মনেরও বুঝি মরশুম আছে, কখনও প্রবল সুখেও কেন যে, ঘনিয়ে আসে আষাঢ়ে বাদল? প্রিয়জন সান্নিধ্যে, বাতানুকূল যন্ত্রের সোহাগে, গাল বালিশের আদরে ভিজতে ভিজতে কেন জানি না, মনে পড়ে যায়, কোন এক আত্মঘাতী কিশোরীর কথা। কে জানে, কোন সে সেই বিস্মৃত কালের, কোন অলস দুপুরে, লাল হয়ে আসা কোন এক শারদীয়ার পাতায় আলাপ হয়েছিল তার সাথে। ঝিম ধরা দুই চোখের তারায় উঁকি মেরে যায় সময়, “পারবে না হে, পারবে না। আমায় ধরে রাখতে তুমি পারবে না।“ বারন্দার ওপর থেকে উঁকি মারে এক জোড়া বিষণ্ণ চোখ, “ আমি যাব, তোর কাছে?” ঊর্ধ্বপাণে তাকিয়ে থাকি আমি, কতদিন তোমায় স্পর্শ করিনি দিদি। মুঠোয় ভরা বালির মত ঝরে যাচ্ছে সময়-
সকালের সংবাদপত্র বড় বেশী বাজারু, সীমান্তে বুঝি লাগল আগুন। তেরঙ্গায় মোড়া শবের মিছিল। যেন উন্মাদ হয়ে উঠেছে, নরমাংসভোজী পিশাচের দল, যুদ্ধ চাই যুদ্ধ। বেদনাও এখন পণ্য। স্টিল ফ্রেমে ধরা থাকে মূল্যবান শোক। দুরাভাসের ওপারে গমগমিয়ে ওঠে দীনু খুড়োর মাই ডিয়ার কণ্ঠ, “ কি রে বেটি কি চাস?” প্রদোষ মিত্তিরের যেমন সিধু জেঠা, আমার তেমনি দীনু খুড়ো। হ্যামলিনের বাঁশিওয়ালার সুর, খুড়োর গল্পে। আজ যুদ্ধের গল্প শুনব খুড়ো। আমাদের প্রজন্ম যুদ্ধ দেখেনি। “কেন রে? তোর আপিস নেই বুঝি?” জানতে চায় খুড়ো। আছে তো, এঁকেবেঁকে চলেছি আপিসেরই পথে। নিবেদতা সেতুর মাথার ওপর গহন মেঘের চাঁদোয়া। ফোনের সীমান্ত পেরোলেই খুড়ো আর আমি, বসে আছি বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের জনৈক ছাত্রাবাসের কোন এক নিঝুম কামরায়। সন ১৯৭১।ঘনিয়ে এসেছে রাত্রি, আনমনে রেডিওর নব ঘোরাতে ঘোরাতে আচমকা ধরা পরেছে পাকিস্তান রেডিও। ওপার থেকে সহর্ষ সংবাদ পাঠক চোস্ত বাংলায় বলে উঠলেন, “খবর পাওয়া যাচ্ছে, এই মাত্র বর্ধমান শহর দখল করেছে ইয়াইয়া খানের সেনাদল। বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ে ব্যাপক বোমাবাজি এবং অগ্নিসংযোগ।“ কিন্তু? “তবে আর বলছি কি?” অট্টহাস্যে ফেটে পড়ে খুড়ো। ঘাড় ঘুরিয়ে তাকায় বাপি, ম্যাডাম এমন হাসতে হাসতে বিষম খেল কেন?
