Monday 15 June 2020

অনির ডাইরি ১৫ই জুন, ২০২০



আজকাল অনলাইন হাজিরা চালু হয়েছে তুত্তুরীর। সক্কাল সক্কাল উঠেই, বাসি মুখে চোখ কচলাতে কচলাতে টাইপ করতে হয় তুত্তুরী থুড়ি পুরোযা ভট্টাচার্য। সময় মাত্র দশ মিনিট, দশ মিনিটের পরই বন্ধ হয়ে যায় হাজিরা খাতা। অতঃপর আমার ল্যাপটপ আর মোবাইল দখল করে, খেপে- খেপে চলে পড়াশোনা। যতঃক্ষণ না বাজছে আপিসের ভেঁপু। বাকি টাস্ক রাতের বেলা,বাড়ি ফিরলে- বেশ কয়েকবার বলেছে শৌভিক, বাতিল মোবাইলে নতুন একখান সিম্ ভরে দিলেই তো হয়। আমার আপত্তিতেই বাস্তবায়িত হয়নি। জানি ফোন হাতে পেলেই দিনে গুনেগুনে সতেরো বার দাদু- মামমাম আর কাকিমাকে ফোন করবে তুত্তুরী। জবরদস্তি শোনাবে কাল্পনিক গুলগল্প। শুধু কি তাই, ডাউনলোড করবে টম বেড়ালের গুষ্টি। ইতিমধ্যেই আমার মোবাইল আর মাসির মোবাইলে বসতি পেড়েছে টম আর এঞ্জেলা নামক দুই বাচাল বিল্লী। ঘড়ি ধরে চলে তাদের নাওন-খাওন তথা শৌচাগার দর্শনের কাজ। পড়াশোনায় ফাঁকি মারলেই তাদের উড়িয়ে দেওয়ার ভয় দেখাই আমি- ওমনি হাঁ হাঁ করে কান্না জোড়ে তুত্তুরী। মাঝে মাঝে মনে হয় জীবন যেন দাঁড় করিয়ে দিয়েছে আয়নার সামনে, সেদিন কাকে যেন ফোনে বলছিলাম, “সব শুনে ভীষণ গালাগাল দিতে ইচ্ছে করছে-”।  তারপর দুদিন তুত্তুরী আমায় সেধেছিল, “মা প্লিজ একটা গালাগাল দি। ভীষঅঅঅণ ইচ্ছে করছে। ” চৈতালীকে বললাম, “দুঃ শালা। ” কিছুক্ষণ পর শুনতে পেলাম কচি গলায় কে যেন টমকে বলছে, “এই শালা। শালা বলিস না। খারাপ কথা। মা বকবে। ” ছুটির দুপুরে মধ্যাহ্নভোজ চলাকালীন দাম্পত্যালাপের ফাঁকে হয়ত কেউ সান্ধ্য ভাষায় বলে ফেললাম, কোন কুশব্দ, গম্ভীর মুখে খাওয়া থামিয়ে ধমকে ওঠে তুত্তুরী, “ওটার মানে খারাপ কথা। আমি জানি।” রীতিমত তাজ্জব হয়ে যাই আমরা, “তুই জানলি কি করে? আর মানেটাই বা কে বলল? আমরা?” জবাব পাই, “নাঃ। তোমায় জিজ্ঞাসা করেছিলাম, তুমি বলেছিলে,বড় হলে বলবে। তখন দাদুকে জিজ্ঞাসা করলাম। দাদু বলে দিল। দাদু বলেছে, ‘সব শিখে রাখ। সময়মত ঝাড়বে। শুধু বাবার সামনে বলো না। এইরেঃ বাবার সামনে বলে ফেললাম। যাঃ। ”
