Wednesday 17 June 2020

অনির বচন

অনির বচন #৫ ১৬ই জুন, ২০২০
কি খোরাক মাইরি। ঘরে ঘরে বিশেষজ্ঞ। কত রকম থিয়োরি। পাইকারি হারে মনের যত্ন নিন। কত রকমের সদুপদেশ-
১।  চাপ নেবেন না। মনের কথা খুলে বলুন। কাকে মশাই? আপনাকে? আপনি শুনবেন তো? কখনও প্রকৃত মানসিক অবসাদ গ্রস্ত ব্যক্তির সান্নিধ্যে এসেছেন? না না, ব্যর্থ প্রেম বা পেশাগত ব্যর্থতা বা প্রিয়জন বিরহে সাময়িক কাতরতা  নয়, আসল হার্ডকোর ডিপ্রেসন- যদি এসে না থাকেন, তাহলে বুঝবেন না, ঐ ভাবে যার তার কাছে প্রাণ খুলে কথা  বলাটা ওণাদের পক্ষে কতটা দুরূহ। আরেঃ ওণারা তো জানেনই না যে ওণারা মানসিক অবসাদের শিকার। এত জোর গলায় কি করে বলছি? তাহলে শুনুন, জনৈক পরিচিত ব্যক্তি একদিন আচমকা অন্ধ হয়ে গেলেন। হাতড়ে হাতড়ে সারা বাড়ি ঘুরতে লাগলেন আর বারংবার বলতে লাগলেন, “আমি তো চোখে দেখতে পাচ্ছি না। কি হবে? হে প্রভু আমায় কানা করে দিলে?” অথচ দূরে দেওয়াল ঘড়িতে কটা বাজছে উনি দিব্যি বলে দিচ্ছেন, বাড়ির লোক বারবার বোঝাল, কোন লাভ নেই। সকাল দুপুর রাত শুধু একই বচন- পরিশেষে নিয়ে যাওয়া হল ডাক্তারবাবুর কাছে, তিনি রায় দিলেন ভদ্রলোক মানসিক অবসাদ গ্রস্ত। সুপার স্পেশিয়ালিটি হাসপাতালের বড় ডিগ্রীওয়ালা মানসিক ডাক্তার (গুগল করা নয়) দেখানো হল, দু এক ডোজ ওষুধ পরার সাথে সাথেই সরে গেল চোখের পর্দা। ভদ্রলোক এখনও নিয়মিত ওষুধ সেবন করে চলেছেন।
তো প্রশ্ন হচ্ছে, দৈনন্দিন কর্মব্যস্ত জীবনে একজন মানসিক অবসাদ গ্রস্ত মানুষের একঘেয়ে ঘ্যানঘ্যান( সচেতন শব্দপ্রয়োগ) আধ ঘন্টার বেশী সহ্য করতে পারবেন তো? আর মন খুলে যদি উনি আপনাকে ওনার সমস্যা জানানও আপনি কথা দিতে পারেন যে আপনি তা একদম গোপন রাখবেন? দিন বদলের দিনে পরচর্চার আসরে পান আর মৌরি মিশিয়ে পরিবেশন করবেন না গরম-গরম? আরেঃ ঘরের সামনে পরের বাচ্ছাদের কলকাকলিই সহ্য হয় না আমাদের, মাত্রাতিরিক্ত শোরগোলের অপরাধে ক্রন্দনরত দেড় বছরের শিশুকে ছুঁড়ে ফেলে দেওয়া ছাত থেকে, করোণার প্রকোপে সদ্য পিতৃমাতৃহীন অনাথ তরুণী মেয়েটাকে একঘরে করে তার দরজায় সাঁটিয়ে দিই নোটিশ- আর আপনি বুলি কপচাচ্ছেন প্রাণ খুলে কথা বলুন।

২।  আরও কত কি, আইকিউ-ইকিউ- একিউ এর ফাণ্ডা। আমার জনৈকা প্রিয়তম বান্ধবীও দেখলাম এই রকম একখানি জব্বর লেখা শেয়ার করেছে। ও জানে না বুঝলাম, কিন্তু প্রশাসনিক বিভিন্ন ট্রেনিং তথা নানা কর্পোরেট ট্রেনারদের সান্নিধ্যে থাকার দরুন এগুলি আমার অনেকটাই চেনা বুলি। কত রকমের কোশেন্ট হয়, কত রকম ইনটেলিজেন্স হয়- ইমোশনেরও ইন্টেলিজেন্স হয়। বিশাল দামী ট্রেনার এসে ঠাণ্ডা ঘরে, মস্ত বোর্ডে পিপিটি বা ভিডিও চালিয়ে, অথবা সাজানো বাগানে টানা অ্যাক্টিভিটি করাতে করাতে মৃদুমন্দ সুরেলা পেশাদারী স্বরে এসব বলেন- আবার বলি, একজন প্রকৃত অবসাদ গ্রস্ত প্রিয়জনকে এসব বোঝান দিকি। তিনি শুনবেন হয়তো। বুঝবেন কি? তার থেকে বড় কথা হল বোঝার কথা কি? বিশেষ সমস্যাগুলি বিশেষজ্ঞের সাথেই ছেড়ে দিলে ভালো হয় না?

৩। তৃতীয়তঃ যে পয়েন্টটা সবাই লিখেছেন দেখলাম, বাচ্ছাদের চাপ দেবেন না। আরে দূর মশাই, কোন বাবা-মা সচেতন ভাবে বাচ্ছাদের ওপর এমন চাপ দিতে চান বলতে পারেন, যাতে সে মানসিক অবসাদগ্রস্ত হয়ে পড়ে? বাচ্ছার ভবিষ্যৎ সুরক্ষিত রাখার জন্য তাকে পরীক্ষায় ভালো ফল করতে কি আমাদের বাবা-মা বলেননি? আপনি বলেন না বুঝি?  আর এই যৌথ পরিবার না থাকা বা ইঁদুর দৌড় এসব নিয়ে যদি আপনার আপত্তি থাকে তাহলে বিকল্প ব্যবস্থাটা কি সেটা তো বলুন।

সুশান্তর মৃত্যুটা ভয়ানক বেদনাদায়ক। আমার মতই আপনিও হয়তো ভুগছেন ডিনায়ালে। বাঁধা বুলি কপচে, গর্তের মধ্যে মাথা গুঁজে ভাবছেন খুব সহজ এই সমস্যার সমাধান। একবারও ভাবলেন না, এত যদি সহজ হত, সুশান্ত নিজেই কি করত না তার সুরাহা। বা মানসিক অবসাদে ভোগা সকলেই কমবেশী অবগত আছেন এই বিষয়গুলি নিয়ে। তবুও  হতাশার কোন চরম বিন্দুতে পৌঁছে মানুষ ছেড়ে দেয় জীবনের হাত তা অনুভব করা কি সহজ সহজ? ও পথে বরং না হাঁটাই ভালো।চে জানে, যদি না ফিরে আসা যায়। মোদ্দা কথা, করোনা ক্যান্সার বা এইডসের মত ডিপ্রেশনও এক মারাত্মক ব্যাধি। যার থাবা কতদূর বিস্তৃত কেউ জানি না, এটাই ধ্রুব সত্য আর কিছু না-

No comments:

Post a Comment