বড় সাধ করে লাগিয়ে ছিলাম গাছগুলো, বুড়ো কালেক্টরেটের ঝুলবারন্দা জুড়ে, প্রত্যেকের নামে একটা করে গাছ। যেখানে জুঁই গাছের নাম সঞ্চিতা, পাম গাছের নাম কৌশিক। ক্রোটনের নাম নির্মল আর প্রীতির হাজারি গোলাপ। জিজ্ঞাসা করেছিলাম, “আপনার নামে কি গাছ লাগাব স্যার?” চন্দননগরের বড় সাহেব, অনেক ভেবে জানিয়েছিলেন, “একটা লেবু গাছ লাগাতে পারো? লেবু পাতার গন্ধটা বড় বেশী মনকেমনিয়া।”। শুভজিৎ চেয়েছিল তুলসী গাছ। চুপড়িতে করে নীল রঙের কি যেন ফুলের গাছ এনে বসিয়েছে রমেশ। আপিসের দিনগুলোতে নিয়ম করে জল দেন বর্মণ সাহেব। আর ছুটির দিনে ? কেন, অজিত দা আছে না। অথচ অজিত দার নামেই বসানো হয়নি কোন গাছ। এই শীতে বসাতেই হবে, যদি থাকি। প্রথম বর্ষার দাপটে সব কটা টবে গজিয়ে উঠেছে আগাছা। কম্প্যুটর ছেড়ে উঠে দাঁড়ায় সোমনাথ, “একটা খুরপি লাগবে ম্যাডাম। আর এক প্যাকেট সার।“ “চা পাতা দিয়ে দেব নাকি?” কাঁচের গ্লাসে চা ঢালতে ঢালতে মাতব্বরি ধাঁচে জানতে চান কালেক্টরেটের সুজয় বাবু। আমার জন্য চা আনলেই, কৌশিক দৌড়ে জানতে চায়, “গ্লাস ধুয়ে এনেছেন তো?” বললেই তিড়িং করে চটে যান সুজয় বাবু।
পিছন থেকে ডাকেন অজিত দা, “ম্যাডাম, আপনি কোথায় আগাছা দেখলেন?” প্যারেড করি দুজনায়, সব টব চাঁচাপোঁচা, সদ্য খুঁড়ে দেওয়া হয়েছে সবার মাটি। হেসে উঠি দুজনায়, এই না হলে অজিত দা, বুড়ো হাড়ে এখনও তাক লাগিয়ে দেন। সোমনাথ আর আমার কথোপকথনের মাঝেই সারা সব কাজ। নাঃ দাঁড়ান, এখনও বাকি একটা কাজ, এক লিটার রং এনেছে অমৃতাপতি কৌশিক। করিডরে দু মিটার ছাড়া ছাড়া গোল্লা পাকাতে হবে, বড় ভিড় হচ্ছে আজকাল। পঞ্চাশ টাকারও মেডিক্যাল ক্লেম করছে মানুষ। সেদিন একটা ৪৩টাকার ক্লেম নাকচ করা হয়েছে আপিস থেকে, বিলে নাম বা তারিখ লেখা ছিল না। কাঁচা বিল। আজ একটা ক্লেম পেলাম, বাচ্ছাটা অপুষ্টিতে ভুগছে, দামি হেলথ ড্রিঙ্ক কিনেছে মা। এর ওপর বেতন না পাওয়ার অনুযোগ আসছে ভুরি ভুরি।
মিটিং এর ফাঁকেই ঢলে আসে বেলা। পশ্চিম আকাশে এক রাশ লালিমা ছড়িয়ে অস্ত যায় শুক্রবারের সূর্য। ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখে যায় বিদ্যুৎ আর রমেশ। স্যার কি এলেন? আর কখন আসবেন রে বাবা? তিনটে নাগাদ কেক কিনে এনেছে ওরা, সাত বার গুণে গুণে ফোন করেছে আমায়, কি লেখা হবে কেক-এ? “হ্যাপ্পি বার্থ ডে জেএলসি স্যার?” এই না, এটা লিখলে হেব্বি খচে যাবেন স্যার। লকডাউনের মাঝেই কেটে গিয়েছিল স্যারের জন্মদিন, সেদিন শুকনো শুভেচ্ছা জানানো ছাড়া করা যায়নি কিছুই। আজ পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক, আপিস তো আসতেই হচ্ছে সকলকে। আর চুঁচুড়া আপিসের একটা দস্তুর তো আছে না কি-
তবে কি লেখা হবে? শুধু স্যার? অধৈর্য হয়ে ওঠে ওরা, কেক আসার আগেই যদি স্যার এসে যান তাহলেই কেস জন্ডিস। শুধু কিংশুক? নাকি কিংশুক স্যার? রীতিমত ব্রেন স্টর্মিং করে লেখা হল স্যারের নাম। কেনা হল মোমবাতি। রঙ মশাল গুলো থেকে বড় ঝরে পড়ে বারুদ। নিপুণ হাতে সাজানো হল মোমবাতির চক্রব্যূহ, রাংতায় মোড়া হল টুকটাক উপহার। চন্দননগরের বড় সাহেবকে বড় ভালোবাসে এরা। কেমন মাটির মানুষ। বকাবকি করেন না, উলটে প্রশ্রয় দেন অঢেল। একরাশ শুভেচ্ছার মাঝে, আগে পিছে স্যানিটাইজ করে, বাতি না নিভিয়েই কেক কাটলেন স্যার। বুড়ো অজিতদা নালিশ করে গেল, কাজ বাড়িয়েছে মেয়েগুলো। ছদ্ম বিরক্তি মিশিয়ে, কোথায় কোথায় ক্রিম লাগিয়েছে তার লম্বা ফিরিস্তি দিয়ে গেল অজিত দা, তার মধ্যে ছিল অজিতদার গালও। হাসব না রেগে যাব, এই দোদুল্যমানতার মধ্যেই শেষ হয়ে আসে দিনটা, বুঝতে পারি আবার বদলাচ্ছে মরশুম- মনেরও বুঝি মরশুম থাকে। ভালো থাকতে গেলে, বুঝি ভালো রাখতেও হয়।
No comments:
Post a Comment