শুধু কি তাই, যেমন ধরুন শৌভিকের আর আমার দাম্পত্যকলহ নিয়ে অতি ঔৎসুক্যের অপরাধে কখনও হয়তো বলেছিলাম, “ বাবা আর আমার কি কথা হয়েছে সেই কৈফিয়ৎ তোমায় দেব নাকি?” গতরাতে মাসিকে শুনতে হয়েছে, “মা আর আমার কি কথা হয়েছে, সেই কৈফিয়ৎ-”। মাসি অবশ্য গর্হিত অপরাধে অপরাধী। নৈশাহারের পর যখন তুত্তুরী তার ই-বেড়ালিনীকে আদর করতে যায়, ঠিক তখনই খবর দেখছিল মাসি। যুগপৎ দাবী এবং প্রার্থনা করা সত্ত্বেও মোবাইল ছাড়তে রাজি হয়নি মাসি। উল্টে ভয় দেখিয়েছিল, “মাকে বলে দেব দেখবে?” শুধু কি তাই, বরের সাথে কিছু গোপন বার্তালাপ করার জন্য বলেছিলাম, “ বাবু একটু বাইরে গিয়ে টিভি দেখ। একটু পরে আসিস। ” বার্তালাপ অন্তে ঘর থেকে বেরিয়ে দেখি, পাশের ঘরের দরজায় গোল করে কাগজ কেটে সাঁটিয়েছে তুত্তুরী, “বিনা অনুমতিতে প্রবেশ নিষেধ।” দুটি গোল গোল কাগজে “কাম ইন” লেখা টিকিট বানিয়ে, আমাকে দেখিয়ে পর্যায়ক্রমে বাবা এবং মাসিকে দেয়া হল। আর বাবাটাও এত বেইমান যে আমাকে দেখিয়ে দেখিয়ে, টিকিট হাতে, সকন্যা দুয়ারে আগল দিল-
ওদিকে সক্কাল সক্কাল দেখলাম মায়ের ওপর খুব চটেছে বাবা। বাজার যাবার আগে বলে গিয়েছিল, “সোফায় বসে থাক। এসে যেন দেখতে পাই। ” গলির মুখেই সব্জি নিয়ে বসে, ব্যাঙ আর ফড়িং দুই ভাই। মাছ মাংসও ফোনে বললে চলে আসে বাড়ি। তাছাড়া এই শর্মা তো আছেই, তাহলে আবার বাজার যাবার দরকার কি? প্রশ্ন করাতে রীতিমত অগ্নিশর্মা হয়ে ওঠে বৃদ্ধ। গুটি চারেক পুঁচকে কাপড়ের ব্যাগ দেখিয়ে শোনায় ফর্দমালা, মায়ের জন্য ব্যাঙের থেকে টাটকা শসা কিনে (কাজের ফাঁকে কচি শসা কুচকুচ করে চিবোতে ভালোবাসে মা), মোড়ের মাথার মিষ্টির দোকান থেকে টাটকা ছানা কিনে (রাতে শেষ পাতে রুটি দিয়ে খাবে মা), গোটা দুই ক্যাডবেরি কিনে (সন্ধ্যা নামলে মায়ের মনটা মিষ্টি মিষ্টি করে যে), পরের মোড় অবধি হেঁটে গিয়ে মায়ের মনপসন্দ সুগন্ধী পাতা চা কিনে  প্রায় দুকিলোমিটার পথ পরিক্রমাপূর্বক গৃহে প্রত্যাবর্তন করে দেখে শূণ্য সোফা, মা ব্যস্ত অন্য গেরস্থালির কাজে-।

