Thursday, 18 June 2020

অনির ডাইরি ১৮ই জুন ২০১৬

অনির ডাইরি ১৮ই জুন, ২০১৬
(বাবা তোমার জন্য, আরও একবার)
 সালটা সম্ভবত ১৯৫৮। ছেলেটা সবে হাওড়া আইজ্যাক রাফায়েল বেলিলিয়াস স্কুল থেকে স্কুল ফাইনাল পাশ করে নরসিংহ দত্ত কলেজে ভর্তি হয়েছে। আই এস সি ফার্স্ট ইয়ার। মহানগর তখন উত্তাল খাদ্য আন্দোলনে। খাদ্য আন্দোলন ব্যাপারটাযে ঠিক কি, ভালো বোঝে না ছেলেটা। পুজোর আগে প্রতিবছরই খাদ্য আন্দোলন হয়। জন মুখে শোনা কথা, যে অবশ্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদির অগ্নিমূল্য বৃদ্ধির প্রতিবাদে, বামপন্থীরা (সিপিআই, ফরোয়ার্ড ব্লক, বলশেভিক পার্টি ইত্যাদির সমষ্টি) প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে সমর্থকদের মিছিল করে কলকাতায় নিয়ে আসে এবং এসপ্ল্যানেডে অবস্থান বিক্ষোভ হয়।

আরো শুনেছে, যে প্রতি দিন ঠিক রাত দশটা বাজার কিছুক্ষণ আগে, পুলিশের কমিশনার সাহেব নিজে আসেন, বিশাল দলবল নিয়ে, এবং মাইকে ঘোষণা করেন, যে ঠিক পাঁচ মিনিট সময় দেওয়া হল, এর মধ্যে অবস্থান বিক্ষোভ না তুললে পুলিশ মেরে তুলে দেবে। ঘোষণা হতে থাকে এক মিনিট- দুই মিনিট-তিন মিনিট-। ইতিপূর্বে নির্বিকল্প রক্তপাত ঘটে গেছে খাদ্য আন্দোলনকে কেন্দ্র করে, “বিমলা-অমিয়া-প্রতিভার” গল্প অন্য একদিন লিখব, যদি সুযোগ পাই। যাই হোক কেউ তার দুঃসাহস দেখাতে সাহস পায় না, তিন, চার মিনিট গোনা হতে না হতেই পার্টির হুলিয়া অগ্রাহ্য করে, পুলিশের ব্যারিকেড ভেঙে সব দৌড়তে থাকে অদুরে দাঁড় করানো গোটা পঞ্চাশ স্টেট বাসের দিকে। গ্রামের গরিব গুর্বো চাষিভুষির দল, পুলিশ গ্রেপ্তার করার আগেই বাসে উঠে বসে পড়ে, যারা সিট পায়না তারা দাঁড়িয়ে বা মেঝেতে বসে পড়ে।পুলিশের বীভৎস মারের হাত থেকে বাঁচতে এভাবেই স্বেচ্ছা গ্রেপ্তার বরণ করে নেয়। তারপর সেই বাস নিয়ে যাওয়া হয় প্রেসিডেন্সী বা দমদম সেন্ট্রাল জেলে।

