সবে তো নাম দেখানো শুরু, এখনই সাজানো কাবার প্ল্যাটারের মত সদ্য কেনা বইয়ের ছবি দিচ্ছে জনগণ।কুয়াশা কুয়াশা ভোরে, গরম কফির কাপে ঠোঁট ডুবিয়ে শৌভিক বলল,“দাঁড়া, এখনও তো অমুক বইমেলায় যায়নি। দেখবি ছবি কাকে বলে-”। নিন্দুকে যাই বলুক, মন্দ লাগে না ব্যাপারটা। এদের মধ্যে কোথাও না কোথাও খুঁজে পাই, ফেলে আসা “আমি” কে। জীবনের প্রথম মোচি, (গুচি নয়) তাও ডিসকাউন্টে কিনে এমন পুলক জেগেছিল- সটান ছবি ফেবুতে। বিদিশা দি, সেই টুনটুনির গল্পে, টুনটুনি পাখি গেলা রাজার মত মুখ করে বলেছিল,“জুতোর ও ছবি দেয় মানুষ? অনিন্দিতা?” আহাঃ কি অপরূপ সুন্দর জুতো,পাক্কা ছয় ইঞ্চি হিল- শাশুড়ি মায়ের হাঁটুর ডাক্তার ওণার হাঁটু ফেলে হাঁ করে দেখেছিলেন আমার জুতো। অসাধারণ সুদর্শন মধ্যবয়সী ডাক্তারবাবু আবার সম্পর্কে আমার অন্যতম প্রিয় সখীর ভাসুরঠাকুর। মস্তিষ্কস্থিত পদার্থটি সামান্য ধুসরতর হতেই সটান উড়িয়ে ছিলাম সেই ছবি। ছিছিছিছি ছিঃ।
তো যা বলছিলাম আর কি, বুঝলেন আসলে ব্যাপারটা আর কিছুই না, আমরা ঈর্ষান্বিত। সরস্বতী পুজো উপান্তে জমিয়ে বসেছে বইমেলা। বাতাসে এখনও মেলায়নি হিমের রেশ। মাননীয়া দিয়েছেন উপুড় করে ছুটির ভাণ্ড। মুস্কিল হচ্ছে,ব্যাপারটা অনেকটা তোমার ছুটি আমার নয় মত ব্যাপার। অনেক প্রশাসনিক দপ্তরই এই ছুটিতে খোলা- আর যে গুলি বন্ধ, তার হতভাগ্য কর্মীকুল বাড়ি বসেই সারছে কাজ।কারণ? আমার কাজ তো আমারই বাপ,তোমার তো নয়! যেমন শৌভিক দেখছে নির্বাচনে নাম তোলা বা পাল্টানোর আবেদনপত্র। আর আমি বসে বসে লিখছি গ্রাচুইটির অর্ডার। কাল মধ্যরাতে গিয়ে শেখ ইয়াকুবের (নামটা কাল্পনিক) হিসেব দাঁড়াল সুদ সমেত সাড়ে তিন লাখ। শৌভিক মুখ বেঁকিয়ে বলল, “দেবে? এত টাকা? মনে হয় না!“ বলবে নাই বা কেন? হতভাগা নচ্চার ম্যানেজার, লোকটার চাকরী জীবন থেকে, ২৩ খানা বছর সির্ফ ঝেড়ে ফেলে দিয়েছিল। দরিদ্র মূর্খ শ্রমিক, ডান থেকে বাঁয়ে সই করে নিজের নাম। সে নাকি ১৫বছর ধরে শিখেছে কাজ- আর বাকি ৮ বছরে মেরেছে ফাঁকি। তবুও ২৩বৎসরান্তে তাকে পার্মানেন্ট করেছে মালিক পক্ষ। গাঁজাখুরি আর কাকে বলে- সরকারী চেয়ারে বসে তো আর দেওয়া যায় না খিস্তি- যেটা স্বচ্ছন্দে বলা যায় ডাইনিং টেবলে কাজ সারতে সারতে।
কাল শুতে শুতে রাত দেড়টা। ভোর বেলা ঘুমে ভারি চোখে দেখি জোর তাগাদা-পর্যায়ক্রমে সুবীরবাবু এবং রঞ্জন দার। আসতেই হবে বইমেলা। আজ আমাদের বইয়ের শুভ উদ্বোধন। আমাদের বই! আজ্ঞে হ্যাঁ। সমগ্র ফেবু জুড়ে শয়ে শয়ে গ্রুপ। হাজারে হাজারে যার সদস্য। যার অনেকগুলিতে কে বা কারা যেন অ্যাডিয়েছে আমারে। কোথায় আঙুলও ছোঁয়াই না আমি। ব্যতিক্রম শুধু- হারিয়ে যাওয়ার নেই মানা। কারণ? এটা আমাদের গ্রুপ। বছর ভর গ্রুপের দেওয়ালে ভাস্বরিত লেখা এবং ছবিগুলির সংকলন আজ প্রকাশ হবার কথা- সময় দুপুর তিনটে। স্টল-২১২র নান্দীমুখ।
