Thursday 25 June 2020

অনির ডাইরি ২৩ই জুন, ২০১৬

অনির ডাইরি ২৩ই জুন, ২০১৬
আমাদের বাড়িটা বেশ পুরানো। বাবার ঠাকুরদা যখন বানিয়েছিলেন তখন বাস্তুভিটা সহ সংলগ্ন জমির পরিমাণ ছিল সাড়ে সাত বিঘা। যার মধ্যে দুটি বিশাল পুকুর ছিল, একটি সর্বসাধারণের জন্য এবং অপরটি বাড়ির মেয়েদের জন্য খিড়কি পুকুর। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধান্তে যখন ভাঙন ধরল, তখন অনেকটা জমিই বিক্রি করে দেওয়া হল। আমাদের জ্ঞানত শুধু বাস্তুভিটাটুকুই ছিল, যার পরিমাণও কিছু কম ছিল না, খাতায় কলমে চোদ্দ কাটা। যদিও পরবর্তীকালে মেপে এগারো কাটা পাওয়া গিয়েছিল, বাকি তিনকাটা জমি কবে যেন চুরি হয়ে যায়।

এতবড় বাড়িতে যত না মানুষ, তার থেকে অনেক বেশী ছিল গাছপালা। সুউচ্চ সদর দরজা দিয়ে ঢুকলে প্রথমেই চোখে পড়ত এক বিশাল কাঁঠাল গাছ। আমাদের বাড়ির নামই ছিল “কাঁঠালগাছওয়ালা বাড়ি”। কাঁঠাল গাছের তলা দিয়ে এগিয়ে এলেই অতিকায় শান বাঁধানো উঠোন। উঠোনের পূর্ব দিকে ছিল একটা আম গাছ, এত মিষ্টি আম আমি জীবনে খাইনি। তার পাশে ছিল একটা নাগকেশর গাছ, উঠোনের পশ্চিম কোনে ছিল বিশাল বেল আর পেয়ারা গাছ। আবার বলছি এত মিষ্টি পেয়ারা খুব কম খেয়েছি। এই আম এবং পেয়ারার লোভে আসত হনুমানের দল। আমাদের বাড়িতে হনুমানের উৎপাত ছিল প্রবাদ প্রতিম।
তখনও চাটুজ্জে বংশের দুর্দিন শুরু হয়নি। দাদু ছিলেন খুব শৌখিন।দোতলার দালানে বিশাল বেলজিয়াম গ্লাসের আয়না ওলা টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে দাড়ি কামাতেন। টেবিল ভর্তি থাকত দামি দামি ফরাসি আফটার শেভ আর পারফিউমের বোতলে। সেসব কাটগ্লাসের বোতলের ভগ্নাংশ মাত্রই আমরা দেখেছি। যাই হোক দোতলার দালান জুড়ে ছিল ৯টা গারদহীন ফ্রেঞ্চ উইন্ডো।  পাশেই ছিল আম গাছটা, একদিন হনুমান ঢুকে দাদুর দামি আফটার শেভ খেয়ে নিয়েছিল। তারপর সেই মাতাল হনুমান নাকি শোলের ধর্মেন্দ্রর মত দোতলার বারন্দা থেকে “সুসাইড” করতে গিয়েছিল। পরিস্থিতি এমন দাঁড়ায় যে মেজদাদু আর ছোটদাদু নীচে শতরঞ্চি নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল সেই মাতাল হনুর মাৎলামির গল্প আমরা রোজ একবার করে ঠাকুমার কাছে শুনতে চাইতাম।
জেঠুর সাথে হনুমান গুলোর ছিল বেজায় দোস্তি। দোতলার বারন্দায় দাঁড়িয়ে, জেঠু উদাত্ত গলায় ডাকত, “আয়-আয়-আয়-আয়-আয়”। অমনি দুদ্দাড় করে ছুটে আসত হনুমানের দল। জেঠু একটা একটা করে কলা বাড়িয়ে দিত, ওরাও লক্ষ্মী ছেলের মত নেমে এসে একে একে নিয়ে যেত। এরকমই একদিন জেঠু হনুমানকে কলা  খাওয়াচ্ছিল, উল্টো দিকে রান্নাঘরের সামনের রোয়াকে বসে বাবা ভাত খাচ্ছিল, পাশে ঠাকুমা বসেছিল। শেষ পাতে দুধভাত খেতে খেতে হঠাৎ কি ভাবল বাবা কে জানে, এক গাল দুধ ভাত নিয়ে ওপর দিকে দেখিয়ে বলল, “খাবি?”