আটান্ন সালেও এর ব্যতিক্রম হল না। অবস্থান বিক্ষোভ ছত্রভঙ্গ হয়ে যাবার পর পার্টি গুলো সাহায্য চাইল ছাত্রদের কাছে। তখন এসএফআই ছিল না,বামপন্থী ছাত্র সংগঠনের নাম ছিল, এআইএসএফ, তারা ছাত্র আন্দোলনের ডাক দিল। এলিট ছাত্র পরিষদের কিছু ছাত্রও এগিয়ে এল গরিবগুর্বো চাষিভুসি গুলোর সমর্থনে। নরসিংহ দত্ত কলেজকে বলা হত, “হাওড়ার প্রেসিডেন্সী”। ছাত্র রাজনীতিতে বরাবরই অগ্রণী, বিশাল মিছিল বের হল ছাত্রদের। আমাদের সদ্য কলেজে ঢোকা ছেলেটিও যোগ দিল। ব্রেবর্ণ রোড দিয়ে যেতে দিল না এদের, টি বোর্ডের পাশ দিয়ে ডেকার্টস লেন হয়ে বেন্টিঙ্ক স্ট্রীট আটকে দিল আমাদের হাওড়ার ছেলে গুলো। অন্যান্য কলেজ থেকেও ছাত্রদের মিছিল এসে মিলিত হল, স্টেটসম্যানের অফিসের সামনে চলতে লাগল অবস্থান বিক্ষোভ। ঘড়ির কাঁটা সন্ধ্যা পেরিয়ে এগোতে লাগল রাতের দিকে। পৌনে দশটা নাগাদ এলেন কমিশনার সাহেব,পাঁচ মিনিটের ঘোষণাও চলতে লাগল, কিছু ছেলেপুলে পালিয়েও গেল, আমাদের ছেলেটি কিন্তু পালাল না, মানে দৌড়ল, কিন্তু  দাঁড়িয়ে থাকা স্টেটবাস গুলোর দিকে।
ছাত্রদের নিয়ে যাওয়া হল প্রেসিডেন্সী জেলে। ছেলেটির মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল, তার মানে আজ রাতে হাজতবাস? কি হবে? বাড়ির লোক তো কিছুই জানে না? আর জানতে পারলে কি আর বাড়িতে ঢুকতে দেবে? রাতটা যে কি ভাবে কাটল, কে জানে, সকাল বেলায়, সেল থেকে বার করে, খাইয়ে দাইয়ে, খানিকক্ষণ জেল ইয়ার্ডে ঘুরিয়ে আবার সেলে পুরে দেওয়া হল। মন খারাপ করে বসে আছে ছেলেটা, আচমকা শুনতে পেল, অবাঙালি ওয়ার্ডেন সেলের সামনের করিডর বেয়ে ছেলেটির নাম, হাওড়া এবং কলেজের নাম হাঁকতে হাঁকতে যাচ্ছে। পাশ থেকে একজন সিনিয়র বলল, “খবরদার সাড়া দিসনি। বার করে নিয়ে গিয়ে পিটিয়ে মেরে ফেলবে।“ ছেলেটি তো ভয়ে টুঁ শব্দ করেনি, কিন্তু অন্য সেল থেকে পরিচিত ছেলেরা কমরেড, কমরেড করে চিৎকার করতে থাকায়, ছদ্ম বীরত্বের সাথে ষোল সতেরো বছরের ছাতি ফুলিয়ে সাড়া দিতে বাধ্য হল।
ছেলেটিকে বার করে নিয়ে আসা হল, একটি বড় ঘরে, প্রতি মুহূর্তেই ভয় তাকে কাবু করে ফেলছে, আর কোনদিন মায়ের মুখ দেখতে পাবে না, উদ্গত কান্না গিলতে গিলতে গিয়ে হাজির হল একটা সাবেকী সিনেমার কাউন্টারের মত খুপরির সামনে, ওয়ার্ডেন বলল, “লো বাত করো।“ অবাক ছেলেটি তাকিয়ে দেখে খুপরির ওপাশে তার বাবা। এইরে হাত ঢুকিয়ে নির্ঘাত এক চড় মারবে, তারপর বলবে, “তোর মত কুলাঙ্গারের আর বাড়ি ফেরার দরকার নেই। তুই জেলেই পচে মর!!” ওমা ছেলেটির বাবা বরং সোৎসাহে জিজ্ঞাসা করল, “কেমন লাগছে? মারধর খেয়েছিস নাকি?” হতবাক ছেলেটি শুধু বলল, “বাবা? তুমি কি করে জানলে, আমি জেলে?” সৌম্য দর্শন ভদ্রলোক বললেন, “তুই পালাসনি বটে কিন্তু অনেকেই পালিয়ে ছিল, তেমনি একাধিক বন্ধু আজ তোর খবর নিতে আসাতে জানতে পারলাম।“ তখন সরি বলার রেওয়াজ ছিল না, ছেলেটি মাথা নিচু করে বসেছিল। জানলা গলিয়ে বাবা ছ প্যাকেট চারমিনার সিগারেট ছেলেটির হাতে দিলেন। তখন ৭৫ পয়সায় পাঁচ প্যাকেট সিগারেট পাওয়া যেত। ছেলেটি তো অবাক, বাবা সিগারেট কেন দিল? ভদ্রলোক হেসে বললেন, “জেলের নিয়ম তুই জানিস না, এখানে একটু ভদ্র ব্যবহার, এক হাতা বেশী ভাত বা একটু ঘণ ডাল পেতে গেলেও সিগারেট ঘুষ দিতে হয়।আমি চলে গেলেই এরা তোকে হাতড়ে দু প্যাকেট সিগারেট নিয়ে নেবে, বাকি প্যাকেট গুলো সামলে রাখিস, কাজে আসবে। আর একটা প্যাকেটের গায়ে ক্রশ দেওয়া আছে, ওটা লুকিয়ে ফেল, ওতে দশটা টাকা আছে, ছাড়া পেলে বাড়ি ফেরার রাহা খরচ আর যদি কিছু লাগে।সাবধানে ফিরিস, অনেক গল্প করার আছে।“

সেদিনের সেই  ছেলেটি ছিল আমার বাবা, আর সেই ভদ্রলোক? আমার দাদু। আজ সকাল থেকেই কেন জানি না, বাবার মুখে সহস্রবার শোনা দাদুর এই গল্পটাই মনে পড়ছে। হয়তো আজ ফাদার্স ডে তাই। বাবারা তো সত্যিই এ রকমই হয়, পরিস্থিতি যতই নিম্নগামী হোক না কেন, সারা দুনিয়া আপনাকে ভুল বুঝুক না কেন, সবাই, এমনকি আপনার ছায়াও আপনাকে ছেড়ে চলে যাক না কেন, বাবারা সব সময় পাশেই থাকে, নিরন্তর সাহস যুগিয়ে চলেন, “লড়, লড়ে যা। না লড়ে হারিস না। আর যদি হেরেও যাস, তাতে কি? হার জিত তো জীবনেরই অঙ্গ।“ তাই বোধহয় বাবারাই আমাদের প্রকৃত এবং ব্যক্তিগত সুপার হিরো।
 #HappyFathersDay #Makingmemories

No comments:

Post a Comment