Monday 3 February 2020

তুত্তুরী উবাচ- ৩রা ফেব্রুয়ারি, ২০২০


- “মা, এ দেখো।” জুতো খোলার আগেই সোল্লাসে বলল, তুত্তুরী। মুখেচোখে সহস্র ওয়াটের উজ্জ্বলতা।
কি দেখব? হাতে এক টুকরো, ছেঁড়া গোল কাগজ। তাতে পেন্সিল দিয়ে হিজিবিজি  কাটা। তুত্তুরী জানালো, ওটা “ক্লাব অর্ঘ্য”র সদস্য হবার অঙ্গীকার।ক্লাব অর্ঘ্যটা কি বস্তু? বুঝলাম না। বোধহয় মুখে চোখে ফুটে উঠেছিল অজ্ঞতা। তুত্তুরী জ্ঞান দেবার ভঙ্গীমায় হাত নেড়ে চোখ ঘুরিয়ে বলল, “অর্ঘ্য একটা ক্লাব খুলেছে। আমি তার সদস্য-”। তা ভালো।
জুতো খুলে, ব্যাগ রাখতে না রাখতেই, শুরু পরের পর্ব। “ মা, তুমি লেবু খাওনি? তোমার ব্যাগে চারটে লেবু আর একটা আপেল রয়েছে। ” বোঝালাম, লেবুটা ট্রেনে কেনা। আপেলটা- ইয়ে মানে,খাবার টাইম পাইনি। বিনতি করলাম, বাপকে যেন না বলে। তিনি পারলে এই বুড়ো বয়সে, কান ধরে ডনবৈঠক দেওয়ান আর কি-
হাত নেড়ে, এক চোখ বুজতে গিয়ে দুই চোখ পিটপিট করে, তুত্তুরী জানাল, বলবে না। বিনিময়ে শুনতে হবে সারাদিনের গপ্প। “মা জানো তো, যত এমব্যারাসিং ব্যাপার স্কুলেই ঘটে। আজ আমার পেট এত গোঁ গোঁ করছিল,যে সামনে-পিছনের বেঞ্চ থেকে বন্ধুরা বলল, ‘হাস্। কোয়ায়েট।’  বললাম, “নট মি। মাই টামি-”।” হাসব না কাঁদব বুঝতে পারলাম না। তুত্তুরী ততোক্ষণে অটোপাইলট মোডে, বকেই চলেছে,“অদ্রিজা দাস,বলল, ‘ডিডন্ট ইউ হ্যাভ ব্রেকফাস্ট?’” এটা অবশ্য আমারও মনে হয়েছিল। প্রাতঃরাশ ছাড়ুন। ও তো ভাত খেয়ে ইস্কুলে যায়। টিফিনে মনপসন্দ চিজ টোস্ট। তাও বেশী করে দেওয়া হয়, বন্ধুদের সাথে যাতে ভাগ করে খেতে পারে। তা সত্ত্বেও পেট গোঁ গোঁ করে কেন? জবাব পেলাম, টিফিন টাইমে,হাত ধুতে যাবার সময়, একটি টোস্ট কেউ সাবড়ে দিয়েছে। এতো নৈমিত্তিক ব্যাপার। রোজই তুত্তুরীর টিফিন কেউ সাবড়ে দেয়-। ঐ বয়সে আমারও দিত। তবে মজার কথা, আজ যিনি সাবড়েছেন, তিনি অপরাধ বোধে ভুগে, শেষ বেলায়, ঐ চোতা কাগজটি তুত্তুরীকে গছিয়েছেন। চীজ টোস্টের বিনিময়ে ক্লাব মেম্বারশিপ। মন্দ হয়। উপরি পাওনা প্রতিশ্রুতি, তার মা অচীরেই মটন চাউমিন করে দেবেন টিফিনে,তার ভাগ পাবে তুত্তুরী। কে জানে, চীজ টোস্টের দুঃখে না মটন চাউমিনের লোভে গোঁ গোঁ করে পেট-
মুখহাত ধুয়ে, চা নিয়ে বসেছি, উল্টো দিকে গুছিয়ে বসে পরের,পরের পর্ব শুরু করল তুত্তুরী। “মা জানো, সানরাইজ না সর্ষে, পোস্ত পাউডার বার করেছে-”। বিশেষ পাত্তা পেল না, দেখে আরও উৎসাহ নিয়ে শুরু  হল,“ ইমামি হেলদি এন্ট টেস্টিও বার করেছে মা। পাশের ফ্ল্যাটের ঠাম্মার রান্নাঘরে-”। এতক্ষণে চমক ভাঙল মায়ের, প্রায় বিষম খেতে খেতে জানতে চাইলাম, পাশের ফ্ল্যাটের রান্নাঘর দেখল কি করে। প্রশ্ন করার অবশ্য দরকার ছিল না, তুত্তুরী বলেই চলেছে,“ওদের রান্নাঘরে কি বিশাল একটা চিমনি লাগিয়েছে। হ্যাঁ গো মা। আমি দেখেছি। সেদিন ওদের ফ্ল্যাটে যখন রঙ হচ্ছিল,স্কুল থেকে ফেরার সময়,  আমি ওদের গ্রীলের গেটের বাইরে থেকে দেখছিলাম। ও বাড়ির ঠাম্মাটা খুব ভালো। উনিই তো ডেকে নিয়েগেলেন। সব ঘর-রান্নাঘর ঘুরিয়ে দেখালেন-। জানো ওদের বাড়ির ভাইটার সবে দুমাস বয়স, ঠাম্মা বলছিল।  আমি শুনে বললাম-এ হে হে,তোমরা এখনই ফ্ল্যাট রঙ করে নিলে? আমি তো এত্ত বড়। তাও আমি দেওয়ালে ছবি আঁকি। দেওয়াল নষ্ট করি-”।  এতদিনে বুঝলাম,কেন পাশের ফ্ল্যাটের কাকিমা দেখা হলেই তুত্তুরীর তত্ত্বতলাশ করেন। দেওয়াল রঙ করা নিয়ে মা নতুন করে কিছু বলছে না দেখে, তুত্তুরীর বোধহয় সাহস বেড়ে গেল,“মা একটা সত্যি কথা বলব? তুমি জানো আমি কি কি দিয়ে দেওয়ালে এঁকেছি আজ অবধি?” শুনে কি অষ্টাবক্র লাভ হবে জানি না, তবে কান তো বন্ধ করা যায় না। “আমি প্রথমে আঁকতাম পেন্সিল দিয়ে, তারপর চামচ দিয়ে। তারপর তোমার পুজোর ধূপ দিয়ে। স্কেচপেন দিয়ে, ফেব্রিক কালার দিয়ে, তারপর গ্লিটার পেন দিয়ে-পার্মানেন্ট মার্কার দিয়ে- ”। আর কি যে শুনতে বাকি রইল- হে ধরিত্রী দ্বিধা হও মা।

No comments:

Post a Comment