আর দেখলাম জনৈক সুদূরপ্রবাসিনী প্রিয়তমা বান্ধবীর ভীষণ মন খারাপ। এবারের থিম বুঝি রাশিয়া- আমাদের শৈশব জুড়ে রাশি রাশি রাশিয়ার কথা। চকচকে সাদা পাতায় ঝকঝকে গল্প। রঙচঙে মলাট। পুজোর ছুটি হোক বা গ্রীষ্মের ছুটি, অথবা পরীক্ষা শেষের লম্বা ছুটি। নিঃসঙ্গ দুপুরে,ঘড়ঘড়ে পাখার তলায়,উপুড় হয়ে, পাতা উল্টোলেই গরমের দেশে লালিতপালিত একদল বাচ্ছা ঝপ্ করে গিয়ে পৌঁছত বরফের দেশে। তারপর? হত কত কি। কখনও তিমুর ও তার দলবলের সাথে অ্যাডভেঞ্চার- তো কখনও রাজপুত্র আর রাজকন্যার চিরকালীন প্রেম। কোথায় যেন হারিয়ে গেল বইগুলো, আমাদের ছোট বেলার মত- বন্ধু শুনেছে ঐ বইগুলোই নাকি পাওয়া যাচ্ছে বইমেলায়- রাশিয়ার স্টলে। অফিস-সংসার দশহাতে সামলে আর আসা হবে না এবছর। প্রচণ্ড দস্যি খুদেটার বোধহয় আর পড়া হল না কুড়ুলের জাউ বা দুষ্টু পেঁচার ছানার গল্প-
হোয়াটস্অ্যাপ বন্ধ করে ভাবলাম- নাঃ। এত চাপ নেওয়া যায় না। চালাও পানসি বইমেলা,ভায়া হাওড়া অবশ্যই। বাবা- মা- পিসিকে আলিঙ্গন করে, তরতরিয়ে বেড়ে ওঠা বুল্লু বাবুর, ফুটবল খেলে ফেরা নোংরা আঙুল কামড়ে খানিক থুঃ ছিটিয়ে(আহাঃ নজর না লাগে) পেটপুরে মায়ের হাতের মাংসভাত খেয়ে যখন বেরোচ্ছি, ছোট্ট কাগজে লেখা বাবার আব্দার- সৃষ্টিসুখ থেকে রোহন কুদ্দুসের লেখা রাজদ্রোহ বইটা যদি-।
হল। হল। সবই হল। ঘোরাও হল। কেনা হল রাজদ্রোহ। রূপম দা-শর্মিষ্ঠাদিদের সাথে দেখাও হল। সেই খড়্গপুর থেকে শুনে আসছি ওণাদের গল্প- দাদাদিদি বলব না স্যার-ম্যাডাম বলব, সেই টেনশনে বেশ খানিকক্ষণ ধ্যাড়ালাম দুজনে। থাকলাম সপরিবারে হারিয়ে যাওয়ার বই উদ্বোধনে। মাথায় টুপি পরে,সুবীর বাবু- অদিতি দি আর রঞ্জনদার মাত্রাতিরিক্ত খাতিরে, ভিআইপি সুলভ বেজায় বেজার মুখে বই উদ্বোধন করল তুত্তুরী। পাশ থেকে সুবীর বাবু বললেন,“ফিশফ্রাই খেলেই দিলখুশ হয়ে যাবে তুত্তুরীর-”। কে যেন জানতে চাইলেন, “ও কি খেতে চেয়েছিল-”। প্রবল হাসি চেপে বললাম, ও আসলে কিছু চায়নি। না চাইতেই কেনা হয়েছে বেশ কয়েকখনা বই। যা তুত্তুরীর হিসেবে অ-ন-এ-এ-ক। আঁতকে বলেছিল, বাংলা তো তেমন পড়তে পারি না। বাবা দিয়েছে ধমকে হাঁকিয়ে । হাঁদাভোঁদা বা বাঁটুল তো দিব্যি পড়তে পারিস, শুধু বিভূতিভূষণ বা অবন ঠাকুর দেখলেই পারিস না? সবশেষে মা আবার যমজ বই কিনেছে,দুটো মোটকা মোটকা রাশিয়ার উপকথা। আঁতকে উঠেছে তুত্তুরী!দুটোই আমার? বলা হল,একটি সেই গুণধরের যিনি কিছুদিন আগে,চিমনি পরিষ্কার করতে আসা মিস্ত্রিকে,মায়ের দামী শাল কেটে সরবরাহ করেছিলেন-। সেই থেকে সমানে মাপছে তুত্তুরী। কোনটা পাতলা বেশী, সেটাতেই হোক তুত্তুরীর নাম লেখা-
আর হ্যাঁ, প্রিয় টাইগার, আপনাকে আমরা ভুলিনি। আজও নিভৃতে আপনার কথা বলেছি রঞ্জনদা আর আমি।কি বলেছি,বলুন দিকি? বলেছি, উহ শের থা সাব। অউর শের কো পাকড়ে কিসমে হ্যায় ইতনা দম- যেখানেই থাকুন, ভালো থাকবেন।
No comments:
Post a Comment