এরপরও গোঁসা হবে না? যার জন্য চুরি করিনু সেই বলে ইয়ে-। দুটো মিষ্টি কথা দূরাস্ত, উল্টে বৃদ্ধের কপালে জুটেছে একরাশ কোভিড সতর্কতা- হাত ধোও, জুতো ধোও, জামা ছাড় ইত্যাদি প্রভৃতি।
গল্পটার অবশ্য অন্য আঙ্গিকও একটা আছে, মায়ের অনুযোগ, এত কিছুর সাথে বৃদ্ধ আর একটি বস্তুও নিয়ে এসেছে খুঁজেপেতে- গুটি কয়েক প্যাকেট ভর্তি সিগারেট। আর ঐ শসা-ছানা-চকলেট আর সুগন্ধী চা? ওতো মানভঞ্জনের জন্য, সে কি মা বোঝে না। গতসন্ধ্যার নিরালায়, বাতানুকূল যন্ত্রের মোহক আবেশে, ধোঁয়া ওঠা চা আর কুড়মুড়ে ব্যাট পাঁপড় সহ দোহে বসেছিল মর্দানী দেখতে। রাণী মুখার্জী দুজনেরই প্রিয়তমা অভিনেত্রী। হেন কালে কোন আপদ যেন মাকে ফোন করে কুশল বিনিময় করতে-।  বেশ বিরক্ত হয়ে বাবা ইশারা করে, জলদি কাটো। অতঃপর টিভিকে বোবা করে, দালান আর বাইরের রোয়াকে চার চক্কর মেরে, ঝিরিঝিরি বৃষ্টির হাওয়ায় এইটি সিগারেট ধ্বংস করে বাবা যখন কক্ষে প্রত্যাবর্তন করে, মা তখনও সহর্ষ বাক্যালাপে মশগুল। দূরদর্শন যন্ত্র তখন দামাল অ্যাকশনে মত্ত দম্পতির হৃদয়ের রাণী, টিভিকে সবাক করে, বাবার ভাষায় মৃদু সুরে (এবং মায়ের ভাষায় দাঁত কিড়মিড় করে) বলে-“ তুমি ঐ ফোন নিয়েই থাক। আমি একাই দেখি। বাকি কথা দালানে গিয়ে বললে ভালো হয়।”এক বুক অভিমান নিয়ে ঘর ছেড়ে চলে যায় মা।  অতঃপর মর্দানী মাথায় ওঠে বৃদ্ধের, সাড়ে দশটা অবধি সাধাসাধি- ডাকাডাকি অবশেষে “মম শিরসি মণ্ডনং, দেহি পদপল্লবমুদারম” করে গিন্নীকে পটাতে সক্ষম হয় বৃদ্ধ। আজ তাই, সূর্যের তেজ বৃদ্ধি পাবার আগেই, মাস্ক পরে বেরিয়ে পড়ে, সীমিত সামর্থে গিন্নীকে খুশি করার অভিপ্রায় নিয়ে- অানরোম্যান্টিক বৃদ্ধা সেই অনুভূতি চিনলে তো।
বৃদ্ধ-বৃদ্ধার কলহ শুনতে শুনতে, বরের ঘরের পিসি আর কনের ঘরের মাসি হতে হতে কখন যেন পৌঁছে গেছি চুঁচুড়া। ফোন রেখে কালেক্টরেটে ঢুকতে যাব, দরজার গোড়ায় যে অল্প বয়সী ছেলেটা স্যানিটাইজার নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে, হাতে ঢালতে ঢালতে আজ একগাল হেসে বলল,“বর্ষা এসে গেছে ম্যাডাম। এবার বড় বড় ইলিশ মাছ পাবেন। ” হাতে ৮০শতাংশ ইথাইল অ্যালকোহল ঘষতে ঘষতে, তাজ্জব হয়ে জানতে চাইলাম, “কেন রে?” জবাব পেলাম, “ঐ যে লকডাউন গেল না। কেউ তো আর ঐ সময় খোকা ইলিশ ধরেনি, বলুন। তাই ভাবছিলাম আর কি!” হাসব না কাঁদব বুঝতে পারলাম না। ছেলেটার লজিকে ভুল নেই। ও যদি এই আকালেও স্বপ্ন দেখে, সেই স্বপ্ন ভাঙার অধিকার আমার নেই। সিঁড়ি ভেঙে উঠতে উঠতে মনটা কেন জানি না বেশ খুশি খুশি হয়ে উঠল, তুল্যমূল্য বিচার করতে বসলে জীবনে অনেক কিছুই অধরা, সব মিলিয়ে বড় বেশী সাধারণ আমি। আর সাধারণত্বই কোথাও না কোথাও আমার সবথেকে বড় প্রাপ্তি। জীবনে এতটা পথ এগিয়ে এসে, একটাই মূল উপলব্ধি করতে পেরেছি, প্রতিটা মুহূর্ত আনন্দ করে বাঁচাটাই জীবনের সবথেকে বড় প্রাপ্তি। মেয়েটাকেও তাই শেখাই, নাঃ ফিরে গিয়ে অন্তত একটা গালাগালি দেবার অনুমতি দিতেই হবে ব্যাটাকে। আর একটা গোল, “কাম ইন” লেখা স্টিকার আমারও চাই। পটাতেই হবে মেয়েটাকে- আমাকে এইভাবে আটকে রাখা বেশ দুষ্করই শুধু নয়- অসম্ভব।

No comments:

Post a Comment