হনুমানটা তৎক্ষণাৎ কলার খোসাটা ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে সড়সড় করে নেমে এসে সোজা বাবার কোলে। কোলে বসে হাত বাড়িয়ে দিল, হনুমানের গায়ে নাকি সাংঘাতিক দুর্গন্ধ হয়, বাবার অন্নপ্রাশনের ভাত গলা দিয়ে বেড়িয়ে আসতে চাইছিল, তারওপর হনুমানের বিখ্যাত চড়ের ভয়। ভয়ে বাবার গলা দিয়ে আওয়াজ বের হচ্ছিল না, কোনমতে ঠাকুমাকে জিজ্ঞেস করল, “মা কি করব?” ঠাকুমার বরাবরই ভয়ানক সাহস,  নির্বিকার চিত্তে বলল, “ডেকেছ যখন, ওর হাতে ভাতটা দাও।“একগাল ভাত খেয়েই কিন্তু হনুমানটা বাবার কোল ত্যাগ করে, আর জ্বালায়নি।
আমার মা এবং কাকিমা দুজনেই চাকুরীরতা ছিলেন। আমরা তিন জেঠতুতো খুড়তুতো ভাইবোন ঠাকুমা-পিসির কাছেই মানুষ। তারমধ্যে আমি আর আমার খুড়তুতো ভাই অয়ন হলাম কয়েক মাসের ছোটবড়। দুটো সমবয়সী বাচ্ছার দেখাশোনা করা মোটেই সহজ কাজ ছিল না। বাচ্ছা দেখার কোন লোক ঠাকুমা রাখতে দিত না, বিশাল সংসার এবং দুটো দুধের বাচ্ছার দায়িত্ব একাহাতে সামলাতে হত ঠাকুমা-পিসিকে। দুপুর বেলা খাইয়ে দাইয়ে ঘুম পাড়িয়ে আমাকে রেখে আসা হত দোতলার উত্তর পশ্চিমের ঘরে, ঠাকুমার বিয়ের বিশাল উঁচু খাটে, চারদিকে বালিশ দিয়ে ঘিরে। আর ভাইকে শোয়ানো হত একতলার দক্ষিণ পশ্চিম দিকের ঘরে একই ভাবে। মাঝে মাঝে পিসি এসে দেখে যেত ঘুম থেকে উঠেছি কি না। একদিন এরকমই দেখতে এসে দেখে দুটি অতিকায় কালো মুখো হনুমান আমার পাশে খাটে বসে আছে। পিসিকে দেখেই দুজনে দাঁত খিঁচিয়ে উঠেছে, ভয়ে পিসি তো প্রবল চিৎকার জুড়ল। কি ভাগ্যি সেদিন ও জেঠু বাড়িতে ছিল, ঝুল ঝাড়া নিয়ে দুটোকে তাড়া না করলে কি হত কে জানে। আমৃত্যু অবশ্য জেঠু আমাকে খেপাত যে আসলে ওটা ছিল হনুমান রুপী রাজপুত্র। জেঠু অবশ্য সর্বত্রই আমার জন্য ছদ্মবেশী রাজপুত্র দেখত। আমাদের একটা বিশাল হুমদো হুলো ছিল। তাকে দেখলেই ভয় করত। নাম ছিল “অমিতাভ”। মাঝে মাঝেই সে চার হাতপা উল্টে মরার ভান করে পড়ে থাকত। গোটা বাড়ির লোক এককাট্টা হয়ে যখন সিদ্ধান্ত নিত, যে এই মরা বিড়ালটাকে কে কোথায় ফেলতে যাবে, অমনি তিনি আড়ামোড়া ভেঙ্গে উঠে বসতেন। যখনি আমি একা দোতলা থেকে একতলায় নামতে যেতাম, ঠিক তখনি তার একতলা থেকে দোতলায় ওঠার প্রয়োজন পড়ত, মাঝপথে দেখা হত দুজনার, অমিতাভ মুচকি হাসত, মানে হাসত কিনা জানি না,মনে হত। আসলে আমি তখন বড়ই ছোট, আমি কিছুতেই  হাসতে পারতাম না, উল্টে চিল চিৎকার জুড়তাম, যতক্ষণ না সকলে লাঠিসোটা নিয়ে দৌড়ে আসত এবং অমিতাভ সিঁড়ির জানলা গলে ফুড়ুৎ হত। প্রতিবারই জেঠু বলত, “এ হে হে, ভয় পেলে হবে? ওটা বেড়াল ছিল না, ওটা ছিল বেড়াল রূপী রাজপুত্র।“ সত্যি কি মিথ্যা অবশ্য শৌভিক ভট্টাচার্যই বলতে পারবে।
(চলবে?)

No comments:

Post a Comment