটাতে অনেকেই ভলোমন্দ দু-এক পদ রাঁধছেন, তাই বলে এত পদ কি আদৌ কোন মানুষের পক্ষে পাচন করা সম্ভব?ঙ বিশেষতঃ যেখানে সংবাদপত্রের প্রথম পাতায় রোজ ভূখা মানুষের মিছিল-
কয়েকজন সোহাগী পুরুষও দেখলাম সহরষে স্ত্রীর বানানো বিরিয়ানির ছবি পোষ্ট করে লিখেছেন, “আমার গিন্নী বানিয়েছে, লাইকটা দেবেন প্লিজ, নইলে আমার রক্ষে নেই”। “লাইক হাংগ্রী জেনারেশন”এর আব্দার পড়তে পড়তে জনৈকা বৌদির কথা খুব মনে পড়ছিল। দিন দুয়েক আগেই ফোন করেছিলেন, কিছু টাকা ধার চেয়ে। ওণার আর দোষ কি, লকডাউনের মাঝেই ছাঁটাই হয়েছেন ওণার স্বামী। পাওনাগণ্ডা সবই মায়ের ভোগে। মালিক ফোনে কুৎসিত ভাষায় জানিয়েছে, “এই লকডাউনের মাঝে তুমি করেছটা কি, যে বেতন চাইছ?” ভদ্রলোকের না আছে নিয়োগপত্র, না স্যালারি স্লিপ। যখন যেমন দিত মালিক, দুহাজার- পাঁচ হাজার- আট হাজার। শ্রমকমিশনার হওয়া সত্ত্বেও কোন কাজে আসতে পারিনি আমি। আরে শ্রমআইনটাই তো তুলে দিচ্ছে সব সরকার। ঠুঁটো জগন্নাথ কমিশনার আর করবেটা কি? পাড়াতুতো বৌদি, প্রায় সহেলী সম্পর্কিত। প্রথম দিকে অনুনয় করত, “দাদাকে একটা চাকরী খুঁজে দাও অনিন্দিতা।” জামাইষষ্ঠীর দিনদুয়েক আগে বলল, “কিছু টাকা ধার দিতে পারো? ছেলেটাকে কদিন ধরে আলুভাতে ভাত ছাড়া কিছু দিতে পারিনি। আমার ভীষণ মরে যেতে ইচ্ছে করছে অনিন্দিতা। ”
তবে এবছরের সুপারহিট পালা বৌমা ষষ্ঠী। শ্বশুরঘরে নির্যাতিতা আমার বেশ কয়েকজন বান্ধবীও শেয়ার করেছে দেখলাম,বৌমা ষষ্ঠী কাণ্ড। ঐ মেয়েটিও শেয়ার করেছে, যাকে আপিস ফেরৎ কদিন আগে নামিয়ে দিয়েছি তার মাসির বাড়ি। নেহাত মুখ চেনার সুবাদে, এক কাপড়ে ঘর ছেড়ে আমার চেম্বারে দৌড়ে এসেছিল অভুক্ত মেয়েটি, পারিবারিক কলহের জোরে, আক্ষরিক অর্থে চুলোচুলি। বৈদ্যবাটির কাছে হাইরোডের ধারে চা খেতে খেতে জানতে চেয়েছিলাম কি হয়েছে। মাথার পিছনে খাবলা খাবলা চুল টেনে ছিঁড়ে নিয়েছে শাশুড়ী আর মাসি শাশুড়ী, জায়গায় জায়গায় ফুলে আছে পটলের মত। জমে আছে রক্ত। “বাপের বাড়ি যাওনি কেন?” “কেউ নেই ম্যাডাম। বাবা চলে গেছে কোন ছেলেবেলা। মা স্থবির প্রায়। ফুসলে সব সম্পত্তি লিখিয়ে নিয়েছে দাদা। বর ছাড়া অামার কেউ নেই ম্যাডাম। ” প্রশ্ন করলাম, তোমার বর কিছু বলেনি? “একমাত্র ছেলে ম্যাডাম। মাকে রাখবে না বৌকে? ঐ বলল, কটা দিন কোথাও চলে যাও। আমার মাসির বাড়ি আপনার বাড়ির কাছে-”। পুলিশে যাওনি কেন? “ঘরের কেচ্ছা না ম্যাডাম-”। আজ বিকালে হাউমাউ করে ফোন করেছিল মেয়েটি, “কাল আপিস যাবেন ম্যাডাম? আমাকে একটু সঙ্গে নেবেন?” শুনলাম মাসিশাশুড়ীর ইন্ধনে, মেয়েটার শাশুড়ী নাকি থানায় নালিশ করেছে, ছেলে আর বৌমার নামে-”।
পুনশ্চঃ- এমন বিষাদকালে, জামাইষষ্ঠীর সামান্য আয়োজন, বাঁদিকে মুগডাল আর সাবুর খিচুড়ির সুবাসে খুঁজেছি ষষ্ঠীর দিন মা আর জ্যাঠাইমার আদর। আর ডানদিকে পাতি বাঙালী গোল পরোটা আর পোস্ত-দীপাবলীতে উপহার পাওয়া অবশিষ্ট গুটি কয় কাঠবাদাম বেটে বানানো আলুর দম। সাজিয়ে দেওয়া শুধু কন্যার জন্য, যিনি ষষ্ঠীর দিন সকালে সামান্য অপাট করার জন্য কঠোরভাবে ভর্ৎসিত হয়েছিলেন।
No comments:
Post a Comment