শত অনুরোধেও আমার কাছে চুল কাটতে রাজি হয়নি শৌভিক। মাঝেমাঝেই সন্দেহ হয়, ছুরিকাঁচি হাতে বোধহয় আমায় তেমন বিশ্বাস করে না আমার বর। ছোট থেকে তুত্তুরীর চুল তো আমিই কাটতাম- তারও আগে আমার কৈশোরে নিজের চুলও কম কাটিনি। গ্রীষ্মের ছুটির দুপুর গুলো কেমন যেন কুহকিনী ছিল, বড়রা সবাই আপিস বেরিয়ে গেলেই যেন ঝিমিয়ে পড়ত, দেড়-দুশো বছরের বুড়ো বাড়িটা। উত্তরপশ্চিমের ঘরের দেওয়াল জোড়া চার-চারটে সাতফুট লম্বা জানলার কাঠের খড়খড়ির ওপারে দিগন্ত ছোঁয়া ঝকঝকে নীলাকাশ। যেন থমকে দাঁড়াত সময়, বহুপঠিত শিশুসাহিত্য- জ্যাঠাইমার কাঠের তলা থেকে সন্তর্পণে বার করে আনা লাল হতে বসা আলোকপাত আর বাতায়ন, গোবিন্দা আর মন্দাকিনীর উত্তেজক ছবিওয়ালা হদ্দবুড়ো সিনে অ্যাডভান্স সব যখন মুখস্থ হয়ে যেত, তখন সময় কাটানোর সেরা মাধ্যম ছিল, নিজের চুল কাটা।
পূবের দেওয়ালে ডিম্বাকার আয়নার সামনে কোন এক সন্ধ্যায় মুনাই আর আমি ব্লাডি মেরি খেলেছিলাম। আজ লিখতে বসে প্রবল হাসি পেলেও, তৎকালে আমাদের গভীর বিশ্বাস ছিল, চুপিচুপি গভীর রাতে, মোমবাতির আলোকে আয়নাটার সামনে দাঁড়িয়ে একটি টুকটুকে লাল আপেলে কামড় মেরে যদি তিনবার, “ব্লাডি মেরি-ব্লাডি মেরি-ব্লাডি মেরি” বলে চিৎকার করা হয়, তাহলে আয়নায় ফুটে উঠবে হবু জীবনসঙ্গীর প্রতিচ্ছবি। গভীর রাতে ফাঁকা ঘরে স্বয়ং জগজ্জননীকেও ডাকার মত সাহস ছিল না আমাদের, অগত্যা গভীর রাতটা নেমে এসেছিল রাত নটায়, একতলায় সবাই তখন মজে ছিল দূরদর্শনে, আমরা দোহে পাড়ি দিয়েছিলাম অভিসারে। বলাইবাহুল্য ব্লাডি মেরি কোন কৃপা করেনি। তবে ডিম আয়নাটার সাথে দোস্তি জমে উঠেছিল ব্যাপক। নিঃসঙ্গ দুপুর গুলোতে আয়নার ওপাশের মেয়েটা কেবল উস্কাত, “একটু খানি। কুচ্ করে। ধরতেও পারবে না, মা। ” কি ভয়ানক মিথ্যে বলত মেয়েটা, মা আপিস থেকে ফিরেই ধরতে পারত এবং গদাগুম গদাগুম-
তুত্তুরী হবার পরও দেড় বছর অপেক্ষা করতে হয়েছিল শাশুড়ী মায়ের নির্দেশে। দেড় বছর পূর্তির দিনই জম্পেশ হেয়ারকাট উপহার দিয়েছিলাম কন্যাকে। তাতে যদিও প্রভূত হাউমাউ জুড়েছিল আমার মা, জানতাম ওসবে কান দিতে হয় না। প্রচণ্ড গম্ভীর মুখে বাবা শুধু বলেছিল, “অ্যাঃ জেলে এমন ভাবে চুল কেটে দিত আমাদের। খামচা খামচা-”। সেই থেকে তুত্তুরীর হেয়ারকাটটার নামই হয়ে গেল খামচাকাট। বছর দুয়েক অবধি দিব্যি লক্ষ্মী মেয়ে হয়ে কাটত চুল, তারপর গজালো ডানা এবং পাখনা। পর্যায়ক্রমে কন্যা এবং কন্যার দিদিমার। রীতিমত হেঁকে ডেকে বিশেষজ্ঞ আনিয়ে কাটা হত চুল। প্লাস্টিক শিট পরে গুড়িয়া পুতুলের মত চুল কাটতে বসত তুত্তুরী। নেপালী ববি মাসির বাড়িতেও ছিল এমন এক পিস্ স্যাম্পল। আধো আধো বাংলায় সেই ভাইটার গপ্প শোনাত ববি মাসি, যাবার সময়, বাতিল হয়ে যাওয়া সিলভার ফয়েলের রোল, সেকশন ক্লিপ উপহার দিয়ে যেত তুত্তুরীকে।
ইদানিং তো বাতানুকূল পার্লারে চুল কাটতে যেত তুত্তুরী। কতবার বলতাম, ১৮শতাংশ জিএসটি নেয় ব্যাটারা, আমি কাটলে ঐটা তো -ইয়ে মানে মুকুব-
বলে না, গরীবের কথা বাসি হলে মিষ্টি হয়। লকডাউনে কেমন জঙ্গল বাঁধিয়েছিল তুত্তুরী। ভাগ্যিস এই শর্মা ছিল, আর ভাগ্যিস আমার মা ত্রিসীমানাতেও ছিল না, তাই না-। যেদিন তুত্তুরীর কেশ কর্তন করলাম, তারপর থেকে অন্তত হাজার চারেক বার বলেছি, “আয় তোরটাও-”। আরেঃ ঐ মার্কেটের বিহারী সেলুনওয়ালার থেকে খারাপ তো কাটবই না। বলে না গৃহপালিত মোরগের মাংসের সোয়াদ ডালের মত-
তবে আমার শ্বশুরমশাই সাগ্রহে বাড়িয়ে দিয়েছেন মস্তক। শাশুড়ী মায়ের যদিও দাবী, উনিও সদ্য খোলা সেলুনের দিকেই পা বাড়াচ্ছিলেন, শাশুড়ী মাতার তীব্র ধমকে কিঞ্চিৎ ব্যোমকে গেছেন। একে দু-দুবার ক্যান্সার বিজয়ী, তায় আবার ক্রনিক সিওপিডির রুগী- মোদ্দা কথা ভ্যাকসিন না বেরোলে ওণার সেলুন যাত্রা বন্ধ। সুতরাং চলচ্চিত্র এখনই শেষ নয় বন্ধু, সবে তো শুরু। মাস দুয়েক বাদে আবার -
ছবিতে টেরি বাগিয়ে দাদু এবং নাতনী, নাতনী তেমন খুশি না হলেও, ঠাম্মা বেজায় খুশি। আর ঠাম্মার খুশিতেই খুশি দাদু- এবার হাওড়ার দাদুর পালা। তিনি অবশ্য আজ থেকেই গান ধরেছেন, “এখন চুল কাটতে গুরুর মানা আছে-”। বলি তোমার আবার গুরু কোথা থেকে এল গো বাবা, অ্যাঁ?
No comments:
Post a Comment